অস্ত্র দিয়ে কোপানোর পর ছাদ থেকে ফেলে দেয়া হয় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের (ভিডিও)

‘এ ছাত্রলীগ করে, একে মেরে ফেল’

নিউজ ডেস্ক
সত্যবাণী

ঢাকা: মঙ্গলবার সংঘর্ষ চলাকালে চট্টগ্রামে একটি ভবনের ছাদ থেকে ফেলে দেওয়া হয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের। তার আগে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানো হয়।

চট্টগ্রামের মুরাদপুরে মঙ্গলবার কোটাবিরোধী আন্দোলনকালীদের সাথে ছাত্রলীগ-যুবলীগের সংঘর্ষ চলাকালে একটি ভবনের ছাদ থেকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ফেলে দেওয়া হয়।

ছাদ থেকে মাটিতে পরার পরও তাদের পেটানো হয়। তার আগে ছাদে আটকে পড়া ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানো হয়।

ছাদ থেকে পড়ে গুরুতর আহত এক ছাত্রলীগ কর্মী ওই হামলার বিবরণ দিয়েছেন হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে।

মুরাদপুরের বেলাল মসজিদের পাশে পাঁচ তলা ওই ভবনের ছাদ থেকে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের ফেলে দেওয়ার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।

বুধবার সকালে মুরাদপুরের ঘটনাস্থলে যান চট্টগ্রাম নগর পুলিশের (সিএমপি) কমিশনার সাইফুল ইসলাম। এ ঘটনায় কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে তিনি আশ্বাস দেন।

মঙ্গলবার বিকেলে নগরীর ষোলশহর রেল স্টেশনে কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের কর্মসূচি ঘিরে শুরু হয় সংঘর্ষ। ষোলশহর, দুই নম্বর গেট এলাকা হয়ে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে মুরাদপুর মোড় পর্যন্ত।

এক পর্যায়ে ধাওয়া খেয়ে নগরীর মুরাদপুরে বেলাল মসজিদের পাশে ওই পাঁচতলা ভবনে আশ্রয় নিতে গিয়ে আটকা পড়েন ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মী। কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা ভবনটি ঘিরে ফেলে। তারপর ওই ভবনের ছাদে আটকে মারধর করা হয় ছাত্রলীগ কর্মীদের।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, ভবনের ছাদে আটকে পড়া ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বেধড়ক মারধর করা হচ্ছে। অন্য একটি ভিডিওতে দেখা যায়, রক্তাক্ত ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা ছাদে পড়ে আছেন।

ফেইসবুকে আসা তৃতীয় একটি ভিডিওতে দেখা যায়, কোটাবিরোধী অন্দোলনকারীদের হামলার মুখে ছাদ থেকে ওই ভবনের পিছনের অংশের কার্নিশ ও পানির পাইপ বেয়ে ১৫ জন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা নেমে আসার চেষ্টা করছেন।

তাদের মধ্যে কয়েকজন সানশেডে ও জানালার মাঝের অংশে আশ্রয় নেন। তখনও উপরে থাকা আন্দোলনকারীরা পাথর ছুড়ে এবং লাঠি-হকিস্টিক দিয়ে আঘাত করে তাদের নিচে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করে। নিচ থেকেও তাদের লক্ষ্য করে ঢিল ছোড়া হচ্ছিল।

এক পর্যায়ে ভবনটির ডানপাশের পাঁচ তলার সানশেড থেকে কালো পোশাক পরিহিত একজন নিচে পড়ে যান। মাটিতে পড়ে তার শরীর লাফিয়ে উঠে। তারপর নিথর পড়ে থাকতে দেখা যায়। এর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আরেকজন উপর থেকে মাটিতে পড়ে যান।

পিছনের অন্য একটি ভবন থেকে ভিডিওটি ধারণকারীর প্রান্ত থেকে বলতে শোনা যায়, ‘পড় পড় … (গালি)। অন্য একজন পড়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখে আতর্নাদ করে বলে ওঠেন ‘আল্লাহ আল্লাহ।’

কিছুক্ষণ পর আরেকটি কণ্ঠে গালি দিয়ে বলতে শোনা যায়, “মর মর, আর আবি না এডে তোরা ছাত্রলীগ (আর এখানে আসবি ছাত্রলীগ?)

পরে একজনকে বলতে শোনা যায়, “এই কিরে ভাই, এই মরি যাইবু তো বেডা (মারা যাবে তো), এই মারিছ না, মারিছ না।”

হামলায় ছাদ থেকে পড়ে গুরুতর আহত হয়েছেন হাজী মুহাম্মদ মহসীন কলেজ ছাত্রলীগের নেতা জালাল উদ্দিন জুবায়ের। তার হাতের রগ কেটে দেওয়া হয়েছে। ভেঙে ফেলা হয়েছে পা।

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন জুবায়ের সেই হামলার বর্ণনা দিয়ে বলেন, “আমি উপরে উঠছি। ছাদে ছিলাম। এরমধ্যে ওরা দরজা-টরজা লাথি দিচ্ছে। আমি রিকোয়েস্ট করতেছি, ভাই আপনারা চলে যান।

“ওরা বলতেছে যে, কালকে আমাদের বোনকে মারছস না? আজকে তোকে একদম জানে মেরে ফেলব। এরপরে আমার হাতে একটা কোপ দেয়। বাম হাতের কবজিতে একটা কোপ দেয়। কোপ দেওয়ার পরে আমি ওদের এক সাইড থেকে অন্য সাইডে যখন যাচ্ছি, পিছন থেকে একজন এসে আমাকে লাথি দেয়। লাথি দেওয়ার পরে আমি পরে যাই।”

জুবায়ের বলেন, “পরে যাওয়ার পরে নিচে ইট ছিল। ইটের স্তূপ ছিল। ওইখানে পরে যাই। আমি হালকা সেন্সলেস হয়ে যাই। এরমধ্যে আমার একটু সেন্স আসছে। ওরা দেয়াল টপকায় ৫০-৬০ জন আসছে। সবার হাতে হকিস্টিক এবং স্টাম্প।

“একটা ছেলে বলতেছে যে, একে আমি চিনি। এ ছাত্রলীগ করে। বলে, একে মেরে ফেল। এটা যখন বলছে, সবাই এসে এলোপাথাড়ি আমাকে…। আমি অনেক রিকোয়েস্ট করেছি। যে ভাই আমিও তো সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করি। আমাদের কি অপরাধ?”

নগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের কর্মীদের ওই ভবনে আটকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হয়েছে মাথায় এবং হাতে-পায়ে। একজনের হাত-পায়ের রগ কেটে দিয়েছে। পাঁচ-ছয়জনকে ছাদ থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছে।

“কোটাবিরোধীর নামে ইসলামী ছাত্র শিবির ও ছাত্রদলের সন্ত্রাসীরা এই হামলা করেছে। কয়েক ঘণ্টা আহতরা ওই ভবনে আটকে ছিল। পুলিশকে বারবার বলার পরেও তারা উদ্ধারে এগিয়ে যেতে দেরি করেছে। পরে ফায়ার সার্ভিস ও রেডক্রিসেন্টের সদস্যরা গিয়ে তাদের উদ্ধার করে।”

উদ্ধারের পর দুটি রিকশা ভ্যানে করে আহতদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।

নুরুল আজিম রনি বলেন, চট্টগ্রাম মেডিকেলের আইসিইউতে ৫ জন এবং দুটি বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে আরো তিনজন গুরুতর অবস্থায় আছেন।

হাজী মোহাম্মদ মহসীন কলেজ ছাত্রলীগের নেতা মায়মুন উদ্দিন মামুন বলেন, “আমাদের কলেজের জালাল উদ্দিন জুবায়ের নামের এক ছাত্রের হাত-পায়ের রগ কেটে দিয়েছে মুরাদপুরের ওই ভবনে আটকে। তার একটি চোখের আঘাত গুরুতর।

“সাধারণ শিক্ষার্থীর ব্যনারে জামাত-বিএনপির লোকজন হামলা করেছে।”

চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের নেতা মাহমুদুল করিম বলেন, “ভবনের ছাদ থেকে কয়েকজনকে ফেলে দিয়েছে। দুজনের আঘাত গুরুতর।”

চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটির সহ-সভাপতি জাহিদ হাসান সায়মন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ধারালো অস্ত্রের আঘাত করা হয়েছে ছাত্রদের মাথায়। কয়েকজনের হাতের তালু কেটে দিয়েছে। জাবেদ ইকবাল, পারভেজ, জাহেদ অভি, অয়ন, সাগরসহ কয়েকজন গুরুতর আহত হয়েছে।”

তবে হামলার বিষয়টি অস্বীকার করে কোটাবিরোধী আন্দোলনের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজগুলোর চট্টগ্রাম বিভাগীয় সমন্বয়কারী মো. সৈয়দ হোসেন বলেন, “ছাত্রলীগ পরস্পরকে চিনতে না পেরে নিজেরা নিজেদের মেরেছে। আমরা সাধারণ অন্দোলনকারী। আমাদের হাতে কোনো কিছু ছিল না।”

বুধবার দুপুরে মুরাদপুর এলাকা পরিদর্শন শেষে নগর পুলিশের কমিশনার সাইফুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি মুরাদপুরের ঘটনাস্থলে গিয়েছি। যেখানে তিনজন গতকাল নিহত হয়েছেন সেখানে গিয়ে দেখেছি।

“মুরাদপুরের ওই ভবনে গিয়ে সরেজমিন দেখেছি। ছাদ থেকে ফেলে দেওয়ার ওই ঘটনা দেখে হতবাক হয়েছি। অবশ্যই দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। পাশেই ২ নম্বর গেটে এত ফোর্স থাকার পরেও কেন পুলিশ যেতে দেরি হয়েছে তা দেখা হবে।”

মঙ্গলবার সংঘর্ষে চট্টগ্রামে তিনজন নিহত, কমপক্ষে ৪০ জন আহত হন। সারা দেশে নিহত হন ছয়জন।

ভবনের ছাদ থেকে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের ফেলে দেওয়ার ঘটনায় মামলার প্রস্তুতি চলছে বলে জানান পুলিশের কমিশনার।

ভিডিও: 4359d9c7-e5ab-4021-88fb-cfd067bee6a9

 

 

 

 

You might also like