গানাপার রাজ‍্যের রাজপুত জুবিন

 সুশান্ত দাস

কানাডার সেন্ট ক‍্যালিক্সটে আকাশ তখন নীলাভ। কোমল কিরণ,শেষ বিকেলের একপ্রান্তে হেলানো সূর্য। শরৎ শরমে ম‍্যাপল পাতাগুলো যেনো লজ্জায় লালবর্ণ। পাহাড় সদৃশ‍্য,উঁচু,নীচু,সর্পিলাকার রাস্তায় গাড়ি দৌড়াচ্ছে। ভরা আকাশে ধবল মেঘরা তুড়ি মারছে। শির শির সমীরনে শরতের ঘনঘটায় ম‍্যাপল গাছের ডালগুলো দোলছে। এরমাঝে মেসেঞ্জার নামক বার্তাবাহকে ভিডিও কল। জানতে চাইলে কেমন আছো কানে বাজে ভারী কন্ঠ। কথাধরে আরেকটু আগালে বুঝতে পারলাম আবেগে আপ্লুত। যেনো শোকের মাতমের ছোঁয়া। শিশু শ্রীপান্থ সহ বাসার বয়স্ক,যুবা সকল। বিষয় আসামের হৃদস্পন্দন, সুরের রাজপুত শিল্পী সংগ্রামী জুবিনের চিরবিদায়। ষাটোর্ধ্ব অসমীয়া বাঙালি কল্পনা রানী তো বলেই ফেলেছেন; কোন মোবাইল,রেডিও টিভি চ‍্যানেলে হাত দেওয়া যাচ্ছিল না, জুবিন বিহীন সেদিনের পুরো আসাম আকাশটা নাকি শোকে ভারি লাগছিল। ভাবতেও কষ্ট হচ্ছে, গানাপারের ছেলে; শিল্পী জুবিনের জীবন যবনিকা।

(২) শিল্পী জুবিন’র নাম শোনা, গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূপেন হাজারিরকার সমাধি দেখতে অসমীয়া বাঙালি কন‍্যা টিংকু দাস ফাল্গুনী হতে। আসামের শিল্পী সংস্কৃতি সম্পর্কে কথা উঠতে আকাশ সম ভূপেন হাজারিকার নাম বলতেই তাঁর মুখে জুবিনের নাম আসে। তখনো নামটির এতো গভীরতার সাথে পরিচিতি হয়ে ওঠেনি; এককথায় বুঝে ওঠতে পারিনি। অতঃপর; সেদিন উনিশ সেপ্টেম্বর সংস্কৃতি প্রেমী,সিলেট সরকারি কলেজের ছাত্র এল্টন সরকার’র যখন সামাজিক ফ্লাটফর্ম ফেইসবুক লাইভ চোখে পড়লো, জুবিন গার্গ চলে যাওয়ার শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন; তখন উক্ত অসমীয় বাঙালি কন‍্যাকে প্রশ্ন করতে দেখি, শোকের আবহে দলদলে। বুঝি তার ভাব ব‍্যক্ত করতে অশ্রুসিক্ত চোখের পাতা বলছে “বুঝে না সে, বুঝে না; সে তো আজো, বুঝে না;
কাঁদে মনের কথা, প্রেম কি শুধু ব‍্যাথা;
উত্তর আজো মেলেনা ; মেলেনা, মেলেনা মেলেনা॥ আসলে মেলার কথাও নয়; এ তো; উচ্চমানের হিসাব!! এ ধরনের প্রেমাবেগ,প্রান্তিক জনমানুষের ভাবাবেগ,মানুষকে জাগানোর, শানিত করার এমনকি সমাজ রক্ষক হতে রাষ্ট্রের ক্ষমতাধরদের ঠেঙ্গানোর অসামান‍্য সুরের ক্ষমতা ছিল আসামের এই সাংস্কৃতিক অহংকার অমূল‍্য রতনের। তাঁর মূল নাম জুবিন বরঠাকুর। শ্রদ্ধার্ঘ্যস্বরূপ ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রসিদ্ধ গীতিকার জুবিন মেহেতার নামকরনে ও পারিবারিক গোত্রের আলোকে, ডাকনাম গ’ল্ডি হতে জুবিন গার্গ নামে পরিচিতি অর্জন করেন।

(৩) জুবিনের জন্ম ১৮ নভেম্বর ১৯৭২। জুবিনের পরিবার শিবসাগরের জাঁজীর স্থায়ী বাসিন্দা। মেঘালয়ের তুরা শহরে জুবিনের জন্ম। তার পর আসামের জোরহাটে পরিবার-সহ চলে যাওয়া। বাবার চাকুরি সূত্রে থাকতে হয়েছে বিভিন্ন জায়গায়। বাবা মোহিনী বরঠাকুর পেশায় ছিলেন সরকারি আমলা। ছিলেন সাহিত‍্য সংস্কৃতির সাথে জড়িত। মা ইলি বরঠাকুর ছিলেন সংগীত জগতের। মা-বাবা দু’জনেই সঙ্গীতজগতের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে শৈশব থেকেই সঙ্গীত আবহে বেড়ে ওঠেন। দুই বোন পালমী বরঠাকুর ও জংকী বরঠাকুর। বোন জংকি বরঠাকুরও ছিলেন একজন গায়িকা ও অভিনেত্রী। তাঁর স্ত্রী গরিমা শইকীয়া একজন ফ‍্যাশন ডিজাইনার।
মায়ের কাছে প্রথম সংগীতের হাতেখড়ি। তিন বছর বয়স হতে শুরু করেন সংগীত চর্চা। আসামের একটি স্কুল থেকে পড়াশোনা শেষ করে বিজ্ঞানে স্নাতক নেওয়ার জন্য আসামের একটি কলেজে ভর্তি হন জ়ুবিন। কিন্তু গানে যার প্রাণ, চিন্তায় মগজে যার গান বিজ্ঞানে স্নাতক তো দূরের কথা, মাঝপথে ছেড়ে দেন এই একাডেমিক পড়াশোনা। আর একাডেমিক পড়াশোনায় ছাড়লেও হয়তো “গানে মিলে প্রাণের সন্ধান” এমন দীক্ষায় দিক্ষিত হয়ে দীর্ঘ পথ সাধনা করেন তবলায়। তাছাড়াও গিটার, ড্রাম, হারমোনিয়াম-সহ মোট ১২ধরনের বাদ্যযন্ত্র-বাজনা শিখেন। তবে পড়াশোনায় একাডেমিক সার্টিফিকেট উপার্জন করতে না পারলেও ২০২৪ সালে মেঘালয়ের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় হতে ডক্টর অফ লিটারেচার (ডি. লিট) ডিগ্রি পেয়ে সম্মানে ভূষিত হন।

(৪) সময় ১৯৯২ সাল। অনুষ্ঠিত যুব মহোৎসব পাশ্চাত্য একক পরিবেশনায় স্বর্ণপদক লাভ করেন জুবিন। পাল্টে যায় জীবনের মোড়। ঘটে অসমিয়া অ্যালবাম ‘অনামিকা’ র মুক্তি। এর মাধ্যমে জুবিন’র পেশাদার সংগীতজগতে প্রবেশ। তিন বছর আসামে থাকার পর ১৯৯৫ সালে পাড়ি জমান মোম্বাই। সঙ্গীতজীবনকে করে তোলেন আরো চাঙ্গা। সেখানে প্রথম “চাঁদনি রাত” নামে প্রকাশ করেন অ‍্যালবাম। অতঃপর,একের পর এক কাজ করতে থাকলে,আসতে থাকে সাফল্য। ২০০০ সালের মধ্যে আসামের মানুষের অন্যতম প্রিয়-শিল্পী হিসেবে গড়ে তোলেন জায়গা।
এমনই ভাবে শীর্ষে কাজ করতে গিয়ে ২০০৬ সালে অনুরাগ বসুর ‘গ্যাংস্টার’ সিনেমার ‘ইয়া আলী’ গানে কণ্ঠ দিয়ে দর্শকমহলে তোলপাড় তোলেছেন। আবার অনেকে কাজ পায় না, আর উনি কাজ পেয়ে
পছন্দ না হলে তাবড় তাবড় সংগীত পরিচালক ও চলচ্চিত্র নির্মাতাদের ডাক ফিরিয়ে দিয়ে আলোড়ন করেছেন। এমনকি রোহিত শেঠীর মতো সিনেমা নির্মাতার গান করতেও প্রত‍্যাখান করেছেন ।
দেখা যায় গানে তাঁর নিজস্বতা ধরে রেখে, সাধুতার সহিত গানকে হৃদয়াঙ্গমের মাধ‍্যমে দর্শকের হৃদয়ে জায়গা করতে পেরেছেন। তাঁর কণ্ঠে যেমন ছিল আঞ্চলিকতার মাটির গন্ধ, তেমনি ছিল আধুনিকতাও বটে ।
(৫) গুয়াহাটিতে থাকতেন গায়ক। গাড়ি ও মোটর বাইকের প্রতি বিশেষ ঝোঁক ছিল শিল্পীর । মার্সিডিজ় বেঞ্জ, রেঞ্জ রোভার-সহ বড় সম্ভার ছিল তাঁর। বরাবরই রোমাঞ্চ পছন্দ করতেন তিনি। গুয়াাহাটির অন‍্যতম ব‍্যবসা প্রতিষ্ঠানের (অটোমোবাইল গ্লাস সেটিং) বাপ্পী বলেন আমাদের ওখানে উনার কাজে আসতেন শিল্পী জুবিন। আমি একজন তাঁর ভক্ত। গুয়াহাটি শহরে যতো প্রোগ্রাম হতো কাজের ফাঁক পাইলেই যেতাম; বিহুর প্রোগ্রাম হলে তো আর মিস নেই। যতোটুকু দেখতাম তারুন‍্যের ভরপুরে রসিক মানুষ ছিলেন। সঙ্গে সব সময় বন্ধু- বান্ধব থাকতো। শুনেছি রাতে বাসা হতে বাহির হলে আমাদের পাশের শ্মশান মন্দিরে রাতের শেষ সময়টা শেষ করে যেতেন। উনি মঞ্চের দর্শককে যেমন ভালোবাসতেন তেমন শ্মশান মন্দিরের চন্ডাল হতে রাস্তার পাগলকেও ভালবাসতেন।

(৬) দানধ্যানের পাশাপাশি নানা ধরনের সমাজসেবার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন জ়ুবিন।কোভিড করালঘ্রাসে বিশ্ব যখন স্তম্ভিত,দেশ যখন নিমজ্জিত তখন শিল্পী জ়ুবিনের অচেনা রূপ দেখেছিল তাঁর এলাকাবাসী। কোভিডের সময় আক্রান্তদের জন্য নিজের বাড়ির দরজা খুলে দিয়েছিলেন। তিনি সমাজে শ্রেণিবিভাজন কিংবা জাতিবিভাজনের বিরোধী ছিলেন। নিজে ব্রাহ্মণ হয়েও রীতির বিরুদ্ধে গিয়ে পৈতা খুলে রেখেছিলেন। রাজনীতি সচেতন, সাম‍্যের অনুসারী, প্রথা ভাঙার মানুষ ছিলেন। আর নিজেকে মানুষ ভাবতেন বলেই হয়তো বলতে পারছিলেন “আমার কোন জাতি নেই, আমার কোন ধর্ম নেই, আমার কোন ভগবান নেই, আমি মুক্ত”। একটা টিভি চ‍্যানেল ইন্টারভিউ দিতে বলেছিলেন, তিনি একজন বামপন্থী; বাম রাজনীতির সমর্থক। তিনি এনআরসি,সিএএ-র ঘোর বিরোধী ছিলেন। তিনি ডিটেনশন ক্যাম্পগুলিতে গিয়ে নিপীড়িত মানুষের পক্ষে কথা বলছিলেন। তিনি সস্তাদরের রাজনীতি পছন্দ করেন না। বিজেপি- কংগ্রেস প্রয়োজন বোধ করেন না, বরং বিশ্বাস করেন সব শিল্পীরাই সাম‍্যের রাজনীতি করা উচিৎ । আর সস্তাদরের রাজনীতিকে ধরতেই, হয়তো সুরের লহরী তোলতেন-
“রাজনীতি করিবনা বন্ধু
ডাল ভাত খেটে খাই
জাতি,মাটির গান গাই
রাজনীতি করিবনা বন্ধু॥
সরকার(মন্ত্রী,এমএল,এ) সব পাপড়ের মতো
পাপড় দেখতে খাদ‍্য, কিন্তু পাপড় শুধু শব্দ ;
ক্ষমতার জোয়ারে,আমরা আছি মুগ্ধ
জাগ্রত জনতাকে, করে দিক ভ্রষ্ট “

(৭) জুবিন গার্গ’ ফোক গানে ছিলেন আন্তরিক। দীর্ঘদিন করেছেন অনুশীলন। ফোক গান শিখেছেন রমনী রায় নামক একজন গুরুর কাছে। জুবিন তিন দশকের বেশি সময় ধরে গান করেছেন। অসমিয়া ভাষা সহ প্রায় ৪০টির মতো নানান ভাষা,উপভাষায় ৩৮ হাজারের বেশি গান গেয়েছেন। তিনি একাধারে গায়ক হিসেবে যেমন পরিচিতি অর্জন করেছেন তেমনি সঙ্গীত পরিচালক, সুরকার, গীতিকার, সঙ্গীত প্রযোজক, অভিনেতা, চলচ্চিত্র পরিচালক, চলচ্চিত্র নির্মাতা, স্ক্রিপ্ট লেখক এবং সমাজসেবী হিসেবেও পরিচিতি অর্জন করেন। তিনি বহু মাত্রিক প্রতিভাধর ছিলেন। এতই কাজ পাগল ছিলেন যে একবার ডুব্রিগড় এয়ারপোর্টে আকাশচুম্বি ভূপেন হাজারিকা বলতে বাধ‍্য হয়েছিলেন প্রায় এ-রকম “ জুবিন তুমি খুব বেশি কাজ করছো,কাজের চাপে ক্লান্ত হয়ে যাবে, ক্লান্তি ধরে ফেলবে,মনে রেখো আমার কথা”। ৫২ বছর বয়সী জুবিন শুধু একজন গায়ক নন, তিনি হয়ে উঠেছিলেন আসামের সাংস্কৃতিক অহংকার, যিনি তাঁর গানাপার রাজ্যকে পৌঁছে দিয়েছিলেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মঞ্চে।

(৮)
জুবিন শোকাবহ এ ঘটনাকে ‘লিমকা বুক অব রেকর্ডস’-বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম জনসমাবেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। শোকের আচ্ছাদনে নেট দুনিয়া।
সাতসকালে উঠে যখন দেখি ঐ লজ্জায় লাল বর্ণ পাতাগুলো কুয়াশায় ভিজে, নীচে পড়ে গড়াগড়ি করছে তখন ভাবি পাতাগুলোও যেন শোকের চাদরে কোঁকড়ানো! শীতল সমীরণ শোকে ঝা ! ঝা!
তুড়িমারা মেঘগুলো বুঝলাম অশ্রুর ন‍্যায় ম‍্যাপল পাতা বেয়ে ঝড়ছে। নীলাভও আকাশটাও তার শ্রী হারিয়ে যেন শোকের মাতমে কান পাতাচ্ছে। যেন দুখের মলিনে প্রকৃতি পরিবেশও একাকার। আজ জুবিন হীন আসাম। আসাম তাঁর জন্ম জায়গা।
জুবিন আসামে জন্মেছেন সত‍্যি তারচেয়ে মহাসত‍্যি ৪০টি ভাষায় গান করেছেন, তাই তিনি ৪০ ধরনের ভাষাভাষী মানুষের কাছে জায়গা পেয়েছেন। তাইতো শিল্পী জুবিন শুধু মেঘালয়-আসাম কিংবা ভারত-বাংলার, এপার -ওপারের নয়,তিনি গানাপারের জুবিন। গানাপার রাজ‍্যের রাজপুত জুবিন।

সুশান্ত দাস: লেখক, সাংবাদিক।

You might also like