আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে রেনেসাঁ সাহিত্য মজলিস আলোচনা ও কবিতা পাঠ

বদরুজ্জামান বাবুল
সত্যবাণী

লন্ডনঃ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও শহীদ দিবস উপলক্ষে রেনেসাঁ সাহিত্য মজলিস ইউকে আয়োজিত আলোচনা ও কবিতাপাঠের আসরে বক্তারা বলেছেন, মাতৃভাষাকে প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলার মানুষ যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন তা বিশ্বব্যাপী অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে।

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে প্রবীন সাংবাদিক-কলামিস্ট ও বিশিষ্ট সংগঠক কে এম আবুতাহের চৌধুরী ভাষা-শহীদ বরকত, সালাম, রফিক, সফিক, জব্বার প্রমুখকে শ্রদ্ধার সাথে স্বরণ করে বলেন, তাদের বুকের তাজা রক্তে প্লাবিত হয়েছে রাজপথ। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মাতৃভাষার মর্যাদা। তিনি দেশে-বিদেশে বাংলা ভাষার চর্চা জোরদার করার আহ্বান জানিয়ে বিলেতে আমাদের নতুন প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের বাংলা শিক্ষার উপর গুরুত্বারোপ করেন।ইস্ট লন্ডনে ভ্যালেন্স রোডের উডহাম সেন্টারে সংগঠনের সহ-সভাপতি শেখ ফারুক আহমদের সভাপতিত্বে ও সাধারন সম্পাদক কবি শিহাবুজ্জামান কামালের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত সভায় প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ মোস্তফা। সভায় ‘ব্রিটেনে বাংলা চর্চা ও বাংলা ভাষার বিশ্বায়ন’ শীর্ষক গবেষণামূলক প্রবন্ধ পাঠ করেন সময় সম্পাদক, কবি ও কথাসাহিত্যিক সাঈদ চৌধুরী।

অন্যান্যের মধ্যে আলোচনা ও কবিতা পাঠে অংশনেন কবি আজিজুল আম্বিয়া, কলামিস্ট চৌধুরী হাফিজ আহমদ, সাহিত্যিক খান জামাল নুরুল ইসলাম, লেখক ও সমাজসেবী হাজী ফারুক মিয়া, কমিউনিটি নেতা ফারুক আহমদ সুন্দর প্রমুখ। ভাষা শহীদদের রুহের মাগফিরাত কামনা করে দোয়া পরিচালনা করেন করেন মাওলানা নুরুল হক।

মূল প্রবন্ধে লেখক সাঈদ চৌধুরী উল্লেখ করেন, বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলন বিশ্বজুড়ে বাংলাকে ঐশ্বর্যমণ্ডিত করেছে। পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল ঘটনা হিসেবে মর্যাদার আসন লাভ করেছে আমাদের ভাষা-সংগ্রামীদের অবদান ও আত্মদান। ২১ ফেব্রুয়ারি আমাদের ‘শহীদ দিবস’ এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের গৌরবে অভিষিক্ত। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা (ইউনেস্কো) আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করে। ১৯৯৯ সাল থেকে ভাষা শহীদের সম্মানে এই দিবস পালন করা হচ্ছে।

গবেষণা প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের পর ব্রিটেনে সবচেয়ে বেশি বাংলা চর্চা হয়। লন্ডনের ‘বাংলা টাউন’ ব্রিকলেন ‘তৃতীয় বাংলা’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। এছাড়া পৃথিবীর প্রায় সকল প্রান্তেই এখন বাংলা চর্চা হয়। শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা পড়ানো হয়। অক্সফোর্ড, হার্ভার্ড, মেলবোর্ন, শিকাগো, হাইডেলবার্গ, মন্ট্রিয়ল, টোকিও, বেইজিং-সহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার ব্যাপকতা লাভ করেছে। ব্রিটেনের বিশ্ববিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে গুরুত্বের সাথে বাংলা ভাষা শেখানো হয়। গবেষণা হয় বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে।

দীর্ঘ প্রবন্ধে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি অব ওরিয়েন্টাল স্টাডিজে বাংলা ভাষার কোর্স সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরে বলা হয়, অক্সফোর্ডের ওয়েবসাইটে বাংলাকে দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম ভাষা, ভারতের অন্যতম সরকারি ভাষা এবং বাংলা দেশের জাতীয় ভাষা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। সেখানে দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে আগত মেধাবী শিক্ষার্থিদের মাঝে একঝাক বাংলা ভাষার শিক্ষার্থির সরব পদচারণা না দেখে কেউ অনুভব করতে পারবে না।লন্ডন কুইনমেরি ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইটের তথ্য উল্লেখ করে বলা হয়, বাংলা হল বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম ভাষা। যেখানে ২২৮ মিলিয়নের প্রধান ভাষা। আর দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে বাংলা ব্যবহার করেন ৩৭ মিলিয়ন মানুষ। তাই এটি একটি বিশ্বভাষা হিসাবে বিবেচিত। সেখানে ২০২৩-২০২৪ চলমান কোর্সে চলছে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি বিষয়ে প্রতি ২২ সপ্তাহে ৪৪ শ্রেণীকক্ষ ঘন্টা এবং ১০৬ ঘন্টা স্বাধীন অধ্যয়ন।

এছাড়া সোয়াস বাংলা কোর্সে ১০ সপ্তাহের প্রতি টার্মে যথার্থভাবে বাংলায় কথা বলা, শোনা, পড়া এবং লেখার উপর একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ ভিত্তি প্রদান করা। পাঠ্যক্রমের উপাদানগুলিতে আধুনিক সময়ের ভাষা এবং ভাষার বিভিন্ন উত্স গুরুত্বের সাথে শিক্ষার্থিদের শেখানো হয়। কোর্সটি অগ্রসর হওয়ার সাথে সাথে জটিল বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে, ভাষায় চ্যালেঞ্জিং পাঠ্য লিখতে এবং পড়ার জন্য আরও আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি এবং শব্দভান্ডার বৃদ্ধির প্রয়াস চালানো হয়।

একইভাবে লন্ডন কিংস কলেজে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিস্তৃত জ্ঞান ব্যবহার করে শিক্ষার্থিদের শেখার অগ্রগতি এবং ভাষাতে উচ্চ স্তরের দক্ষতা বিকাশে অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত করা হয়।এদিকে ব্রিটেনের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে এশিয়ায় বাংলা ভাষার বৈচিত্র্যময় সাহিত্যের ঐতিহ্য তুলে ধরে বলা হয়েছে, বাংলা যুক্তরাজ্যের চতুর্থ সর্বাধিক সাধারণ অভিবাসীর ভাষা। এই ভাষায় যুক্তরাজ্যে বিদেশী ভাষা জানা পর্যটন, শিক্ষা এবং গবেষণায় বিভিন্ন কর্মজীবনের বিকল্প খুলে দেয়। বাঙালির সঙ্গে যোগাযোগ এবং বাঙালি সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য বুঝতে ডারহামে প্রমিত বাংলা শেখানো হয়। এক্সট্রা-কারিকুলাম কোর্স হিসেবে সেখানে ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, কর্মী এবং জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। ভারত ও বাংলাদেশ থেকে অনেক লেখক-সাধক বাংলায় গবেষণা করতে ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন।

সাঈদ চৌধুরীর প্রবন্ধে আরো বলা হয়, এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের শিক্ষার্থিদের পাশাপাশি বিলেতে জন্ম নেয়া আমাদের নতুন প্রজন্ম বাংলা ভাষা ও ঐতিহ্য সম্পর্কে সমৃদ্ধ হচ্ছে। ব্রিটেনে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সংগঠন বা সংস্থার মাধ্যমে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চা হয়। গ্রেট বৃটেনে প্রায় ৫লাখ বাংলাদেশির বসবাস। শুধু টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলে বাস করেন ৫০ হাজারের অধিক। নিজেদের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ধরে রাখার জন্য ব্রিটেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা গড়ে তুলেছেন মসজিদ, মাদ্রাসা, স্কুল, কলেজ এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন সভাসমূহে বাংলায় আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ভাষা চর্চা চলছে সমান্তরাল ভাবে। এভাবে বিলেতে বাংলাদেশিরা বাংলা ভাষার বিশ্বায়নে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছেন।

অনুষ্ঠানে টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলে তৃতীয় বারের মতো নির্বাহী মেয়র নির্বাচিত হয়ে ইতিহাস সৃষ্টিকারী বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত রাজনীতিক লুতফুর রহমান আমাদের মাতৃভাষার বিকাশ তথা কমিউনিটি ভাষা সার্ভিস পুনরায় চালু করতে টাওয়ার হ্যামলেট্স কাউন্সিলে কয়েক লক্ষ পাউন্ড বাজেট বরাদ্দ করার খবরে সন্তোষ প্রকাশ করে সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করা হয়।প্রধান অতিথির বক্তব্যে মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ মোস্তফা স্মৃতিচারণ করে বলেন, আমাদের ভাষা আন্দোলন কেবল মাতৃভাষার দাবি প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ছিল না, বরং এটি ছিল আমাদের জাতিগোষ্ঠীর আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠারও সংগ্রাম। এই আন্দোলনের পথ ধরেই একাত্তরে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে। ফলে ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণের পাশাপাশি মাতৃভাষার উন্নয়ন ও বিকাশের জন্য আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।

বাংলাদেশ জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন ইউকের সাধারণ সম্পাদক খান জামাল নুরুল ইসলাম ইউরোপে বাংলা চর্চার ব্যাপকতা তুলে ধরে ব্রিটেনের নতুন প্রজন্মকে বাংলা শেখানোর জন্য তাদের পরিচালিত কোর্স সম্পর্কে উপস্থিত সকলকে অবহিত করেন।সংগঠনের সাধারন সম্পাদক কবি শিহাবুজ্জামান কামাল রেনেসাঁ সাহিত্য মজলিস ইউকে আয়োজিত আলোচনা ও কবিতাপাঠের আসরে লেখক-সাহিত্যিকদের অংশগ্রহন করায় সবাইকে অভিনন্দন জ্ঞাপন করেন।সভাপতির বক্তব্যে শেখ ফারুক আহমদ বিলেতে বাংলা ভাষার বিকাশে সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। তিনি মূলধারায় প্রথম বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত সফল ক্রিকেট খেলোয়াড় জাহিদ শেখ আহমদের ভূমিকা উল্লেখ করেন এবং ব্রিটিশ-বাংলাদেশী এমপি, সরকারী কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, পেশাজীবী, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক,শিল্পী ও ক্রীড়াবিদদের অবদান তুলে ধরার আহবান জানান।

You might also like