অবহেলা না অনিচ্ছা? ৩ দশকেও সিলেটে স্থাপন হয়নি রেল’র বিভাগীয় দপ্তর

সিলেট অফিস 
সত্যবাণী
চট্টগ্রাম থেকে আলাদা করে সিলেট বিভাগ প্রতিষ্ঠার ৩ দশক ইতোমধ্যে পূর্ণ হয়েছে। সিলেটে স্থাপন করা হয়েছে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়-অধিদপ্তরের বিভাগীয় দপ্তরও। প্রশাসনিকভাবে বিভাগ প্রতিষ্ঠার এতদিন পরেও সিলেটে বাংলাদেশ রেলওয়ের বিভাগীয় দপ্তর স্থাপন করা হয়নি। সিলেট অঞ্চলে রেলওয়ের কার্যক্রম সেই পুরনো নিয়ম অনুযায়ী চট্টগ্রামের অধীনেই চলছে। শুধুমাত্র বিভাগীয় দপ্তর না থাকায় সিলেটে রেলের পরিষেবা পুরোপুরি চট্টগ্রাম দপ্তর থেকেই নিয়ন্ত্রণ হয়ে আসছে। সিলেটে রেলওয়ের বিভাগীয় দপ্তর স্থাপন না হওয়ায় কাঙ্খিত সেবা মিলছে না। ব্যাহত হচ্ছে রেলের স্বাভাবিক কার্যক্রমও। রেলওয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারি ও যাত্রী সাধারণের সাথে কথা বলে সিলেটে রেলওয়ের এমন দুর্দশার চিত্র পাওয়া গেছে।
এক অনুসন্ধানে জানা গেছে, বর্তমানে সিলেট-ঢাকা-সিলেট রুটে আন্তঃনগর ট্রেন কালনী এক্সপ্রেস, জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস, পারাবত এক্সপ্রেস ও উপবন এক্সপ্রেস নিয়মিত যাত্রীসেবা দিয়ে আসছে। এছাড়াও সুরমা মেইল নামের একটি মেইল ট্রেনও চলাচল করছে। আর সিলেট-চট্টগ্রাম-সিলেট রুটে নিয়মিত চলাচল করছে আন্তঃনগর ট্রেন পাহাড়িকা এক্সপ্রেস ও উদয়ন এক্সপ্রেস। সিলেট-ঢাকা ও সিলেট-চট্টগ্রাম রুটে এ সকল ট্রেন সিলেট, মোগলাবাজার, মাইজগাঁও, বরমচাল, কুলাউড়া, লংলা, শমসেরনগর, ভানুগাছ, শ্রীমঙ্গল, রশিদপুর, সাতগাঁও, শায়েস্তাগঞ্জ, শাহজিবাজার, নোয়াপাড়া, মনতলা, হরষপুর রেলওয়ে স্টেশনে যাত্রা বিরতি করে থাকে।
এর বাইরে সিলেট-ছাতক রুটে নিয়মিত ট্রেন চলাচল থাকলেও ২০২২ সালের ভয়াবহ বন্যায় রেললাইন নষ্ট হওয়ার পর থেকে রেল চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ আছে। সিলেট বিভাগের এ সকল এলাকায় রেলওয়ের স্থাপনা, বহু জায়গা-জমিও রয়েছে। সিলেট রেলওয়ে স্টেশনসহ এ সকল স্টেশনে স্টেশন ম্যানেজার, প্রকৌশলীগণসহ কর্মকর্তা-কর্মচারিরাও বসবাস করছেন। সিলেট অঞ্চলে রেলওয়ের বিশাল কর্মযজ্ঞ থাকলেও তাদের বিভাগীয় দপ্তর আজও স্থাপন করেনি বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, ১৯৯৫ সালে চট্টগ্রাম বিভাগ থেকে পৃথক করে সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলা নিয়ে প্রশাসনিকভাবে সিলেট বিভাগ প্রতিষ্ঠা করে সরকার। এরপর সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সকল মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর সিলেটে তাদের বিভাগীয় দপ্তর স্থাপন করে। কিন্তু সিলেট বিভাগ প্রতিষ্ঠার ৩ দশক পূর্ণ হলেও রেলওয়ে তার সেই পুরনো নিয়মানুযায়ী চট্টগ্রামের অধীনেই চলছে। বর্তমানে সিলেট অঞ্চলের কোথাও রেলওয়ের কোনো সমস্যা হলে তার সমাধানের জন্যে সংশ্লিষ্ট ম্যানেজারকে চট্টগ্রামস্থ রেলওয়ে দপ্তরের নিকট পত্র দিয়ে বিষয়টি অবগত করতে হয়। এমন কি যদি সিলেটে রেলওয়ের একটি নাট-বল্টুও নষ্ট হয়ে যায়, তাহলেও ওই একটি নাট-বল্টুর জন্যেও দ্বারস্থ হতে হয় চট্টগ্রাম দপ্তরের। আর এভাবেই পর্যাপ্ত জনবল, ইঞ্জিন আর কোচ থাকার পরেও সিলেটের লোকজন রেলওয়ের কাঙ্খিত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ের এক কর্মকর্তা জানান, সিলেটে রেলওয়ের বিভাগীয় দপ্তর স্থাপন করা হলে সিলেটেই থাকবে পর্যাপ্ত কোচ ও ইঞ্জিন। তখন বিভাগীয় কর্মকর্তা যাত্রীদের চাহিদার কথা বিবেচনা করে যে কোনদিন কোচের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে পারবেন। আবার কোনো ইঞ্জিন হঠাৎ নষ্ট হয়ে গেলেও এর প্রভাব পড়বে না কারণ তখন পর্যাপ্ত ইঞ্জিনও রিজার্ভ থাকবে। বিভাগীয় দপ্তরে বিভাগীয় ম্যানেজার, ডেপুটি ম্যানেজার, প্রকৌশলীসহ আরও গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের পদায়ন হবে। তখন তারা সরাসরি রেলওয়ের প্রধান দপ্তর থেকে নিয়ন্ত্রিত হবেন। যা বর্তমানে নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে চট্টগ্রাম থেকে। চট্টগ্রামের কতিপয় কর্মকর্তা নিয়মিত বখরার লোভে সিলেট অঞ্চলের রেলওয়েতেও থাবা বসান বলে সূত্রটি জানিয়েছে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে ইচ্ছা থাকাস্বত্বেও যাত্রীদের পুরোপুরি সেবা দেয়া সম্ভব হয় না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিলেটে রেলওয়ের ইতিহাস বহু পুরনো। আজ থেকে ১৩৩ বছর আগে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার ১৮৯১ সালে আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানি কর্তৃক বাংলার পূর্বদিকে রেলপথ নির্মাণের কাজ শুরু করে। আসামের সিলেট জেলার কুলাউড়া হতে সিলেট পর্যন্ত রেলপথ স্থাপন করে এবং সিলেটে রেলওয়ে স্টেশন চালু হয়।
এদিকে, সিলেট বিভাগ প্রতিষ্ঠার ৩ দশকেও সিলেটে রেলওয়ের বিভাগীয় দপ্তর স্থাপন না হওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন-এর সিলেট বিভাগীয় সমন্বয়ক ফারুক মাহমুদ চৌধুরী। গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, স্বাভাবিকভাবেই যখন একটা কিছু প্রতিষ্ঠা করা হয়, তখন ওই এলাকায় এর বিভাগীয় দপ্তরও স্থাপন করা হয়। এটিই নিয়ম। দাপ্তরিক কার্যক্রম শক্তিশালী করে জনসাধারণকে কাঙ্খিত সেবা দিতেই বিভাগ প্রতিষ্ঠা। সিলেট বিভাগ প্রতিষ্ঠার ৩ দশকেও রেলওয়ের বিভাগীয় দপ্তর স্থাপন না হওয়াটা নিঃসন্দেহে চরম লজ্জার বিষয়। রেলওয়েতে সিলেট অঞ্চল কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ এটি এর একটি বড় উদাহরণ। বিভাগীয় দপ্তর না থাকলে এখানে পর্যাপ্ত সেবাও প্রত্যাশা করা বোকামি। কারণ তখন কেবল কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারি রুটিন অনুযায়ী কাজকর্ম করবেন। ইচ্ছেমতো অনিয়ম করবেন। রেলওয়ের পর্যাপ্ত সেবা দিতে হলে অবশ্যই সকল পর্যায়ের দপ্তর স্থাপন জরুরি। জরুরি পর্যাপ্ত জনবলও। বিশেষ করে সিলেটে অবশ্যই বিভাগীয় দপ্তর স্থাপন করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
সিলেট রেলওয়ে স্টেশন ম্যানেজার নুরুল ইসলাম বলেন, আমরা সিলেট রেলওয়ে স্টেশনভিত্তিক কাজকর্ম করছি। এর মধ্য দিয়েই জনসাধারণকে রেলের স্বাভাবিক সেবা দেয়া হচ্ছে। বিভাগীয় দপ্তর স্থাপনের বিষয়টি কেবল রেলপথ মন্ত্রণালয়ের বিষয়। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বিষয়টির ব্যাপারে বলতে পারবেন বলে জানান তিনি।
সিলেটে রেলওয়ের বিভাগীয় দপ্তর স্থাপন করা প্রয়োজন বলে মনে করেন খোদ বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক সরদার শাহাদাত আলীও।
গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, বাংলাদেশ রেলওয়ে মূলত চট্টগ্রাম ও রাজশাহী কেন্দ্রীক দুটো অঞ্চলে বিভক্ত হয়ে কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগে রেলওয়ের বিভাগীয় কোনো দপ্তর নেই। তবে এটা সত্য যে, সময়ের পরিবর্তন এসেছে। রেলের সক্ষমতাও দিন দিন বাড়ছে। রেলকে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হলে বিভাগীয় পর্যায়ের দপ্তর স্থাপন করা প্রয়োজন। এ বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নিকট তুলে ধরা হবে।

You might also like