জে টি সান্ডারল্যাণ্ড : এক বিদেশি ভারত প্রেমিক
দিলীপ মজুমদার
জন্মসূত্রে জে টি সান্ডারল্যাণ্ড ইংরেজ একজন। ইংল্যাণ্ডের ইয়র্কশায়ারে ১৮৪২ সালে তাঁর জন্ম। কিন্তু অর্থনৈতিক কারণে ১৮৪৪ সালে তাঁর পরিবার চলে আসেন আমেরিকায়। পড়াশুনো করেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারপর সেখানকার ব্যাপটিস্ট ইউনিয়ন থিওলজিকাল সেমিনারি থেকে লাভ করেন ব্যাচেলার অব ডিভিনিটি ডিগ্রি।ব্যাপটিস্ট সম্প্রদায়ের যাজক রূপে শুরু করেন কর্মজীবন। পরে তিনি একেশ্বর বিশ্বাসভিত্তিক ইউনিটারিয়েন মতবাদে দীক্ষিত হন।
ইউনিটারিয়ান সমিতির কাজ নিয়ে সাণ্ডারল্যাণ্ড ভারতে আসেন ১৮৯৫ সালে। তিনি কলকাতায় ছিলেন দশ দিন। এখানে তিনি ব্রাহ্ম সমাজের নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও আলোচনা করেন। ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের নেতাদের সঙ্গেও তাঁর আলোচনা হয়। শুধু বাংলা নয় , দেশের অন্যান্য স্থানেও ভ্রমণ করেন তিনি। এ দেশের নানা পত্র–পত্রিকা পাঠ করেন নিবিড় ভাবে। ভারত সম্পর্কে তাঁর আগেকার মনোভাব পরিবর্তিত হয়। আমেরিকা ফিরে গিয়ে তিনি ভারত সম্পর্কে যে দুটি প্রবন্ধ লেখেন তা হল : The Causes of Famine in India ও The New Nationalist Movement in India . সাণ্ডারল্যাণ্ড লিখেছেন যে, ভারতে আসার আগে তিনি ভারতের প্রকৃত অবস্থা জানার জন্য উদগ্রীব ছিলেন। কিন্তু তা জানার জন্য যে সব বই তিনি দেখতে পান তা ব্রিটিশ লেখকদের লেখা, যাতে প্রতিফলিত তাদেরই দৃষ্টিভঙ্গি। ভারতে এসে তিনি সত্যিকারের ভারতকে চিনলেন, জানলেন ব্রিটিশ শাসন ও শোষণে ভারত কি রকম জর্জরিত।
১৯১৩ সালে সাণ্ডারল্যাণ্ড দ্বিতীয়বার ভারত ভ্রমণে আসেন। এবার তিনি প্রায় ১৩০০ মাইল ঘুরেছিলেন। তখন শুধু শহর নয়, সুদূর গ্রামাঞ্চলেও গিয়েছিলেন তিনি। পরিচিত হন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, জগদীশ চন্দ্র বসু প্রমুখের সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেও হয় পরোক্ষ যোগাযোগ। যোগ দেন ইণ্ডিয়ান ন্যাশনাল সোশাল কনফারেন্সে। ভারতকে ভালোবাসেন তিনি। নিজে ইংরেজ হয়েও ভারতে ইংরেজের অত্যাচারের প্রতিবাদ করতে শুরু করেন, ভারতের স্বাধীনতার জন্য কলম ধরেন। জন এইচ হোমস তাই বলেছেন যে, সাণ্ডারল্যাণ্ডের পরবর্তী জীবনের প্রধান লক্ষ্য বাইবেল বা ইউনিটারিয়ানিজম ছিল না, ছিল পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে ভারতবাসীর মুক্তি।
১৯২৮ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয় সাণ্ডারল্যাণ্ডের বই‘ ইণ্ডিয়া ইন বণ্ডেজ: হার রাইট টু ফ্রিডাম’। বইটির প্রকাশক ‘প্রবাসী’ ও ‘মর্ডান রিভিউ’র বিখ্যাত সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। বইটির বিভিন্ন অধ্যায়ের শিরোনাম তুলে ধরলেই লেখকের উদ্দেশ্য ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় স্পষ্ট হয়ে উঠবে:
ভারতভ্রমণ : ব্রিটিশ শাসনের রূপ, পরাধীন ভারত সম্পর্কে আমেরিকার বিখ্যাত লোকেরা কি বলেন, অন্যদেশ যদি স্বাধীন হয় তাহলে ভারত কেন স্বাধীনতা পাবে না? ভারতের মঙ্গলের জন্যই কি ব্রিটিশ ভারত শাসন করছে, ব্রিটিশের ঔদ্ধত্য ও ভারতের অবমাননা, বাবু ইংলিশ—রুডইয়ার্ড কিপলিং—অপমান, ব্রিটেন ভারতকে যে ধরনের সুবিচার দেয়, ব্রিটেন ভারতকে যে ধরনের শান্তি দিয়েছে, ভারতের আফিং অভিশাপের জন্য দায়ী কারা?, ভারতের মদ্যাসক্তির জন্য দায়ী কারা?, বিদেশি শাসন ভারতকে কিভাবে হীনবির্য করেছে , এক মহৎ জাতির মহৎ ঐতিহ্যের বিনষ্টি, কেন জাপান ভারতের চেয়ে এগিয়ে আছে, ভারতের গণতন্ত্র ও প্রজাতন্ত্র, ভারতের জাতিভেদ কি স্বায়ত্ব শাসনের প্রতিবন্ধক?, ভারতের নিরক্ষরতা কি স্বায়ত্ব শাসনের প্রতিবন্ধক?, ভারতের নানা জাতি ও ভাষা কি স্বায়ত্ব শাসনের প্রতিবন্ধক, ভারতের সামাজিক ব্যাধি কি স্বায়ত্ব শাসনের প্রতিবন্ধক, হিন্দু মুসলমানের দাঙ্গা কি স্বায়ত্ব শাসনের প্রতিবন্ধক, ব্রিটিশ ভারত ত্যাগ করলে কি ভারতে রক্তপাত শুরু হবে?, কোন ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা কি ব্রিটিশ ভারতকে দিয়েছে? ভারত স্বাধীন হলে আত্মরক্ষা করতে সক্ষম হবে কি, ব্রিটিশ বা অন্য কোন বিদেশি জাতি কি ভারত শাসনের যোগ্য ? মোগল শাসনের সঙ্গে ব্রিটিশ শাসনের তুলনা, ভারতের ব্রিটিশ শাসন কি যোগ্যতা সম্পন্ন, ভারতবাসী কি নিজেরা নিজেদের শাসন করার উপযুক্ত, ব্রিটিশ পার্লামেন্ট কিভাবে ক্ষুণ্ণ করছে ভারতের স্বার্থ?, জালিয়ানওয়ালা বাগের হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত সত্য , কেন ভারত প্রত্যাখ্যান করল দ্বৈত শাসন, স্বায়ত্ব শাসনের জন্য ভারতকে শিক্ষিত করার ব্রিটিশ দাবি আসলে এক বিরাট প্রবঞ্চনা, ভারতকে পবিত্র ট্রাস্ট বলে ব্রিটেনের দাবি এক বিখ্যাত প্রহসন, শৃঙ্খলিত ভারত কিভাবে ইংল্যাণ্ডকে আঘাত করছে, শৃঙ্খলিত ভারত কিভাবে সমগ্র পৃথিবীর বিপদের কারণ ইত্যাদি।
সাণ্ডারল্যাণ্ডের বইটি এদেশে খুব জনপ্রিয় হয়েছিলো। মাত্র ২ মাসের মধ্যে ১২০০ কপি বিক্রি হয়ে যায়। ১৯২৯ সালের এপ্রিল মাসের মধ্যে প্রথম সংস্করণ নিঃশেষিত হয়। দ্বিতীয় সংস্করণের সময় টনক নড়ে ইংরেজ শাসকের। ১৯২৯ সালের ২৪ মে ‘প্রবাসী’ পত্রিকার অফিসে খানাতল্লাশি হয় । অভিযুক্ত হন প্রকাশক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ও মুদ্রাকর সজনীকান্ত দাস ।
এই বই শুধু ভারতে নয়, ইউরোপ আমেরিকাতেও সাম্রাজ্যবাদীদের ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। আমেরিকার কোন প্রকাশক এই বই প্রকাশ করতে রাজি হননি। সাণ্ডারল্যাণ্ড ১৪ জন প্রকাশের দ্বারস্থ হয়ে ব্যর্থ হয়েছিলেন। শেষে একজন প্রকাশক রাজি হলেও সাণ্ডারল্যাণ্ডকে ৬ হাজার ডলার দিতে হয়। বইটির কোন বিজ্ঞাপন দিতেও রাজি হন নি প্রকাশক। সাণ্ডারল্যাণ্ড নিজের খরচে সেই বই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের গ্রন্থাগারে পাঠান।
‘রামানন্দ ও অর্ধ শতাব্দীর বাংলা’ বইতে রামানন্দের কন্যা শান্তাদেবী লিখেছেন:
“রামানন্দ বলতেন, ভারতের বাহিরে কোন দেশে ডাঃ জে টি সাণ্ডারল্যাণ্ড অপেক্ষা বড় ভারতসুহৃদ কেউ ছিলেন না। কোন বিদেশি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ভারতকে এমন করে ভালোবাসেন নাই এবং ভারতরহিত চেষ্টায় এমন অক্লান্ত পরিশ্রম করেন নাই।”
(দিলীপ মজুমদার: সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক, সত্যবাণীর কলকাতা কন্ট্রিবিউটিং কলামিষ্ট)
(জে টি সাণ্ডারল্যাণ্ডের জীবন ও তাঁর ‘ইণ্ডিয়া ইন বণ্ডেজ’ সম্পর্কে পাঠকের কৌতূহল থাকলে তাঁরা এই দুটি বই দেখতে পারেন: জে টি সাণ্ডারল্যাণ্ড ও ইণ্ডিয়া ইন বণ্ডেজ-ড. দিলীপ মজুমদার / ইউনিক বুক সেন্টার J T Sunderland’s India in Bondage / edited by Dr. Dilip Majumdar / Unique Book Centre )