অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার : ধনী-গরিব বৈষম্যের নিদান ও দাওয়াই আবিষ্কার
স্টকহোমে রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি অফ সায়েন্সেস সোমবার তিন অর্থনীতিবিদ ডেরন আসেমোগ্লু, সাইমন জনসন ও জেমস এ রবিনসনকে আলফ্রেড নোবেলের স্মরণে ২০২৪ সালের অর্থনীতি বিজ্ঞানে নোবেল বিজয়ী ঘোষণা করেছে।রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি অফ সায়েন্সেস সোমবার বলেছে, ‘প্রতিষ্ঠান কীভাবে গঠিত হয় এবং সমৃদ্ধিকে প্রভাবিত করে তা নিয়ে গবেষণার জন্য’ এই তিন অর্থনীতিবিদকে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে।অর্থনৈতিক বিজ্ঞানে পুরস্কারের কমিটির চেয়ারম্যান জ্যাকব সভেনসন এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছের, এই বছরের বিজয়ীরা বিভিন্ন দেশের সমৃদ্ধিতে বিশাল ব্যবধানের কারণ সম্পর্কে নতুন অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করেছেন। তারা দেখিয়েছেন এর গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো সামাজিক প্রতিষ্ঠানে দৃঢ়মূল পার্থক্য।নোবেল কমিটি যা বলতে চেয়েছে, তার সারার্থ হলো এবারের পুরস্কার বিজয়ীরা মূলত ধনী-গরিব বৈষম্যের নিদান ও দাওয়াই আবিষ্কার করেছেন।অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে কোনো দেশ এগিয়ে থাকে, আবার কোনো দেশ পিছিয়ে থাকে। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ২০ শতাংশ দেশ এখন সবচেয়ে দরিদ্র ২০ শতাংশের চেয়ে প্রায় ৩০ গুণ বেশি ধনী। যদিও গরিব দেশগুলো আরো ধনী হয়েছে, তবু তারা সবচেয়ে ধনী দেশগুলোর সঙ্গে তাল মেলাতে পারে না। একটি বিচ্ছিরি ব্যবধান নাছোড় বান্দার মত লেগেই থাকে। এই বৈষম্যের নিদান খুঁজতে গিয়ে নতুন অন্তর্দৃষ্টি দিয়েছেন এবারের নোবেল বিজয়ী তিন অর্থনীতিবিদ। নতুন ও বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ খুঁজে পেয়েছেন। আর তা হলো – সমাজিক প্রতিষ্ঠানের হেরফের।
ইউরোপীয়রা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উপনিবেশ স্থাপন করতে গিয়ে যে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে, সেগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এই তিন অর্থনীতিবিদ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমৃদ্ধির সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছেন। একই সঙ্গে তাঁরা প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতার তফাত নিরসন এবং এসব প্রতিষ্ঠানকে বদলে দেওয়ার উপায়ও হাজির করেছেন।নোবেল পুরস্কারের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ইউরোপীয়রা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলে উপনিবেশ স্থাপন করার পর সেসব দেশের সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো বদলে যায়। সবখানে যে এই পরিবর্তন একইভাবে হয়, তা নয়। কোনো অঞ্চলে উপনিবেশবাদীদের লক্ষ্য ছিল স্থানীয় জনগণকে শোষণ করে নিজেদের সুখ-সমৃদ্ধি বাড়ানো। আরেক দিকে, উপনিবেশ স্থাপনকারীরা অনেক দেশে ইউরোপীয় অভিবাসীদের দীর্ঘমেয়াদী কল্যাণ নিশ্চিতে অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে।এভাবে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে এসব দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির গতিপথ ঠিক হয়েছে। এবারের নোবেলজয়ী তিন অর্থনীতিবিদ এই বিষয়ের ওপর আলো ফেলেছেন। তারা দেখিয়েছেন, উপনিবেশ স্থাপনের সময় যেসব দেশ গরিব ছিল, সেখানে মূলত অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। কাল পরিক্রমায় এসব দেশের মানুষের জীবনে সমৃদ্ধি এসেছে।
সাবেক উপনিবেশগুলোর মধ্যে যেসব দেশ একসময় ধনী ছিল সেগুলো গরিব হয়ে গেছে এবং গরিব দেশগুলো ধনী হয়ে গেছে। এই পড়মিলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ উপনিবেশবাদীদের প্রতিষ্ঠান গড়ার নীতি ।বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, যেসব দেশে শোষণমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, সেসব দেশের তেমন একটা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়নি এবং তারা নিম্ন আয়ের ঘেরাটোপে আটকা পড়েছে। বিষয়টি হলো, অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলে সেই সমাজের সবাই দীর্ঘমেয়াদি সুফল পায়; তবে শোষণমূলক ব্যবস্থা বা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলে কেবল হাতে গোনা কিছু ক্ষমতাধর মানুষ স্বল্প মেয়াদে লাভবান হয়। রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সবকিছর নিয়ন্ত্রণ গুটিকয় মানুষের হাতে থাকলে কেউই তাদের প্রতিশ্রুত ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক সংস্কারে ভরসা পায় না। নোবেল জয়ী তিন অর্থনীতিবিদ দেখিয়েছেন, ফলত এসব দেশ উন্নতিতে পিছিয়ে থাকে।
২০২৪ সালের নোবেল বিজয়ী তিন অর্থনীতিবিদের মধ্যে দুজন- ডেরন আসেমোগ্লু ও জেমস রবিনসন ‘হোয়াই নেশান্স ফেইল: দ্য অরিজিন্স অব পাওয়ার, প্রসপারিটি অ্যান্ড পভার্টি’ শীর্ষক বিশ্বখ্যাত গ্রন্থের লেখক।আসেমোগ্লুর বলেন, সমৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হলো, অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর সক্ষমতা বা অক্ষমতা। তাঁর মতে, কোনো রাষ্ট্রের প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো অন্তর্ভুক্তিমূলক হলে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নাগরিকদের শরিক হওয়ার সুযোগ থাকলে, সে সমাজ বা রাষ্ট্র দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়নের ধারা সূচনা করতে পারে। কেবল মেধাভিত্তিক অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠানই হতে পারে রাজনীতিক বা আমলাদের হাতে রাষ্ট্রীয় সম্পদের লুণ্ঠন ঠেকানোর রক্ষাকবজ।বইয়ের লেখকদ্বয় মেধাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গড়ার ওপর গুরুত্ব আরো করে দেখিয়েছেন, আফ্রিকার অনেক দেশে এখন আর শ্বেতাঙ্গদের রাজত্ব না থাকলেও মুষ্টিমেয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানকে কুক্ষিগত করে সম্পদ লুটে নিচ্ছেন। এই বাস্তবতার নিরিখে প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন তাঁরা।