কার্ল মার্কসের আত্মীয়-স্বজন-৩

দিলীপ মজুমদার

(কার্ল মার্কস বিশ্বখ্যাত। আপনি পছন্দ করুন বা না করুন, ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব , দর্শন , অর্থনীতির আলোচনায় তাঁকে বাদ দেওয়া চলবে না মার্কস বা তাঁর প্রিয় বন্ধু এঙ্গেলসের কথা আমরা অল্প-বিস্তর জানি ; জানি  মার্কসের স্ত্রী জেনির কথা কিন্তু আমরা জানি না কার্ল মার্কসের মা-বাবা , ভাই-বোন, মাসি-মেসো, শ্বশুর- শাশুড়ি , পরিচারিকা ও তাঁর পুত্র, এবং , ছেলে-মেয়ের কথা ;  আমরা জানি না, যে মানুষটি বিশ্বের মানচিত্র বদলে দিয়েছিলেন , তাঁর কয়েকটি সন্তানকে অকালমৃত্যু  বরণ করে নিতে হয়েছে , তাঁর দুই কন্যাকে যেতে হয়েছে  আত্মহননের পথে আমরা কয়েকটি পর্বে তাঁর আত্মীয়-স্বজনের পরিচয় দেবার চেষ্টা করব বিভিন্ন ভাষায় কার্ল মার্কসের জীবনী অনেক লেখা হয়েছে , কিন্তু তাঁর পরিবার-পরিজনদের উপর তেমন আলোকপাত হয় নি তাই এ ব্যাপারে তথ্যেরও অভাব আছে সেই সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়েই আমরা অগ্রসর হচ্ছি)

পর্ব-৩

পল লাফার্গ  (১৮৪২-১৯১১)  //  লরা মার্কসের স্বামী ও কার্ল মার্কসের জামাই

কিউবান-ফরাসি বিপ্লবী  পল লাফার্গ  জন্মগ্রহণ করেন কিউবায় তিনি বলেছিলেন যে তিনটি নির্যাতিত জাতির রক্তধারা তাঁর শিরায় প্রবাহিত কার্ল মার্কস তাঁর বিভিন্ন চিঠিতে কৌতুকের সঙ্গে লাফার্গকে কখনও ‘ নেগ্রিলো’ . কখনও ‘নিগ্রো’ , কখনও বা ‘গরিলার বংশধর’ বলে সম্বোধন করেছেন

১৮৫১ সালে তাঁর পরিবার বোর্দোতে আসেন সেখানে তাঁর বিদ্যালয়ের পড়াশুনো সম্পূর্ণ হয় তারপর তিনি চিকিৎসা নিয়ে পড়াশুনো করেন প্যারিসে এখানে পজিটিভিস্ট দর্শনের দ্বারা প্রভাবিত হন নেপোলিয়ন ( ৩) বিরোধী রিপাবলিকান দলের সঙ্গে যোগাযোগ করেন কিছুদিন পরে তাঁর দেখা হয় কার্ল মার্কস ও অগাস্ট  ব্ল্যাঙ্কির সঙ্গে ১৮৬৫ সালে লিজে আন্তর্জাতিক ছাত্র কংগ্রেসে অংশগ্রহণের ফলে তিনি ফরাসি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিতাড়িত হন  তাই তিনি লণ্ডনে চলে যান সেখানে মার্কসের বাড়িতে যেতেন তিনি মার্কসের দ্বিতীয়া কন্যা লরার সঙ্গে তাঁর প্রণয়-সম্পর্ক স্থাপিত হয় , ১৮৬৮ সালে তাঁরা বিয়ে করেন

লাফার্গকে ফার্স্ট ইন্টারন্যাশনালের জেনারেল কাউন্সিলে  নির্বাচিত করা হয় এবং তাঁর উপর স্পেনের দায়িত্বভার অর্পণ করা হয় ১৮৬৮ সালের ক্যানটোনালিস্ট বিপ্লবের পরে স্পেন  ইন্টারন্যাশনাল কংগ্রেসে  যোগদান করে তাঁর মধ্যে যে নৈরাজ্যবাদী প্রবণতা ছিল তা মার্কস ও অগাস্ট ব্লাংকির প্রভাবে দূর হতে থাকে লাফার্গ ইতালীয় নৈরাজ্যবাদী জিউসেপ ফানেলির বিরুদ্ধতা করেন

১৮৭১ সালে প্যারি কমিউনের পর দমন-পীড়ন শুরু হলেলাফার্গ স্পেনে চলে আসেন  তিনি মাদ্রিদে মার্কসবাদীদের জড়ো  করার কাজ করেন এবং ইমানসিপাসিও পত্রিকায় বেনামে প্রবন্ধ লিখতে আরম্ভ করেন কিন্তু সেইসব লেখার জন্য ১৮৭২ সালে নৈরাজ্যবাদী ফেডারেল কাউন্সিল তাঁকে বহিষ্কার করে এখানে তাঁর শেষ কাজ ছিল হেগে মার্কসবাদী সংখ্যালঘুগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করা।

১৮৭২ থেকে ১৮৮২ সল পর্যন্ত লাফার্গ লণ্ডনে বাস করেছিলেন শৈশবে তিন সন্তানের মৃত্যু হওয়ায় তিনি চিকিৎসাবিদ্যা পরিত্যাগ করে এক ফটোলিথোগ্রাফি ওয়ার্কশপ আরম্ভ করেন এই ব্যবসা ব্যর্থ হয় এঙ্গেলসের অর্থ সাহায্যে চলতে থাকে তাঁদের সংসার লণ্ডন থেকে লাফার্গ ফরাসি দেশের শ্রমিক আন্দোলন দেখভাল শুরু করেন তৃতীয় প্রজাতন্ত্রের প্রথম বছর গুলিতে অ্যাডলফ থিয়ের্সের প্রতিক্রিয়াশীল মনোভাব ও দমন-পীড়নের ফলে  শ্রমিক আন্দোলন তার যে জনপ্রিয়তা হারিয়েছিল , তা আবার ফিরে পায় ১৮৮০ সাল থকে লাফার্গ ফরাসি সমাজতন্ত্র সংবাদপত্র  ‘ লা ইগালাইট’ পত্রিকার সম্পাদনা শুরু করেন এই সময়ে তিনি লিখতে শুরু করেন তাঁর বিখ্যাত বই ‘ দ্য রাইট টু বি লেজি’ ১৮৮২ সালে তিনি তিনি এক বিমা কোম্পানিতে যোগ দেন , সেজন্য তাঁকে প্যারিসে আসতে হয় প্যারিসে এসে  তিনি নব গঠিত ফরাসি ওয়ার্কাস পার্টির কাজকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন  

১৮৯১ সালে পুলিশি হেফাজতে থাকার সময়ে তিনি একটি উপনির্বাচনে ফরাসি সংসদে নির্বাচিত হন তিনিই প্রথম সমাজতন্ত্রী যিনি ফরাসি সংসদে নির্বাচিত হয়েছিলেন তাঁর সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে ফরাসি ওয়ার্কাস পার্টি নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণে উৎসাহিত হয় একজন  গোঁড়া মার্কসবাদী রূপেই তিনি আত্মপ্রকাশ করেছিলেন তাঁরই মতো গোঁড়া ছিলেন  ফরাসি শ্রমজীবী দলের আর এক নেতা জুলেস গুয়েসদে এই দুই নেতাকে মার্কস তাঁর মৃত্যুর কিছু আগে কৌতুক করে লিখেছিলেন , If one thing is certain , I am not a Marxist’ .

ফরাসি দেশে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম  হলেন পল লাফার্গ  তিনি অনেকগুলি গ্রন্থের রচয়িতা  : ‘বুর্জোয়া সেন্টিমেন্টালিজম’ , ‘সোশ্যালিজম অ্যাণ্ড ন্যাশনালিজম’ , ‘দ্য রাইট টু বি লেজি’ , ‘পিজেন্ট প্রোপার্টি অব ফ্রান্স’ , ‘আ ভিজিট টু লুই মিশেল’ , ‘দ্য ডেকাজেভিল স্ট্রাইক’ , ‘দ্য মরো অব দ্য রেভলিউশন’ , ‘রেমিনিসেন্সস অব মার্কস’ , ‘ডারউইনিজিম অন দ্য ফ্রেঞ্চ স্টেজ’ , দ্য মিথ অব অ্যাথেনা’ , ‘দ্য চিনো-জাপানিজ ওয়ার’ , ‘আইডিয়ালিজম অ্যাণ্ড মেটিরিয়ালিজম ইন দ্য কনসেপশন অব হিস্টি’ , ‘ সোশালিজম ইন ফ্রান্স-১৮৭৪-১৮৯৬-৯৭’ , ‘দ্য অরিজিন অব অ্যাবস্ট্রাক্ট আইডিয়াজ’ , ‘আওয়ার গোল’ , ‘দ্য ব্যাঙ্কক্রাপসি অব ক্যাপিটালিজম’ , ‘ দ্য রাইটস অব দ্য হর্স অ্যাণ্ড দ্য রাইটস অব ম্যান’ , ‘দ্য সোশালিসগট আইডিয়াল’ , ‘সোশ্যালিজম অ্যাণ্ড দ্য ইন্টেলক্টচ্যুয়ালস’ , ‘ দ্য বয়কট’ , ‘দ্য হিস্টোরিক্যাল মেথড   অব কার্ল মার্কস’ , ‘সিম্পল সোশ্যালিস্ট ট্রুথ’ , ‘দ্য ওম্যান কোশ্চেন’ , ‘পারসোনাল রিকাএকশন অব এঙ্গেলস’ , ‘সোশ্যালিজম অ্যাণ্ড ইন্টারন্যাশনালিজম’ প্রভৃতি।

জীবনের শেষ পর্বে লাফার্গ ও তাঁর স্ত্রী সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন   তাঁরা প্যারিসের উপকণ্ঠে  ড্রেভিল গ্রামে বসবাস করতেন  ১৯১১ সালের ২৫ নভেম্বর তিনি ও তাঁর স্ত্রী আত্মহত্যা করেন লরা মার্কসের আলোচনায় আমরা পলের লেখা আত্মহত্যার চিঠিটি উল্লেখ করেছি এইআত্মহত্যা সমাজতন্ত্রীদের বিস্মিত ও বিব্রত করেছিল রাশিয়ার কমিউনিস্ট নেতা লেনিন ড্রেভিল গ্রামে লাফার্গের সঙ্গে দেখা করতে যেতেন তাঁদের অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ায় উপস্থিত ছিলেন লেনিন , শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিলেন পরে লেনিন না কি তাঁর স্ত্রী ক্রুপস্কায়াকে বলেছিলেন :

If one cannot work for the party any longer, one must be able to look truth in the face and die like Lafargue’ .

লাফার্গের প্রতিদ্বন্দ্বী , স্পেনের নৈরাজ্যবাদী অনসেলেমো লরেঞ্জো লাফার্গের মৃত্যুর মধ্যে তাঁর  দ্বৈতস্বরূপের দ্বন্দ্বের কথা বলেছেন :

The double , original and , whatever the routine response , even sympathetic  suicide of Paul Lafargue and Laura Marx , who knew and could live united and lovers  until death , has awakened my memories. [ …..]  Lafargue was my teacher : his memory is for me almost important as that of Fanelli. [….] In Lafargue were two different aspects that made him appear in constant contradiction : affiliated to socialism , he was anarchist communist by intimate conviction ; but enemy of Bakunin , by suggestion of Marx , he tried to damage Anarchism. Due to that double way of being , he caused different effect in those that had relations with him : the simple ones were  comforted by his optimisms , but those touched by depressing passions changed friendship into hate and produced  personal issues , divisions and created organizations that , because of original vice , will always give bitter fruit’ .

এলেনর মার্কস (  ১৮৫৫-১৮৯৮)  // কার্ল মার্কসের মেয়ে

এলেনর কার্ল মার্কসের ষষ্ঠ সন্তান ও চতুর্থ কন্যা   তাঁর জন্ম লণ্ডনে তিনি মার্কসের প্রিয় টুসি চমৎকার ফুটফুটে মে্য়ে  গভীর কালো চোখ , মাথায় কালো চুলের গুচ্ছে সপ্রতিভ , সংবেদনশীল , যুক্তিবাদী সাহিত্য ভালোবাসেন , ভালোবাসেন সংগীত আর নাটক  ভালোবাসেন বাবার মুখে গল্প শুনতে শেক্সপীয়ার বলে যেতেন মুখস্থ তাই যেতেন ‘ডগবেরি ক্লাবে’

সেই সঙ্গে তাঁর রক্তে প্রবাহিত রাজনীতির চেতনা , সমাজতন্ত্রের প্রতি আগ্রহ ম্যাঞ্চেস্টার শহিদদের ফাঁসিতে তিনি উদ্বেলিত হন , ফেনিয়ানদের প্রতি জানান সহানুভূতি াত্র ষোল বছর বয়েসে তিনি তাঁর বাবার সহকারী হলেন বাবার সঙ্গে বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক সম্মেলনে যেতে শুরু করলেন এই সময়ে তিনি প্রেমে পড়লেন সাংবাদিক অলিভিয়ার লিসাগারের অলিভিয়ার অনেকাংশে মার্কসপন্থী।কিন্তু মেয়ের সঙ্গে লিসাগারের বিয়ের ব্যাপারে মার্কসের আপত্তি ছিল বয়েসের ব্যাপারে  , কারণ বয়েসে তিনি এলেনরের চেয়ে অনেকটাই বড় ছিলেন।

জোর করেন নি লিসাগার মার্কসের বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিলেন তিনি তারপরেও এলেনরের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল তাঁর এলেনর তাঁকে সাহায্য করেছিলেন প্যারি কমিউনের ইতিহাস লিখতে  পরে , ১৮৮০ সাল নাগাদ লিসাগার সম্পর্কে মত পরিবর্তন করেন কার্ল মার্কস , মেয়ের সঙ্গে তাঁর বিয়ে দিতে সম্মত হন ততদিনে অবশ্য এলেনর নিজেই তাঁর মত পরিবর্তন করেছিলেন লিসাগার সম্বন্ধে

১৮৮০ সালে মা-বাবা দুজনেই অসুস্থ এলেনরকে দেখাশুনো করতে হচ্ছে ১৮৮১ সালে মারা গেলেন মা এদিকে আবার ছোট্ট ভাগনে জিন লাংগুয়েট মাতৃহারা হয়েছে এলেনরকে তার যত্ন নিতে হচ্ছে জিনের মা মারা গেছেন মুত্রাশয়ের ক্যানসারে  বিপদের উপর বিপদ   ১৮৮৩ সালের মার্চ মাসে মারা গেলেন বাবা বাবার সেই বিখ্যাত বই ‘ডাস ক্যাপিটাল’ প্রকাশ করতে হবে ইংরেজি ভাষায় এঙ্গেলসের সঙ্গে এলেনর নেমে পড়লেন কাজে ১৮৮৪ সালে সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক ফেডারেশন নতুন করে গঠিত হয়েছে প্রথম থেকে তার সঙ্গে আছেন এলেনর বক্তৃতা দিচ্ছেন , কাগজে প্রবন্ধ লিখছেন , ধর্মঘট সংগঠিত করছেন , নির্বাচনের প্রচার করছেন

যখন তাঁর ২৭ বছর বয়েস তখন দেখা হল এডওয়ার্ড অ্যাভেলিংএর সঙ্গে  জীববিজ্ঞানের শিক্ষক , ডারউইনের শিষ্য , মুক্তচিন্তক অ্যাভেলিং দুজনের দেখা হল ব্রিটিশ মিউজিয়ামের রিডিং রুমে প্রথম দর্শনেই প্রেম দুজনে একসঙ্গে থাকতে শুরু করলেন এলেনর অ্যাভেলিংএর পরিচয় করিয়ে দিলেন তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মীদের সঙ্গে এলেনরের  ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ অ্যাভেলিং কিন্তু বিয়ে ? না , এখনই এলেনরকে বিয়ে করতে পারবেন না অ্যাভেলিং কারণ তিনি আগেই বিয়ে করেছেন , এখনও বিবাহ বিচ্ছেদ হয় নি বিবাহ বিচ্ছেদ না হওয়ার ব্যাপারটা আদপে মিথ্যে বিশ্বাস করে নিলেন এলেনর ততদিনে এলেনরের মন জয় করে নিয়েছেন অ্যাভেলিং  এলেনর দেখছেন সমাজতন্ত্রের প্রতি অ্যাভেলিংএর অনুরাগ মঞ্চে উঠে চমৎকার বক্তৃতা করেন তিনি , মন জয় করেন শ্রোতার , কথা শুনে চলেন এলেনরের এলেনর দেখেও যা দেখেন নি তা হল নারীর প্রতি অ্যাভেলিংএর আসক্তি , নিত্য নতুন পোশাকের প্রতি আসক্তি, ভালো খাদ্যদ্রব্যের প্রতি আসক্তি , অর্থের প্রতি আসক্তি

১৮৮৪ সালে এলেনর হেনরি হাইণ্ডন্ডম্যানের নেতৃত্বে সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক ফেডারেশনে যোগদান করলেন , কিন্তু পরের বছরে সেই সংগঠন থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি কারণ হাইণ্ডম্যানের স্বৈরাচারী কর্মপদ্ধতি এলেনর প্রতিষ্ঠা করলেন সোশ্যালিসট লিগ এই লিগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন  আর্নেস্ট বেলফোর্ট ব্যাক্স ,  স্যাম মাইনওয়ারিং , টম মান ,  লরা ও তাঁর স্বামী পল লাফার্গ , অ্যানি বেসান্ত এই লিগের মাসিকপত্রের নাম ‘কমনওয়েল’ এতে এলেনর যে নিয়মিত কলাম লিখতেন তার নাম ‘রেকর্ড অব দ্য রেভলিউশনারি ইন্টারন্যাশনাল মুভমেন্ট’

এলেনর ১৮৮৫ সালে প্যারিসে আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক কংগ্রেস গঠনে সাহায্য করেন ১৮৮৬ সালে তিনি অ্যাভেলিং ও লাইবনেখটের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন ১৮৮৭ সালের ১৩ নভেম্বর তিনি লণ্ডনে এক বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করেন এই সমাবেশ ‘রক্তাক্ত রবিবার’ নামে পরিচিত  পুলিশ নৃশংসভাবে এই বিক্ষোভ দমন করেছিল ১৮৯৩ সালে কেয়ার হার্ডি যে স্বাধীন লেবার পার্টি গঠন করেন, এলেনর ছিলেন তার পর্যবেক্ষক

রাজনৈতিক কাজকর্মের সঙ্গে এলেনর নাটকাভিনয়ের প্রতি আকৃষ্ট হন তাঁর মনে হয় সমাজতন্ত্র প্রচারের কাজে নাটক সহায়ক হতে পারে। ইবসেনের নাটক ইংরেজিতে অনুবাদ করার জন্য তিনি নরওয়েজিয়ান ভাষা শিক্ষা করেন

১৮৯৮ সাল এলেনর একদিন  আবিষ্কার করলেন যে তাঁর স্বামী এডওয়ার্ড অ্যাভেলিং একজন বিশ্বাসঘাতক এক তরুণ অভিনেত্রীর সঙ্গে তাঁর গোপন সম্পর্ক আছে হাইড্রোজেন সায়ানাইড ( প্রুসিক অ্যাসিড) খেয়ে আত্মহত্যা করেন এলেনর তখন তাঁর বয়েস মাত্র ৪৩

এডওয়ার্ড অ্যাভেলিং ( ১৮৪৯—১৮৯৮)   //   এলেনরের স্বামী ও কার্ল মার্কসের জামাই

এডওয়ার্ড অ্যাভেলিং লণ্ডনের স্টোক নিউইংটনে জন্মগ্রহণ করেন  তিনি হ্যারো স্কুলে পড়াশুনো করেন তারপর  লণ্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজে ডাক্তারি পড়েন কৃতী ছাত্র ছিলেন তিনি  স্নাতক হবার পরে তিনি লণ্ডন হাসপাতালে তুলনামূলক শারীরতত্ত্ব বিভাগে অধ্যাপক হন

চার্লস ডারউইনের  তত্ত্ব তাঁকে প্রভাবিত করে ফলে ধর্মবিশ্বাসের উপর  আস্থা হারান তিনি তিনি ‘সেকুলার সোসাইটি’তে যোগদান করেন  এবং চার্লস ব্রাডলাউ ও অ্যানি বেসান্তের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে  ব্র্যাডলাউএর ‘দ্য ন্যাশনাল রিফর্মার’ পত্রিকায় তিনি লিখতে শুরু করেন ১৮৮১ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর বই ‘ দ্য স্টুডেন্টস ডারউইন’ ঈশ্বরবিশ্বাস নিয়ে প্রকাশ্যে প্রশ্ন তোলায়  লণ্ডন হাসপাতাল থেকে তাঁকে বহিষ্কার করা হয়

অ্যানি বেসান্ত লক্ষ্য করেছিলেন যে কঠিন বিষয়কে সহজভাবে পরিবেশনের দক্ষতা আছে অ্যাভেলিংএর তাই তিনি বিভিন্ন স্থানে রবিবারে ধর্ম ও বিজ্ঞান নিয়ে বক্তৃতার আয়োজন করেন এবং  অ্যাভেলিংকে বক্তৃতা দিতে অনুপ্রাণিত করেন ‘হাউজ অব কমন্সে’র নির্বাচনে জেতার ব্যাপারে  ব্র্যাডলাউকে সাহায্য করেন

১৮৮১ সালে অ্যাভেলিংএর সঙ্গে চার্লস ডারউইনের সাক্ষাৎ হয় দীর্ঘক্ষণ তাঁরা ধর্ম ও বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা করেন সেই আলোচনা নিয়ে অ্যাভেলিং যে  বইটি লেখেন তার নাম ‘দ্য রিলিজিয়াস ভিউজ অব চার্লস ডারউইন’ এই বইতে তিনি দাবি কেন যে ডারউইন একজন নাস্তিক।

‘সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক  অস্যোসিয়েশনে’র নেতা ছিলেন এইচ.এইচ.হাইণ্ডম্যান তাঁর সঙ্গে অ্যাভেলিংএর পরিচয় করিয়ে দিলেন অ্যানি বেসান্ত ১৮৮২ সালে অ্যাভেলিং যখন লণ্ডন স্কুল বোর্ড নির্বাচনে দাঁড়ালেন , তখন  ‘সেকুলার সোসাইটি’ ও ‘সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক ফেডারেশন’ তাঁর হয়ে প্রচার করেন অ্যাভেলিং নির্বাচনে জয়লাভ করেন তবে ‘সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক ফেডারেশনে’র কিছু সদস্য প্রশ্ন তুলতে শুরু করেন  অ্যাভেলিংএর নৈতিকতা নিয়ে ১৮৭২ সালে তিনি বিয়ে করেছিলেন ইসাবেল ফ্রাঙ্ককে কিন্তু বহু নারীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিল তাঁর সম্পর্ক ছিল অ্যানি বেসান্ত ও এলেনর মার্কসের সঙ্গে এলেনরের সঙ্গে তিনি থাকতে শুরু করেন

অ্যাভেলিং ‘সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক ফেডারেশনে’র সদস্য হন কিন্তু হাইণ্ডম্যানের সঙ্গে তাঁর বিরোধ বাধে তাঁরই নেতৃত্বে  ফেডারেশনের কার্যকরী সমিতির সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য অনাস্থা প্রকাশ করেন হাইণ্ডম্যান সম্পর্কে হাইণ্ডম্যান পদত্যাগ করতে না চাইলে অ্যাভেলিং , উইলিয়াম নরিস , এলেনর মার্কস সেই সংগঠন থেকে বেরিয়ে এসে ‘সোশ্যালিস্ট লিগ’ নামে নতুন এক সংগঠন তৈরি করেন সংগঠনের মুখপত্র ‘’কমনউইল’এ লিখতে শুরু করেন অ্যাভেলিং ও তাঁর স্ত্রী এলেনর একই সঙ্গে অ্যাভেলিং ইংরেজিতে ‘দাস ক্যাপিটেল’ অনুবাদ করার ব্যাপারে সাহায্য করেন এলেনরকে ; দুজনে একসঙ্গে লেখেন ‘উওম্যান কোশ্চেন’  ১৮৮৬ সালে তাঁরা বেরিয়ে আসেন ‘সোশ্যালিস্ট লিগ’ থেকে তারপর তাঁরা ‘সোশ্যালিস্ট পার্টি অব আমেরিকার’ আমন্ত্রণে আমেরিকা যান এখানেও পার্টি নেতাদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় অ্যাভেলিংএর টাকা-পয়সা নিয়ে

লণ্ডনে ফিরে আসেন অ্যাভেলিং মার্কসবাদী শ্রমজীবী পার্টি গড়ার ব্যাপারে এঙ্গেলসের সঙ্গে যুক্ত হন কিন্তু এখানেওতিনি বেশিদিন টিকতে পারেন নি তারপর রাজনীতি সম্পর্কে মোহমুক্ত হয়ে তিনি শুরু করেন নাটক লিখতে তাঁর চারটে নাটকের কোনটাই আসর জমাতে পারে নি এলেনরের সঙ্গে তিনি ইবসেনের ‘ডলস হাউজ’ নাটক মঞ্চস্থ করেন

১৮৯৫ সালে অ্যাভেলিং কিডনির অসুখে দারুণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন এলেনর কয়েক মাস তাঁর সেবা শুশ্রূষা করে সুস্থ করে তোলেন সুস্থ হয়ে অ্যাভেলিং এলেনরকে পরিত্যাগ করে চলে যান ২২ বছরের  অভিনেত্রী  ইভা ফ্রের কাছে মাস কয়েক বাদে তিনি ফিরে আসেন এলেনরের কাছে প্রেমের টানে ফিরে আসেন নি , এসেছিলেন অর্থের প্রয়োজনে তখন দেনায় ডুবে আছেন তিনি এই সময়ে তিনি দেখলেনএঙ্গেলসের বেশ কিছু টাকা পেয়েছেন এলেনর তাই ফিরে আসা ১৮৯৮ সালে অ্যাভেলিং আবার অসুস্থ হয়ে পড়লেন আস্ত্রোপচার করতে হল সেবা করলেন এলেনর সুস্থ হয়েই নিজের রূপ ধারণ করলেন তিনি এলেনরকে জানিয়ে দিলেন যে তিনি ইভা ফ্রেকে বিয়ে করেছেন , তার কাছেই ফিরে যাচ্ছেন তিনি এই বিশ্বসঘাতকতা সহ্য করতে না পেরে এলেনর আত্মহত্যা করেন ১৮৯৮ সালের ৩১ মার্চ  অ্যাভেলিংএর মৃত্যু হয় ১৮৯৮ সালের ২ আগস্ট

ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস ( ১৮২০-১৮৯৫)  // কার্ল মার্কসের পরমাত্মীয়

রক্তের সঙ্গে যার সম্পর্ক আছে , তাকেই আমরা সাধারণত আত্মী্য় বলি ফ্রেডারিখ এঙ্গেলসের সঙ্গে মার্কসদের কোন রক্তের সম্পর্ক নেই  না থাকুক , তবু এঙ্গেলস কার্ল মার্কসের পরমাত্মীয় তিনি মার্কসের সবচেয়ে বড় বন্ধু বন্ধু কে ? রাজদ্বারে , শ্মশানে যে সঙ্গী হয় , সেই বন্ধু সবচেয়ে বড় বন্ধু তিনি , যিনি দুঃখের ভাগ নিতে পারেন , সাহায্যের হাত প্রসারিত করে দিতে পারেন ফ্রেডারিখ এঙ্গেলস শুধু কার্ল মার্কসের মতাদর্শের সমর্থক ছিলেন না , তিনি অর্থনৈতিকভাবেও নানা সময়ে সাহায্য করেছেন তাঁকে আবার শুধু কার্ল মার্কস নয় , তাঁর সন্তান-সন্ততিকেও নানাভাবে সাহায্য করেছেন

প্রাশিয়ার রাইন প্রদেশের বার্মেন শহরে জন্মগ্রহণ করেন এঙ্গেলস তাঁর বাবা ছিলেন এক কারখানার মালিক বার্মেনের বিদ্যালয়ে লেখাপড়া শুরু করেন এঙ্গেলস ১৮৩৪ সালে ভর্তি হন জিমনাসিয়ামে উচ্চশিক্ষা সমাপ্ত না করেই বাবার নির্দেশে এক সওদাগরি অফিসে কর্মচারী হিসেবে যোগ দেন তবে বাণিজ্যিক কাজকর্মের মধ্যেও তিনি বৈজ্ঞানিক ও রাজনৈতিক শিক্ষা অব্যাহত রেখেছিলেন

১৮৪২ সালে তাঁর সঙ্গে ‘রাইনিশে সাইতুং’ পত্রিকার যোগাযোগ হয় এই সময়ে তিনি ম্যাঞ্চেস্টারে শ্রমিকদের শোচনীয় অবস্থা লক্ষ্য করেন এই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে পরবর্তীকালে তিনি লেখেন ‘ইংল্যাণ্ডে শ্রমিকশ্রেণির অবস্থা’ বইটি ১৮৪৪ সালে প্যারিসে তাঁর সঙ্গে দেখা হয় কার্ল মার্কসের অবশ্য তার আগে চিঠিপত্রের মাধ্যমে দুজনের মধ্যে পরোক্ষ যোগাযোগ হয়েছিল তাঁরা দুজনেই ফরাসি সমাজতন্ত্রের দ্বারা প্রভাবিত হন দুই বন্ধু একত্রে লেখেন ‘পবিত্র পরিবার অথবা সমালোচনামূলক সমালোচনার সমালোচনা’ মার্কস ও রুগের ‘জার্মান –ফরাসি পত্রিকায়’  প্রকাশিত হয়েছিল ‘অর্থশাস্ত্র বিষয়ে সমালোচনামূলক নিবন্ধ’ এতে সমাজতন্ত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মূল ঘটনাগুলিকে দেখা হয় ব্যক্তি মালিকানার অনিবার্য পরিণাম হিসেবে

১৮৪৫ থেকে ১৮৪৭ পর্যন্ত এঙ্গেলস ব্রাসেলস ও প্যারিসে ছিলেন গুপ্ত জার্মান সমিতি ‘কমিউনিস্ট লিগে’র সঙ্গে কার্ল মার্কস ও এঙ্গেলসের যোগাযোগ হয় সমিতির সদস্যদের জন্য  সমাজতন্ত্রের মূলনীতি রচনার ভার দেওয়া হয় তাঁদেরএভাবেই জন্ম হয় ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’ বা ‘কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহারে’র   প্রকাশিত হয় ১৮৪৮ সালে

১৮৪৮ সালের যে বিপ্লব প্রথমে শুরু হয়েছিল ফ্রান্সে , তা পশ্চিম ইউরোপের অন্যান্য দেশেও বিস্তৃত হয় মার্কস-এঙ্গেলস দেশে ফেরেন   প্রাশিয়ার রাইন অঞ্চলে কলোন থেকে প্রকাশিত ‘নয়া রাইনিশে সাইতুং’ পত্রিকার পরিচালনা ভার গ্রহণ করেন তাঁরা সমস্ত বিপ্লবী –গণতান্ত্রিক প্রচেষ্টার প্রাণকেন্দ্র হয়ে ওঠেন তাঁরা কিন্তু শেষ পর্যন্ত জয়লাভ করে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি , ‘নয়া রাইনিশে সাইতুং’ নিষিদ্ধ হয় , মার্কসকে দেশান্তরী হতে হয় , এঙ্গেলস সশস্ত্র গণবিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেন এবং  বিদ্রোহীদের পরাজয়ের পরে তিনি সুইজারল্যাণ্ড হয়ে লণ্ডনে চলে যান

এঙ্গেলস লণ্ডনে এসে ম্যাঞ্চেস্টারের সেই সওদাগরি অফিসে কেরানির কাজ গ্রহণ করেন মার্কসের সঙ্গে চিঠিপত্রে তাঁর যোগাযোগ থাকে ১৮৭০ সালে এঙ্গেলস চলে আসেন লণ্ডনে মার্কসের কাজে তিনি যেমন সাহায্য করেন , তেমনি নিজেও একের পর এক রচনা করে যান ‘ডুরিংএর বিরুদ্ধে  তর্কমূলক রচনা’ , ‘পরিবার ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উদ্ভব’ , ‘লিউদভিগ ফয়েরবাখ’ , ‘বাসস্থান সমস্যা ‘ প্রভৃতি মার্কসের মৃত্যুর পরে ‘পুঁজি’র ২য় ও ৩য় খণ্ড গুছিয়ে তোলা ও প্রকাশের কাজে আত্মনিয়োগ করেন

জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সর্বহারার আন্তর্জাতিক ঐক্যের ব্যাপারে তিনি সজাগ ও সক্রিয় ছিলেন জার্মানির সোশ্যাল ডেমোক্রাটদের সুবিধাবাদী নীতির সমালোচনা করেছেন ,  ফরাসি শ্রমিক পার্টিকে সুসংহত করার চেষ্টা করেছেন , ইতালিতে মার্কসবাদের সাফল্যকে স্বাগত জানিয়েছেন ১৮৯৫ সালে তাঁর মৃত্যু হয়

(দিলীপ মজুমদার: সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক, সত‍্যবাণীর কলকাতা কন্ট্রিবিউটিং কলামিষ্ট)

You might also like