অসহিষ্ণুতা,ঘৃণা-বিদ্বেষের বিরুদ্ধে সরকারের স্পষ্ট বার্তা চায় শিক্ষক নেটওয়ার্ক

নিউজ ডেস্ক
সত্যবাণী

ঢাকাঃ শিক্ষার্থী-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই দেশের বিভিন্ন এলাকায় নানা ধরনের ‘অসহিষ্ণু, আক্রমণাত্মক এবং নৈরাজ্যবাদী’ জমায়েত ও হামলায় উদ্বিগ্ন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক।পাঠ্যপুস্তক সংশোধন ও পরিমার্জনে গঠিত কমিটি থেকে দুই সদস্যকে অপসারণের দাবি ওঠায়ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিগত সরকারের সময় বিভিন্ন কাজের সমালোচনা করা শিক্ষকদের এই সংগঠন।এই পরিস্থিতিতে শিক্ষকদের এই সংগঠন অসহিষ্ণুতা ও ঘৃণা-বিদ্বেষের বিরুদ্ধে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছ থেকে স্পষ্ট বার্তা চেয়েছে। এ ব্যাপারে সরকারের ‘নির্মোহ ভূমিকা ও আশু পদক্ষেপ’ প্রত্যাশা করেছেন তারা।সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয়ে শনিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনের এ উদ্বেগ ও এসব দাবি জানানো হয়।

সংবাদ সম্মেলনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বরাবর লেখা একটি খোলা চিঠিও পড়ে শোনানো হয়। আজ বা আগামীকাল রোববার চিঠিটি প্রধান উপদেষ্টাকে পাঠানো হবে এবং স্বরাষ্ট্র, শিক্ষা, আইন, ধর্ম ও প্রতিরক্ষা উপদেষ্টাকেও অনুলিপি পাঠানো হবে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।কমিটি থেকে দুই সদস্যকে অপসারণের দাবির বিষয়ে শিক্ষক নেটওয়ার্কের সদস্য রুশাদ ফরিদী বলেন, ‘উনাদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন। কিন্তু উনাদেরকে বিদ্বেষমূলক ট্যাগ দেয়া- যেমন ইসলাম বিদ্বেষী, ধর্ম বিদ্বেষী বলে তাদেরকে বাদ দিতে হবে; এই ধরনের দাবিগুলো সমাজে অস্থিরতা, সংঘাত তৈরি করে এবং করছে। এগুলো আমরা স্বৈরাচারী আমল থেকে বের হয়ে এসে দেখতে চাই না।জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) প্রণীত ও মুদ্রিত সব পাঠ্যপুস্তক সংশোধন ও পরিমার্জনে ১০ সদস্যের সমন্বয় কমিটি গঠন করেছিল সরকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কামরুল হাসান মামুন ও সামিনা লুৎফাকে ‘ধর্মবিদ্বেষী’ আখ্যা দিয়ে ওই কমিটি থেকে অপসারণের দাবি জানিয়েছেন ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকরা। এরপর শনিবার ওই কমিটি বাতিল করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানের চেতনায় কেমন বাংলাদেশ চাই’ শিরোনামে এক আলোচনা সভা হওয়ার কথা ছিল শনিবার। সেখানে আলোচক হিসেবে আমন্ত্রিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা।তবে শিক্ষক নেটওয়ার্কের এ সদস্যকে ‘সমকামিতা সমর্থনকারী’ তকমা দিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একাংশ। এ পরিস্থিতিতে ‘আইনশৃঙ্খলা বিঘিœত’ হওয়ার আশঙ্কায় ওই সভা স্থগিত করে বিশ্ববিদ্যালয় ও ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসন।শনিবার সংবাদ সম্মেলনে রুশাদ ফরিদী বলেন, ‘আজকে আমাদের সামিনা লুৎফা ম্যামের এখানে বসে থাকার কথা না। তার ময়মনসিংহে থাকার কথা আলোচনা সভায়। তিনি কেন আজকের সভায় যোগ দিতে পারলেন না, সেটা ভেবে দেখুন।অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের কোনো নমুনা দেখা যাচ্ছে কিনা, প্রধান উপদেষ্টার কাছে এমন প্রশ্ন রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রুশাদ ফরিদী।

ইউনূসকে খোলা চিঠি
দেশব্যাপী অসহিষ্ণুতা, ঘৃণা ও বিদ্বেষী আচরণের বিষয়ে সরকারের নীতিকে ‘অস্পষ্ট’ বর্ণনা করে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসকে খোলা চিঠি দিয়েছে শিক্ষক নেটওয়ার্ক। সংবাদ সম্মেলনে ওই চিঠি পড়ে শোনান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন।খোলা চিঠিতে বলা হয়, ‘বিভিন্ন গোষ্ঠী, শ্রেণী ও পেশাজীবীর স্বাধীনতা পাবার আকাক্সক্ষার মধ্যে আপনারা বিশাল এক দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে দেশের হাল ধরেছেন। আকাক্সক্ষার তীব্রতা ও বিগত বছরগুলোতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণের কারণে আপনাদের পথ দুর্গম সেটা আমরা জানি। স্বাধীনতাকামী সবার ধৈর্য প্রয়োজন সে কথাও আমরা মনে রাখি।খোলা চিঠিতে বলা হয়, ‘অভ্যুত্থানের মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই বাংলাদেশের নানা প্রান্তে বিভিন্ন ধরনের অসহিষ্ণু, আক্রমণাত্মক ও নৈরাজ্যবাদী জমায়েত আমরা লক্ষ্য করছি। সেসব জমায়েত থেকে অপছন্দের গোষ্ঠী ও দলের বিরুদ্ধে কেবল হিংসাত্মক কথাবার্তাই বলা হচ্ছে না, ক্ষেত্রবিশেষে সেসব মানুষের ওপর হামলাও চালানো হচ্ছে।

‘তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘবদ্ধ হিংস্রতায় নিহত হয়েছেন তিনজন মানুষ। অপরাধীদের ধরতে গিয়ে একজন সেনা কর্মকর্তা হামলায় নিহত হয়েছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে ভিন্ন জাতিসত্তার মানুষকে।এই ক্রান্তিকালে বর্তমান সরকারের নির্মোহ ভূমিকা পালন ও আশু পদক্ষেপ গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। কাজেই অতি উৎসাহী গোষ্ঠীগুলোর অসহিষ্ণুতা প্রশমনের জন্য; যারা এসব ঘৃণামূলক বক্তব্য প্রচার করছেন এবং বিভিন্ন পরিচয় ও সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর বা নাগরিকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করছেন- তাদের থামাতে হবে।তা না করে সরকার বা কোনো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিজেরাই যদি এসব হস্তক্ষেপকারীদের সাহস যুগিয়ে সাধারণ নাগরিকদের নিরাপত্তাহীনতার ভয় দেখিয়ে কোনো গোষ্ঠীর কথা পালনে বাধ্য করেন, যেমনটা ঘটেছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে, তাহলে আর এত দামে কেনা জুলাই অভ্যুত্থানের কোন আকাক্সক্ষা বাস্তবায়ন করা হলো?অধ্যাপক গীতি আরা বলেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট ঘোষণা আসতে হবে যে- তারা আসলে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ কীভাবে নিশ্চিত করবেন এবং অন্তর্ভুক্তি বিষয়ে তাদের অবস্থান তাদের নীতিসমূহের মাধ্যমে কী করে স্পষ্ট করবেন। সহিংস জমায়েতের সংঘবদ্ধ হিংস্রতা থেকে ভিন্ন মত বা সম্প্রদায়ের মানুষের অধিকার রক্ষায় সরকার কী কী পদক্ষেপ নেবেন তা সুস্পষ্ট করতে হবে।’

#ছাত্র রাজনীতি প্রসঙ্গ#
চিঠি পড়ে শোনানোর পর এক প্রশ্নের জবাবে গীতি আরা নাসরিন বলেন, ‘কারও বিশ্বাস নিয়ে অসম্মান, ঘৃণাবাচক শব্দ ব্যবহার, আক্রমণ এভাবে কোনো সহনশীল সংস্কৃতি নির্মাণ করা যায় না। সবাই যাতে মর্যাদা পান, সেই চিন্তা সবাইকেই করতে হবে। এ ব্যাপারে সরকারের পদক্ষেপ চোখে পড়ছে না। নীতিনির্ধারক ও উপদেষ্টাম-লীর পক্ষ থেকে এ বিষয়ে বার্তা আসতে হবে। এগুলো যে গ্রহণযোগ্য নয়, সে বিষয়ে আমরা পরিষ্কার বার্তা চাইছি।জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌস বলেন, ‘সমাজে অসহিষ্ণু কণ্ঠস্বরগুলো জোরালো হতে দেখা যাচ্ছে। জাতি, ধর্মীয় পরিচয়, জাতিসত্ত্বা ও ভিন্ন রাজনৈতিক কণ্ঠস্বর থামিয়ে দিতে বিভিন্ন আধিপত্যশীল কণ্ঠস্বর উঠে আসছে। ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে। এসব বিষয়ে আমরা সরকারের দ্রুত হস্তক্ষেপ চাই। এত রক্তপাত হলো। দেশের মাথা ও ঘাড় থেকে এত বড় জগদ্দল পাথর নামানো হলো। তারপরও যদি একই রকমের ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়ানোর জায়গায় চলে যাই, তাহলে কেমন হলো?’

ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্র রাজনীতি নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে সাঈদ ফেরদৌস বলেন, ‘রাজনীতির বিরুদ্ধে আমরা নই।কিন্তু আমরা অবশ্যই রাজনীতির নামে অসহিষ্ণুতা, ঘৃণা-বিদ্বেষ ও দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে।ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি নিষিদ্ধের যে দাবি উঠেছে, সেই প্রশ্নে রুশাদ ফরিদী বলেন, ‘ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি কোনো সমস্যা নয়, যতক্ষণ বিশ্ববিদ্যালয় ও দেশে আইনের শাসন, জবাবদিহি ও ন্যায্যবিচার থাকে। আইনের শাসন থাকলে কেউ অন্যায় সুবিধা নিতে পারে না, হলের আসন দখল করতে পারে না। এগুলো ছাত্র রাজনীতি নয়। ছাত্রলীগের রাজনীতি ছাত্ররাজনীতি নয়, এটা আমাদের খুব পরিষ্কারভাবে বুঝতে হবে।জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নাসির উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘স্বৈরাচার সরকারের পতনের মূল ভিত্তি হচ্ছে ছাত্ররাজনীতি। রাজনীতি অবশ্যই চলবে। কিন্তু সেটা হতে হবে কল্যাণকেন্দ্রিক।’

You might also like