শেখ কামাল প্রজন্মের অহংকার
ডাঃ মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)
৫ আগস্ট শেখ কামালের জন্মদিন।সতীর্থ-স্বজন’ দ্বিতীয়বারের মতো গত বছরও জাতীয় প্রেসক্লাবে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করেছিল।পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় দাদার আমন্ত্রণে আমিও ওখানে ছিলাম।ছিমছাম,সাদামাটা আয়োজন।আলোচকরা প্রত্যেকেই শেখ কামালের বন্ধু।তার ছাব্বিশ বছর দশ দিনের স্বল্প পরিসর কিন্তু ঘটনাবহুল জীবনের এরা প্রত্যেকেই সাক্ষী ও সঙ্গী।স্মৃতিচারণের এক পর্যায়ে পরবর্তী প্রজন্মের দৃষ্টিতে শেখ কামালকে তুলে ধরতে আমার প্রতি হঠাৎই সঞ্চালকের আহ্বান।বিব্রত আমি,অপ্রস্তুত তো বটেই।
আমি কে? আমি বাজি ধরে বলতে পারি সেদিনের সেই আলোচনা সভায় তো বটেই এমনকি এই লেখাটিও যারা পড়ছেন তাদের বেশিরভাগের কাছেই আমি ব্যক্তিগতভাবে অচেনা।আর যারাও বা চেনেন তাদের কারও কাছে আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের লিভার বিভাগের চেয়ারম্যান তো কারও কাছে ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতালের লিভারের চিকিৎসক।কারও কারও কাছে আমি ন্যাসভ্যাকের উদ্ভাবক।কিন্তু আমি হলফ করে বলতে পারি,যারা আমাকে ব্যক্তিগতভাবে চেনেন তারা প্রত্যেকেই জানেন যে আমি এই জীবনে কখনোই বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বাইরে অন্যকিছুকে ধারণ করিনি।১৯৮৬ সালে ঢাকা কলেজের করিডোরে পা দেয়ার পর থেকেই এই আদর্শের সঙ্গে আমার সখ্য।এই আমিও কিন্তু স্বপ্নেও ভাবিনি যে এই আদর্শের অনুসারীরা একদিন জাতীয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বসবেন।শুধু একটি আদর্শিক জায়গা থেকে নৌকার স্লোগান দিয়েছি,এক দড়িতে ফাঁসি চেয়েছি সাইদির-নিজামীর।ধাওয়া খেয়েছি,খেয়েছি টিয়ার শেলও,কিন্তু সংবিধানের চার মূলনীতি আবারও সন্নিবেশিত হবার স্বপ্ন তারপরও হৃদয়ে লালন করেছি।অথচ এই আমার কাছেও শেখ কামাল অচেনা একজন।আর শুধু আমি কেন,ভাঙ্গা স্যুটকেসের ভেলকিতে প্রতারিত আমার প্রজন্মের যে কোন কারও কাছেই তিনি তাই-ই।
অনুষ্ঠানে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মেজর জেনারেল (অবঃ) সাইদ আহমেদ যখন ১৯৭১-এর জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ডুয়ার্সের জঙ্গলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম ব্যাচের ক্যাডেট অফিসারদের ট্রেনিং-এর কঠিন সময়গুলোর সাবলীল বর্ণনা দিচ্ছিলেন তখন অবাক হয়ে শুনছিলাম তার সহকর্মী,একজন রাষ্ট্রপতির ছেলে শেখ কামালের সঙ্গে তার কাটিয়ে আসা সময়গুলোর কথাও।তিস্তার শাখা নদীতে ট্রেনিং-এর সময় হারিয়ে যাওয়া রাইফেল উদ্ধারে তাদের পাঁচ দিনব্যাপী প্রাণান্ত প্রয়াস তাতে সক্রিয় অংশগ্রহণ শেখ কামালের। এ্যামবুশ ট্রেনিং-এর সময় দুর্ঘটনাক্রমে আহত ক্যাডেট অফিসারকে ট্রাক্টরে তুলে এমআই রুমে নিয়ে ছুটছেন শেখ কামালই।একদিকে মশার কামড়ে রাতের পর রাত ঘুমাতে পারছেন না,অথচ অন্যদিকে কঠিন ট্রেনিং শেষে ঘুমাতে চেষ্টা করতে যাওয়ার আগে ক্যাডেট অফিসারদের কমনরুমে হারিকেনের আলোয় হারমোনিয়ামে স্বাধীন বাংলা বেতারের গান গেয়ে উদ্দীপ্ত করছেন সহকর্মীদের।কোন কারণ ছাড়াই কমান্ডেন্টের কাছে প্রকাশ্যে শুনতে হয়েছে রাষ্ট্রপতির ছেলে হিসেবে কোন বাড়তি সুবিধা যেন প্রত্যাশা না করেন।প্রতিবাদ তো দূরে থাক,টু-শব্দটিও করেননি। অথচ ক্যাডেট অফিসারদের নিম্নমানের খাবার সরবরাহে প্রতিবাদী হয়েছেন উচ্চকণ্ঠে।আর ট্রেনিং শেষে ফলাফল? বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম ব্যাচের কমিশনপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন শেখ কামালের নাম ছিল মেধা তালিকায় পঞ্চম।স্বাধীন দেশে সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে দায়িত্ব নিয়েছিলেন যুব সমাজকে সংগঠিত করার।বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে একদিকে সক্রিয় নেতৃত্ব দিয়েছেন,তেমনি যুব সমাজকে খেলায়-গানে-নাটকে মাতিয়ে একটা সুন্দর সমাজের প্রত্যাশায় কাজও শুরু করেছিলেন।
আবাহনী ক্রীড়া চক্রের যাত্রা শুরু তার হাতে ধরে,একথা জানা সবার। কিন্ত আমরা কি জানি আধুনিক জার্সি পরে,আধুনিক বুট পায়ে, আধুনিক ফুটবল দিয়ে ছোট-ছোট পাসে এদেশে আধুনিক ফুটবল খেলার জনকও তিনি।খেলতেন নিজেও।খেলতেন ফুটবল,ক্রিকেট, বাস্কেটবল আর ভলিবল।খেলেছেন আজাদ স্পোর্টিং ক্লাব,আবাহনী ক্রীড়া চক্র আর স্পারস-এ।বিশ্বাস করতেন একজন ক্রীড়াবিদের মাধ্যমেও একটি জাতি পরিচিতি পেতে পারে বিশ্বব্যাপী।একজন সাকিব আল হাসান,মাশরাফি বিন মর্তুজা,সালমা কিংবা কলসিন্দুরের কিশোরীরা কি আজ আমাদের তাই করে দেখাচ্ছেন না।শুধু আবাহনীই নয়,পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাব,ইস্ট এ্যান্ড স্পোর্টিং ক্লাব আর কামাল স্পোর্টিং ক্লাবেরও (এই ক্লাবটি কিন্তু শেখ কামালের নামে নয়)।কারণটাও খুব সরল। আবাহনীর পাশাপাশি এই ক্লাবগুলোতেও তখন ছিল তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাধান্য।তবে এই পৃষ্ঠপোষকতা করতে গিয়ে তিনি কখনোই কোন বড় ব্যবসায়ীর কাছে ধর্ণা দেননি।অবলীলায় ফিরিয়ে দিয়েছেন আবাহনীর জন্য চারতলা ভবন নির্মাণের প্রস্তাবও।যারা শুধু বিভিন্ন সময়ে ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন শুধু তাদেরই অধিকার ছিল শেখ কামালের এই ক্রীড়াযজ্ঞে দশ-বিশ-একশ’ টাকা চাঁদা দেয়ার।তাকে পৃষ্ঠপোষকতা করার সুযোগে যাতে কেউ কোন ধরনের বাণিজ্যিক সুবিধা নিতে না পারে এ ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন তিনি বরাবরই।সাইদুর রহমান প্যাটেল আর হারুনুর রশিদ ভাইদের স্মৃতিচারণে এসব কথার অনুরণন।
খেলার সঙ্গে রাজনীতির যোগাযোগও ঘটিয়েছিলেন তিনি অদ্ভুত দক্ষতায়।ইস্ট এ্যান্ড আর ব্রাদার্স ইউনিয়নে তার যোগাযোগের সুবাদে পুরো পুরনো ঢাকায়,বিশেষ করে ওখানকার শিল্পাঞ্চলগুলোতে তার বিশাল অনুসারী বলয় তৈরি হয় যার সুফল এখনও আওয়ামী লীগ ভোগ করছে বলে উঠে আসে ডাঃমোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনের কথায়।তার আহ্বানেই সাইদুর রহমান প্যাটেল ভাই দিলকুশা ছেড়ে ইস্ট এ্যান্ড ক্লাবে যোগ দিয়েছিলেন।একইভাবে ঢাকা স্টেডিয়ামে পাকিস্তানের হয়ে ব্যাট করতে নামার আগে রকিবুল হাসানের ক্রিকেট ব্যাটে জয় বাংলা লেখা স্টিকারটাও সেটে দিয়েছিলেন ডাঃমোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন শেখ কামালের পরামর্শেই।শেখ কামাল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন স্পন্দন শিল্পী গোষ্ঠী।হারমোনিয়াম বাজিয়ে শুধু গান-ই গাইতেন না,বাজাতেন সেতারও।ইস্কাটনে স্পন্দন শিল্পী গোষ্ঠীর অফিসে রিহার্সালের জন্য সারা ঢাকা শহর ঘুরে নিয়ে আসতেন শিল্পীদের, যন্ত্রীদের।পিযূষ দা’র মুখে মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতে থাকি এসব ইতিহাস।পিযূষ দা’র মুখেই জানলাম এদেশের প্রথম নাট্যদল ঢাকা থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতাও শেখ কামাল।স্বাধীন বাংলাদেশে মঞ্চ নাটকের প্রথম মঞ্চায়ন ঢাকা থিয়েটারের এই শেখ কামালের হাত ধরেই।এজন্য ঢাকা জেলা ক্রীড়া সংস্থার ভাঙ্গাচোরা অডিটোরিয়ামটা তিনি ঠিক করিয়েছিলেন অনেক তদ্বির করে।নাটক মঞ্চায়নের আগের দিন রাত সাড়ে এগারোটায় চান মিয়া ডেকোরেটরকে অনুরোধ করে চেয়ারের ব্যবস্থা করেছিলেন দর্শকদের জন্য।আর প্রচন্ড বৃষ্টিতে ঢাকা শহরের পাশাপাশি সয়লাব যখন অডিটোরিয়ামটিও তখন পিযূষ দা’দের সঙ্গে নিজে হাত লাগিয়েছেন তা পরিষ্কারে।এভাবেই মঞ্চায়িত হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মঞ্চ নাটকটি।
নিজেও তুখোড় অভিনেতা ছিলেন শেখ কামাল।বাংলাদেশের প্রথম সিরিজ নাটকের নাম জানতে চান? ‘ত্রি-রত্ন’- মাত্র দুটি এপিসোড প্রচারিত হয়েছিল নাটকটির পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট পর্যন্ত।এর নির্দেশনায় ছিলেন শেখ কামাল, স্ক্রিপ্টও তারই।আর অভিনয়ে শেখ কামাল,আ ত ম মুনীরউদ্দিন আর তওরিদ হোসেইন বাদল ভাই।আ ত ম মুনীরউদ্দিন ভাইয়ের মুখে অমন ইতিহাস শুনে অবাক হই না আর।আবুজর গিফারী কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দিন শেখ কামালের গুলিতে আহত জাসদ ছাত্রলীগের কমিটির কথা মনে আছে? নির্বাচনের পরদিন পল্টনের জনসভায় ষাট হাজার লোকের সামনে রক্তমাখা শার্ট-প্যান্ট দেখিয়ে মায়া কান্নায় ভেসেছিলেন জাসদ নেতারা।সাইদুর রহমান প্যাটেল ভাইয়ের জবানীতে জানতে পারি সত্য বয়ান।নির্বাচনের দিন সকালে সেখানে ছিলেন শেখ কামাল।কিন্তু জাসদের আগ্রাসী ভাবভঙ্গি দেখে সহকর্মীদের পরামর্শে দুপুরের অনেক আগেই সেখান থেকে চলে যান তিনি।দুপুরের পরে নির্বাচনের ফলাফল ছাত্রলীগের দিকে ঝুঁকতে যাচ্ছে বুঝতে পেরে জাসদের বহিরাগত সন্ত্রাসীরা নির্বিচারে গোলাগুলি শুরু করে। কলেজের পাশের গলি থেকে তাদের গুলি ছুড়তে দেখেছেন অনেকেই।তাদেরই একজন সাইদুর রহমান প্যাটেল ভাই।অথচ কি অবলীলায়ই না পরদিন জাসদের জনসভায় উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হলো!
শুনলাম শেখ কামালের আলোচিত বিয়ের ঘটনাটিও।সুলতানা কামাল- ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয়ের তুখোড় এ্যাথলেট।লং জাম্প আর একশ’ মিটার স্প্রিন্টের রেকর্ডের মালিক,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা ‘ব্লু’।যেমন গুণী তেমনি সুন্দরী।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সে সময়কার সব ছাত্রের আরোধ্য নারী।কিন্তু তিনি সাড়া দিয়েছিলেন একহারা গড়নের,সাদাসিধে,হাফ শার্ট,সাদা প্যান্ট আর স্যান্ডেল পরা শেখ কামালের প্রেম নিবেদনে।মহিলাদের অঙ্গনে শেখ কামালের ছিল অসম্ভব জনপ্রিয়তা।এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ বিভাগের পাশের ছাত্রী কমনরুমটিতেও তার ছিল খোলা নিমন্ত্রণ।
এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নির্বাচনে দাঁড়িয়ে বিরোধী ছাত্র সংগঠনের সব মহিলা সমর্থকের ভোটও পেয়েছিলেন শেখ কামাল। এহেন শেখ কামালের প্রস্তাবে সাড়া দিবেন সুলতানা কামাল তাতে আর অবাক হওয়ার কি? বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন সুলতানা কামালের বাসায়।দু’পক্ষের সম্মতিতে পঁচাত্তরের চৌদ্দ জুলাই বিয়ে হয় তাদের।বঙ্গমাতার আগ্রহে মাস্টার্স ফাইনালের মাত্র সাত দিন আগে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তারা।পঞ্জিকা দেখে দিনটি বাছাই করেছিলেন বঙ্গমাতা।তাদের একমাস একদিন স্থায়ী দাম্পত্য জীবনের যবনিকা টেনেছিল ঘাতকের বুলেট পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টে।মাশুরা হোসেন আপা আর সৈয়দ শাহেদ রেজা ভাই সাবলীল বর্ণনায় সবকিছু যেন চোখের সামনে মূর্ত হয়ে উঠছিল।যতই শুনছিলাম ততই স্তব্ধ হচ্ছিলাম,বিস্ময়ে আর অবনত হচ্ছিলাম শ্রদ্ধায় সব্যসাচী শেখ কামালের প্রতি।নিজের বক্তব্য শেষে পোডিয়াম থেকে যখন নামছি,তখন সহসা উপলব্ধি- ‘আজকের বাংলাদেশে একজন শেখ কামালের বড় বেশি প্রয়োজন।একজন শেখ কামালের শূন্যতা যে কি বিশাল শূন্যতার জন্ম দেয় তার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ তো আমাদের আশপাশেই।শেখ কামালের জন্মদিনে এই ক্ষুদ্র আমার প্রত্যাশা আর আক্ষেপ মিলেমিশে তাই এতটুকুই।
লেখক:অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান,লিভার বিভাগ,বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়