আগামী বর্ষার আগে অনুমোদনের আশা পাউবো’র সুরমা-কুশিয়ারা ড্রেজিংয়ে ৬ হাজার কোটি টাকার মেগা প্রকল্প

চঞ্চল মাহমুদ ফুলর
সত্যবাণী

সিলেট থেকেঃ দেশের প্র্রধান নদী সুরমা ও কুশিয়ারা ড্রেজিং করতে দু’টি মেগা প্রকল্প গ্রহণ করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। এ প্রকল্পের আওতায় ড্রেজিংয়ের পাশাপাশি নদী দু’টোর উভয় তীর সংরক্ষণ, বেড়িবাঁধ নির্মাণ, নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনসহ আনুষাঙ্গিক উন্নয়নও করা হবে। এতে প্রাথমিকভাবে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬ হাজার ৩১৭ কোটি ২৮ লাখ টাকা। মেগা এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে সিলেট মহানগরসহ সিলেট সদর উপজেলা, দক্ষিণ সুরমা, গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, কানাইঘাট ও জকিগঞ্জ উপজেলা স্থায়ীভাবে বন্যার ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পাবে।বর্তমানে সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল এন্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস) ও ইনস্টিটিউট অব মডেলিং ওয়াটার (আইডব্লিউএম) নামক পৃথক দু’টি প্রতিষ্ঠান প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা যাছাইয়ের কাজ করছে। চলতি বছরের ডিসেম্বর নাগাদ সমীক্ষা শেষ হবে। এরপর আগামী বছর প্রকল্প দু’টি অনুমোদন পেতে পারে। পাউবো সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।পাউবো সূত্রে জানা গেছে, সুরমা ও কুশিয়ারা নদী ড্রেজিং করতে ৪ হাজার ৯২ কোটি টাকার একটি প্রকল্পের ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল (ডিপিপি) গত বছর পাউবোতে জমা দেয়া হয়। এ প্রকল্পের আওতায় সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর উভয় তীরে বেড়িবাঁধ পুনর্বাসন ও উভয় তীর সংরক্ষণ করা হবে। পাউবো প্রকল্পের ব্যাপারে সমীক্ষা যাচাইয়ের জন্যে সিইজিআইএস ও আইডব্লিউএম নামক দু’টি প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ করেছে।বর্তমানে তারা এর সমীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলায় সুরমা ও কুশিয়ারা নদী মোট কত কিলোমিটার ড্রেজিং করা হবে তা সমীক্ষায় নির্ধারণ করা হবে বলে সূত্র জানিয়েছে।

এছাড়া, সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার সুরমা ও কুশিয়ারা নদী ড্রেজিং করতে ২ হাজার ২২৫ কোটি ২৮ লাখ টাকার আরেকটি পৃথক প্রকল্প গ্রহণ করেছে পাউবো। ওই প্রকল্পটি শুধুমাত্র জকিগঞ্জ উপজেলায় বাস্তবায়ন করা হবে। ড্রেজিং ছাড়াও প্রকল্পের আওতায় সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর উভয় তীর সংরক্ষণসহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। পাউবো’র সদর দপ্তর হয়ে ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি প্রকল্পের ডিপিপি পরিকল্পনা কমিশনে জমা করা হয়। তবে, এখনো এই প্রকল্পের পিইসি (প্রজেক্ট ইভ্যালুয়েশন কমিটি) সভা হয়নি। এ প্রকল্পেরও বর্তমানে সিইজিআইএস ও আইডব্লিউএম নামক দু’টি প্রতিষ্ঠান সম্ভাব্য সমীক্ষা যাচাইয়ের কাজ চলমান রয়েছে। আগামী ডিসেম্বর নাগাদ দু’টি প্রকল্পের সমীক্ষা সমাপ্তি হবে। এরপর ‘কাটছাঁট’ শেষে প্রকল্প দু’টি প্রি-একনেক সভায় যাবে। প্রি-একনেক সভায় অনুমোদন পেলেই চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্যে সরকারের জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি বা একনেক সভায় উত্থাপিত হবে। একনেকে পাস হলে পরবর্তীতে দরপত্র আহ্বানের মধ্য দিয়ে সরেজমিনে প্রকল্প বাস্তবায়নের কার্যক্রম শুরু করা হবে। পাউবো’র একটি সূত্র বলছে, সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী বছরের শুরুতেই প্রকল্পটি চূড়ান্ত অনুমোদন পেতে পারে।জানা গেছে, দেশের দীর্ঘতম নদী হচ্ছে সুরমা। নদীটির দৈর্ঘ্য প্রায় ২৪৯ কিলোমিটার। ভারতের বরাক নদী সিলেট জেলার জকিগঞ্জের আমলসীদে এসে দু’ভাগে বিভক্ত হয়েছে। এর একটির নাম সুরমা নদী এবং অপরটি কুশিয়ারা নদী। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে সুরমা নদী সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণা ও কিশোরগঞ্জের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মেঘনা নদীতে গিয়ে মিলিত হয়েছে।

সুরমা-কুশিয়ারা ড্রেজিং করতে দু’টি প্রকল্পের সমীক্ষা চলছে বলে জানিয়েছেন পাউবো সিলেট জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী আসিফ আহমদ। সমীক্ষার পর প্রকল্প দু’টি চূড়ান্ত হয়ে যেতে পারে বলে মন্তব্য করেন এ কর্মকর্তা।পাউবো সিলেটের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী এস.এম.শহিদুল ইসলাম জানান, সুরমা-কুশিয়ারা ড্রেজিং হলে সিলেট মহানগর আর প্লাবিত হবে না। ঘরবাড়ি-রাস্তাঘাট এমনকি হাওরের ফসল তলিয়ে যাবে না। বর্তমানে দু’টি প্রকল্পের সমীক্ষা চলমান রয়েছে। কোন নদীর কত কিলোমিটার এবং কোন কোন জায়গা ড্রেজিং করতে হবে তা সমীক্ষায় উঠে আসবে। সমীক্ষায় প্রকল্পের সকল দিক পর্যালোচনা হবে। সামনের ডিসেম্বরে সমীক্ষা শেষ হয়ে যাবে। এরপর প্রকল্প দু’টি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্যে প্রি একনেক হয়ে একনেকে যাবে। সুরমা-কুশিয়ারা ড্রেজিং হলে এর অনেক সুফল পাওয়া যাবে।সূত্র মতে, সুরমা নদী খননে ২০১২ সালে একটি প্রকল্প গ্রহণ করে পাউবো। ওই প্রকল্প প্রস্তাবের পর নদীখননে সমীক্ষা চালানো হয়। সমীক্ষার পর নদীখননে উদ্যোগ নেয়ার কথা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হলেও আর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। ২০১৭ সালে ৩০০ কোটি টাকার আরেকটি প্রকল্প গ্রহণ করে পাউবো। ২০১৯ সালে সুরমা ও কুশিয়ারা নদীখনন, বাঁধ নির্মাণ ও নদীর তীর সংরক্ষণের জন্যে ২ হাজার ২০০ কোটি টাকার একটি ডিপিপি গ্রহণ করে পাউবো। পরবর্তীতে ওই প্রকল্পেরও আর কোনো অগ্রগতি হয়নি।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সিলেট জেলার সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম বলেন, সুরমা নদী ড্রেজিংয়ে এ পর্যন্ত ৪ বার সমীক্ষা হয়েছে। কিন্তু নদী আর ড্রেজিং করা হয়নি। কেবল সমীক্ষায়-ই আটকে আছে সুরমা নদীর ড্রেজিং কার্যক্রম। এ ব্যাপারে স্থানীয় সংসদ সদস্যও যথাযথ উদ্যোগ নেননি। না হয় এভাবে কেবল সমীক্ষার পর সমীক্ষা হতো না। পাউবো আগ্রহের সাথে ড্রেজিং করতে প্রকল্প গ্রহণ করে।কারণ, ড্রেজিং হচ্ছে দুর্নীতির অন্যতম খাত। গত দেড় দশক ধরে দেশের পরিবেশবাদীরা সুরমা-কুশিয়ারার মুখ ড্রেজিং করতে সরকারকে উদ্যোগ নিতে বার বার তাগিদ দিয়েছেন। ভরাট হয়ে যাওয়ায় এবার সুরমা নদী উপচে সিলেট নগরী পানিতে তলিয়ে যায়। সুরমা ড্রেজিং করতে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানান তিনি।সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেট বিভাগীয় আহবায়ক ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, যে কোনভাবেই হোক সুরমা-কুশিয়ারা ড্রেজিং করতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নদীর নাব্যতা ঠিক থাকলে এখন সিলেটবাসীকে এমন বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হতো না।নদী ড্রেজিং প্রকল্প যাতে নানা অজুহাতে বিলম্ব না হয়; এদিকে সিলেটের এমপি-মন্ত্রীদের নজর দেয়া প্রয়োজন। না হয় আগামীতেও এমন বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হবে।তিনি এও বলেন, নদী ড্রেজিং প্রকল্পের কাজ শতভাগ স্বচ্ছতার সাথে বাস্তবায়ন করতে হবে।ড্রেজিং এর নামে যাতে লুটপাট না হয়; সেদিকেও কঠোর নজরদারি রাখতে হবে।

You might also like