ষ্টপ জেনোসাইড ইন বার্মা
আকবর হোসেন
নানান বরন গাভীরে ভাই একই বরন দুধ, জগৎ ভরমিয়া দেখলাম একই মায়ের পুত।” উক্তিটি বহুভাষাবিদ ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ’র। তিনি বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করেছেন। জানিনা তিনি কোন্ প্রেক্ষাপটে এটি লিখেছিলেন তবে আজকের দুনিয়ায় তার এই কালজয়ী উক্তির তাৎপর্য অনেক। মানুষের রক্ত নিয়ে চলছে আজ নিষ্ঠুর খেলা। জাতি, গায়ের রঙ, ভাষা ও ধর্মের কারণে মানুষের উপর চলছে অবিচার-অত্যাচার। মানুষরূপী হায়েনাদের কবল থেকে রক্ষা পাচ্ছেনা দুনিয়ার অধিকার বঞ্চিত মানুষ। জাতি ধর্মের পার্থক্য থাকলেও তারা ভুলে গেছে তারা যে একই মায়ের সন্তান। বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী ভূপেন হাজারিকা গেয়েছিলেন একটি বিখ্যাত গান, “আমায় একজন সাদা মানুষ দাও যার রক্ত সাদা, আমায় একজন কালো মানুষ দাও যার রক্ত কালো। যদি দিতে পারো প্রতিদান যা’ কিছু চাও তাই পেতে পারো।” নানা রঙের রক্ত দেয়া তো কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। কারণ আমাদের সবার রক্তই একই রঙের। তারপরও কেনো এতো সংঘাত? কেনো এই রক্ত পিপাষুরা শুধু মানুষের রক্তই চায়। কেনো বিশ্বের অসহায় মানুষের রক্তের দাম একেবারে পানির মতো। প্রতিদিন কতো মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়া হচ্ছে তার কোন হিসেব নেই। এখন বার্মার রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠির উপর নিষ্ঠুর হত্যাকান্ড চলছে। এথনিক ক্লিনসিং এর ভয়াবহ এজেন্ডা নিয়ে সেদেশের কুখ্যাত সেনাবাহিনী উন্মত্ত হয়ে গণহত্যায় নেমেছে। তারা সকল রোহিঙ্গাদের শেষ করে দিতে চায়। তাদের সাথে যোগ দিয়েছে চরমপন্থী বৌদ্ধরা। তাদের সম্মিলিত আক্রমণে দেশত্যাগ করছে হাজার হাজার রোহিঙ্গা, আশ্রয় নিচ্ছে বাংলাদেশে। রাখাইন প্রদেশের সকল রোহিঙ্গাদের চৌদ্দপুরুষের ভিটা থেকে চিরতরে উচ্ছেদ করে দেয়া হচ্ছে। স্কুলে আমরা পড়েছি আরাকান রাজসভায় বাংলা সাহিত্য। আজ আরাকান পুড়ছে। আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হয়েছে সেখানে। মগের মুল্লুকের মগরা বড়ই নিষ্ঠুর। হিংসার লকলকে আগুন তাদের চোখেমুখে। তারা সবকিছু ধ্বংস করে দিতে চায়। তাদের প্রয়োজন শুধু মাটি। কারণ সেখানে নাকি প্রাকৃতিক সম্পদ পাওয়া গেছে। শকুনদের লুলোপ দৃষ্টি পড়েছে সে মাটিতে। বড় শক্তি আছে তাদের সাথে।
সেনাবাহিনী এবং তাদের দোসরদের নির্যাতন ও হত্যাকান্ডের দৃশ্য বিশ্ব মিডিয়া এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় যেভাবে আসছে তাতে তাদের নৃশংসতার সকল মাত্রা ছাড়িয়ে যাবার প্রমাণ পাওয়া যায়। অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন ভয়াবহ সে দৃশ্যগুলো দেখে। ঘুমের ব্যাঘাত ঘটছে। আহারে! কোন মানুষ কোন মানুষকে এভাবে হত্যা করতে পারে? আর সারা বিশ্ব নীরবে তাকিয়ে দেখছে এসব হত্যাকান্ড। মুসলিম বিশ্বের শাসকবর্গ তাদের ক্ষমতার মসনদ নিয়ে ব্যস্ত। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ এরদোগান যে দৃঢ়তা নিয়ে কথা বলছেন এবং রোহিঙ্গাদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন অন্যদের তেমন কোন ভূমিকা চোখে পড়ছে না। দুনিয়ার বড় বড় শক্তিগুলো সন্ত্রাস দমনের নামে বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত। লাখো মানুষের রক্তের বিনিময়ে হলেও বাণিজ্য চাই। ব্যাপক বিধ্বংসী মারণাস্ত্র থাকার কোন প্রমাণ না থাকা সত্ত্বেও ইরাককে বিরান করা হলো। আফগানিস্তান ও লিবিয়ারও একই অবস্থা। তাদের স্বার্থের জন্য তারা সবকিছুই করতে পারে। বার্মাতে নাকি চীনের স্বার্থ রয়েছে। তবে সময়ই বলে দেবে আসলে কার স্বার্থ কোথায়। রাখাইন রাজ্যে কোন মানুষ থাকার প্রয়োজন নেই বিশেষ করে কোন মুসলমানের। যেনো মুসলমানদের কোন মানবাধিকার থাকতে নেই। নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে নারী-পুরুষ এমনকি শিশুদের। মানুষ কি এতো নিষ্ঠুর হতে পারে? এই নিষ্ঠুরতা দিয়েই তারা তাদেরকে শেষ করে দিতে চায়। ফিলিস্তিনকে যেভাবে গ্রাস করছে ইজরাইল, হত্যাকান্ড চালাচ্ছে, তাদেরকে ভিটেমাটি ছাড়া করছে, তাদের আবাসভূমি জবরদখল করছে তারচেয়েও জঘণ্য কায়দায় আজ রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে বার্মিজ সেনাবাহিনী। তারা শুধু রাখাইনের মাটিই চায় আর কিছু চায় না।
বিশ্ব মোড়লেরা চাইলে এক হুংকারে হত্যাকান্ড থামাতে পারে। কিন্তু তারা তা’ করছে না। ইরাক, লিবিয়া আফগানিস্তানে আক্রমণ করতে তাদের সময় লাগেনা অথচ বার্মায় সবার চোখের সামনে চলছে এই গণহত্যা। সবাই নিশ্চুপ! গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার এর ধ্বজাধারীরা আজ কোথায়? ইউরোপ আমেরিকায় এই ট্যাবলেটগুলো বিনামূল্যে পাওয়া যায়। অন্যরা মরুক তাতে তাদের কিছু যায় আসে না। নিজের স্বার্থ থাকলে ভিন্ন কথা। তাদের দুমূখো নীতির বলি হচ্ছে দুনিয়ার অগণিত মানুষ। অধিকারবঞ্চিত মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেলে আর কিছু করার থাকে না। এসব কারণে সন্ত্রাসবাদের জন্ম হয়। মুক্তিপাগল মানুষের এই প্রতিরোধ ও পাল্টা আক্রমণকে আমরা সবাই বলছি ‘সন্ত্রাস’।
পাশ্চাত্যের মানুষের জীবনের মূল্য অনেক। এখানে কোন দুর্ঘটনা হলে মিডিয়ায় হুলস্থুল পড়ে যায়। মানবতাবাদী আমরা সবাই সোচ্চার হই, প্রতিবাদ করি, নিন্দা জানাই। অপরাধীর বিচার হয়, শাস্তিও হয়। অথচ প্রতিদিনই সিরিয়া, ইরাক,লিবিয়া, ইয়ামেনে মানুষের রক্ত গঙ্গা বইছে। বসনিয়া, রুয়ান্ডা, গুজরাট, সুদান, সোমালিয়ায় কত মাস্যাকার হলো। আসলে মুসলমানের রক্তের কোন দাম নেই! সেদিন এটিএন বাংলার একটি ইন্টারভিউতে দেখলাম সাংবাদিক মুন্নী সাহা একজন রোহিঙা যুবককে প্রশ্ন করছেন। উত্তরে সে বললো যেহেতু আমরা মুসলমান সে কারণেই আমাদের উপর এই হত্যাকান্ড, আমাদের কোন অধিকার নেই। সেদেশের ভাষা শেখারও কোন সুযোগ নেই। ক্লাশ ফাইভ শেষে আর কোন পড়াশুনার সুযোগ নেই। তার মানে মুসলমান হবার কারণে কোন মানবাধিকার নেই। ৪/৫ বছর আগে রোহিঙাদের নিয়ে সৈয়দ জুবায়ের আহমদ নির্মিত দ্যা ফ্লোটিং ম্যান নামক একটি শর্ট ফিল্ম এর প্রিমিয়ার শো দেখলাম। ইষ্ট লন্ডনের ষ্টেপনীগ্রীনস্থ জেনেসিস সিনেমাহলের পর্দায় ছবিটি দেখে অনেকেই কেঁদেছেন। রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের একটি নৌকাডুবিতে ৩৩ জনের লাশ পাওয়া এবং তাদের মাঝে ১ জনের বেঁচে যাবার ঘটনা নিয়ে রোহিঙা মুসলিমদের বঞ্চিত জীবনের এক করুণ কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে ছবিটিতে। আসলে রোহিঙা মুসলিমদের মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই। তাদেরকে সেদেশের নাগরিক হিসেবে গন্য করা হচ্ছে না। তাদের ভোটাধিকার নেই। এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যেতে পাস লাগে। বিয়ে করতেও অনুমতি লাগে। দেশের ভেতর অবাধ চলাফেরায় আছে নিষেধাজ্ঞা। এভাবে কী একটি জনগোষ্ঠি জীবন যাপন করতে পারে? এরকম বর্বরতার শিকার যদি অন্য কোন ধর্মের মানুষ হতো তাহলে কী হতো? ইষ্ট তিমুরকে তো স্বাধীনই করে দেয়া হলো। রোহিঙ্গারা তো কোন স্বাধীনতা চাচ্ছেনা। তারা চাচ্ছে শুধু তাদেরকে বার্মিজ হিসেবেই নিজেদের ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে নিজের দেশে বসবাস করতে দেয়ার অধিকার। কিন্তু তাদের সেই নূন্যতম অধিকার কেড়ে নেয়া হচ্ছে বুলেট দিয়ে। এজন্যই কি দুনিয়ার মানুষ সংগ্রাম করেছিলো সুচীর জন্য? অং সাং সুচীর মুক্তির দাবিতে সারাবিশ্ব ছিলো প্রতিবাদ মুখর। অথচ আজ আমরা কী দেখছি সেখানে? শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত নেত্রী সুচীর নোবেল প্রাইজ বাতিলের দাবী উঠেছে।
বিশ্ব মোড়লেরা কিছু করুক না করুক সেদিকে চেয়ে নেই দুনিয়ার শান্তিকামী মানুষ। তারা জেগে উঠেছে। দেশে দেশে চলছে প্রতিবাদ বিক্ষোভ। আমরা এই অন্যায়কে সয়ে যেতে পারিনা। শুধু তাই নয় রোহিঙ্গাদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছে অগিণত মানুষ। মানবতাবাদী শিল্পী ভূপেন হাজারিকার আরেকটি বিখ্যাত গান – “মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য, একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না, অ বন্ধু …..”। এই মানুষের সুখ দুঃখে বিবেকবান মানুষ বসে থাকতে পারেনা। সে দুনিয়ার যে প্রান্তেই থাকুক আওয়াজ তুলবেই। জাতি, ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে যেখানেই অবিচার অন্যায় সেখানে আমাদের কন্ঠ সোচ্চার। আসুন সবাই চিৎকার দিয়ে বলি ষ্টপ জেনোসাইড ইন বার্মা! ষ্টপ কিলিং ইননোসেন্ট পিপল! ষ্টপ ট্রেনিং বার্মিজ আর্মি! উই ওয়ান্ট জাষ্টিস, উই ওয়ান্ট পিস!
পরিশেষে বিখ্যাত মানবাধিকার নেতা মার্টিন লুথার কিং এর একটি উক্তি দিয়ে আজকের লেখা শেষ করতে চাই – “ইনজাষ্টিস এনিহোয়ার ইজ এ থ্রেট টু জাষ্টিস এভরিহোয়ার”
লন্ডন, 12 সেপ্টেম্বর 2017
akbargermany@hotmail.com
লেখক: সাংবাদিক