কার্ল মার্কসের আত্মীয়-স্বজন
দিলীপ মজুমদার
(কার্ল মার্কস বিশ্বখ্যাত। আপনি পছন্দ করুন বা না করুন, ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব , দর্শন , অর্থনীতির আলোচনায় তাঁকে বাদ দেওয়া চলবে না । মার্কস বা তাঁর প্রিয় বন্ধু এঙ্গেলসের কথা আমরা অল্প-বিস্তর জানি ; জানি মার্কসের স্ত্রী জেনির কথা । কিন্তু আমরা জানি না কার্ল মার্কসের মা-বাবা , ভাই-বোন, মাসি-মেসো, শ্বশুর- শাশুড়ি , পরিচারিকা ও তাঁর পুত্র, এবং , ছেলে-মেয়ের কথা ; আমরা জানি না, যে মানুষটি বিশ্বের মানচিত্র বদলে দিয়েছিলেন , তাঁর কয়েকটি সন্তানকে অকালমৃত্যু বরণ করে নিতে হয়েছে , তাঁর দুই কন্যাকে যেতে হয়েছে আত্মহননের পথে । আমরা কয়েকটি পর্বে তাঁর আত্মীয়-স্বজনের পরিচয় দেবার চেষ্টা করব । বিভিন্ন ভাষায় কার্ল মার্কসের জীবনী অনেক লেখা হয়েছে , কিন্তু তাঁর পরিবার-পরিজনদের উপর তেমন আলোকপাত হয় নি । তাই এ ব্যাপারে তথ্যেরও অভাব আছে । সেই সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়েই আমরা অগ্রসর হচ্ছি)
পর্ব-১
হাইনরিখ মার্কস ( ১৭৭৭-১৮৩৮): কার্ল মার্কসের বাবা
কার্ল মার্কসের বাবা হাইনরিখ মার্কস ছিলেন এক জার্মান আইনজীবী । তিনি সারলুইএর এক ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। প্রথমে তাঁর নাম ছিল হার্শেল লেভি । রাব্বি মার্কস লেভি মরডেখাই বেন স্যামুয়েল হালেভি ও ইভা লোর সন্তান তিনি । ১৮১৪ সালে ইনি আইন পরীক্ষায় কৃতকার্য হলেন ।কিন্তু আইনজীবী হিসেবে কাজ করতে পারলেন না ।
১৮১৫ সালে ওয়ার্টালু যুদ্ধে পরাজিত হলেন নেপোলিয়ন ।ফলে প্রাশিয়ার রক্ষণশীল রাজাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় রাইনল্যাণ্ড, ইহুদির পক্ষে আইনি পেশা গ্রহণ করার বাধা জন্মায় । হার্শেল লেভির পক্ষে বলেন প্রাদেশিক সুপ্রিম কোর্টের প্রেসিডেন্ট । কিন্তু প্রাশিয়ার আইনমন্ত্রী সে প্রস্তাব বাতিল করে দেন । তখন হার্শেল লেভি লুথারীয় খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন , নিজের নাম বদল করে নাম রাখেন হাইনরিখ মার্কস ।তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদেরও ধর্মান্তরিত করা হয় । তাঁর স্ত্রী হেনরিয়েটা ছিলেন নেদারল্যাণ্ডের এক সম্পন্ন ইহুদি ব্যবসায়ীর কন্যা ।
হাইনরিখ ছিলেন যুক্তিবাদী , উদারনৈতিক চিন্তায় বিশ্বাসী ।দার্শনিক কান্ট ও ভলতেয়ারের গভীর প্রভাব পড়েছিল তাঁর উপর । প্রাশিয়ার সংবিধান ও সংস্কার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন তিনি ।
আলান রায়ান ও ইশা বার্লিনের লেখা ‘কার্ল মার্কস :হিজ লাইফ অ্যাণ্ড এনভায়রনমেন্ট’ বই থেকে পিতা-পুত্রের সম্পর্কের ব্যাপারে এক মজার তথ্য পাই । সতেরো বছর বয়েসে কার্ল মার্কস পড়তে গেলেন বন বিশ্ববিদ্যালয়ে । ছেলে তাঁর মতো আইন নিয়ে পড়াশোনা করুক , এই ছিল বাবার ইচ্ছে ।কিন্তু ছেলে মেতে গেলেন দর্শন ও সাহিত্যে । শুধু তাই নয় , যুক্ত হলেন ‘ট্রিয়ের টাভার্ন ক্লাব ড্রিংকিং সোসাইটি’তে ।বিরক্ত হয়ে বাবা ছেলেকে নিয়ে এলেন বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে । না, সেখানেও আইনবিদ্যা তাঁর মনোহরণ করতে পারল না । ছেলের উৎকেন্দ্রিকতা দেখে বিরক্ত হয়ে বাবা লিখলেন চিঠি, যে চিঠির ছত্রে ছত্রে বিরক্তি ও হতাশা :
‘ Alas, your conduct has consisted merely in disorder , meandering in all the fields of knowledge, musty traditions by somber lamplight ; degeneration with a beer glass . And shirking unsociability and a refusal of all conventions and even all respct for your father.’ জেনির সঙ্গে ছেলের প্রেম নিয়েও তির্যক মন্তব্য করেছেন বাবা , ‘Your intercourse with the world is limited to your sordid room, where perhaps lie abandoned in the classical disorder the love letters of a Jenny and the tear–stained counsels of your father………’ .
বাবা যাই বলুন , ছেলে কিন্তু বাবা-অন্ত প্রাণ ছিলেন । এ কথা জানিয়েছেন কার্ল মার্কসের মেয়ে এলেনর । তিনি বলেছেন , ‘বাবা ঠাকুরদার কথা বলতেন সব সময় । তাঁর কথা বলে ক্লান্ত হতেন না তিনি । তাঁর জামার পকেটে থাকত ঠাকুরদার ছবি ।’ কার্ল মার্কসের মৃত্যুর পরে সে ছবি কফিনে দিয়েছিলেন এঙ্গেলস ।
হেনরিয়েটা প্রেসবার্গ ( ১৭৮৮-১৮৬৩): কার্ল মার্কসের মা
হেনরিয়েটা প্রেসবার্গের জন্ম নেদারল্যাণ্ডের নিজমেজেনের এক ইহুদি পরিবারে । আইজ্যাক হেম্যানস ( ১৭৪৭-১৮৩২) তাঁর বাবা এবং নানেতে সলোমনস কোহেন ( ১৭৫৪-১৮৩৩) তাঁর মা । তাঁদের পাঁচ সন্তানের মধ্যে হেনরিয়েটা দ্বিতীয় । সম্পন্ন ব্যবসা্য়ী তাঁরা । ব্যবসা ছিল লণ্ডনে । নিজমিজেন সাইনাগজে হার্সেল মার্কসের ( হাইনরিখ মার্কস) সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয় ১৮১৪ সালে । বিয়েতে তিনি ভালো যৌতুক পান ।তারপর স্বামীর সঙ্গে তিনি প্রুশীয় রাইনল্যাণ্ডের ট্রিয়ের শহরে চলে যান ।
১৮২৪ সালে লুথারীয় খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন তিনি ও তাঁর সন্তানরা । এতে হাইনরিখের পরিবারের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক তিক্ত হয় । তবে হেনরিয়েটা শেষ পর্যন্ত যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করেছেন । । তাঁদের নয়টি সন্তানের মধ্যে চারজন ছেলে এবং পাঁচজন মেয়ে : ডেভিড মার্কস (১৮১৫-১৮১৯) , সোফিয়া মার্কস (১৮১৬-১৮৮৬) , কার্ল মার্কস ( ১৮১৮-১৮৮৩) , হারম্যান মার্কস ( ১৮১৯-১৮৪২) , হেনরিয়েটা মার্কস (১৮২০-১৮৪৫) , লুই জুটা ( ১৮২১-১৮৯৩) , এমিলি কনরাডি(১৮২২-১৮৮৮) , ক্যারোলিন মার্কস (১৮২৪-১৮৪৭) , এডুয়ার্ড মার্কস ( ১৮২৬-১৮৩৭) । যক্ষ্মারোগে মারা যান হেনরিয়েটা প্রেসবার্গ ।
হেনরিয়েটার প্রথাগত শিক্ষা ছিল না । কিন্তু তাঁর বাস্তববুদ্ধি ছিল প্রখর । এক আদর্শ গৃহবধূর দায়িত্ব তিনি পালন করে গিয়েছেন ( ‘a good mother without special intellectual gifts’ ) । অন্য সন্তানের স্বাস্থ্যভঙ্গ দেখে তিনি কার্লের ব্যাপারে চিন্তিত ছিলেন । তাঁর পাঁচটি সন্তানের অকালমৃত্যু হয়েছিল , চারজনই মারা গিয়েছিলেন যক্ষ্মারোগে । বন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত ছেলেকে তিনি নিয়মিত লিখতেন চিঠি । পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকার ব্যাপারে সতর্ক করিয়ে দিতেন —‘ You must never regard cleanliness and order as something secondary, for health and cheerfulness depend upon them . Insist strictly that your rooms are scrubbed frequently and fix a definite time for it—and you , my dear Karl , have a weekly scrub with sponge and soap. ‘
কার্ল মার্কসের জীবন-যাপন পদ্ধতিতে উদ্বেগ প্রকাশ পেয়েছে মায়ের । তিনি ছেলেকে মাথা গরম না করতে , পরিমিত মদ্যপান ও তামাকু সেবন করতে , অধিক রাত্রি জাগরণ না করতে বলেছেন , ‘ You must avoid everything that could make things worse , you must not get over–heated , nor drink a lot of wine or coffee , and not eat anything pungent , a lot of pepper or other spices . You must not smoke any tobacco , not step up too late in the evening and always rise early . Be careful , also not to catch cold and , dear Karl , do not dance until you are quite well again . ‘
টাকা-পয়সার দরকার হলে কার্ল মায়ের কাছে আবদার করতেন । মা-ও সাধ্যমতো টাকা পাঠাতেন । ১৮৪৮ সালে কার্ল যখন ব্রাসেলসে ছিলেন তখন ৬হাজার ফ্রাঁ পাঠিয়ে দেন হেনরিয়েটা । বেলজিয়ান পুলিশ মনে করেছিলেন যে এসব টাকা বৈপ্লবিক কাজের জন্য , তাই হেনরিয়েটাকে জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়তে হয় । হাইনরিখ মার্কসের মৃত্যুর পরে সম্পত্তির উত্তরাধিকারকে কেন্দ্র করে মা ও ছেলের মধ্যে মনোমালিন্য হয় । ১৮৬২ সালে মায়ের সঙ্গে কার্ল দেখা করলে হেনরিয়েটা স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে তিনি আর টাকা-পয়সা দিতে পারবেন না ।
(চলবে)
(দিলীপ মজুমদার: সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্তগবেষক, সত্যবাণীর কলকাতা কন্ট্রিবিউটিং কলামিষ্ট)