একাত্তরের দূর্দান্ত লড়াকু কিশোর মুক্তিযোদ্ধা মুজিবুর রহমান মানিক

চঞ্চল মাহমুদ ফুলর
সত্যবাণী
সিলেট অফিসঃ ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে সিলেট অঞ্চলে যে ক’জন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা সরাসরি সম্মুখ সমরে অংশ নিয়েছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম, বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ মুজিবুর রহমান মানিক। তিনি ৪নং সেক্টরের তামাবিল সাব-সেক্টরের একজন তুখোড় ও লড়াকু মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে যাত্রার প্রাক্কালে এই কিশোর যোদ্ধার বয়স ছিল মাত্র ১৪ বছর ৫ মাস। সে সময় তিনি সিলেটের রাজা গিরিশ চন্দ্র (জিসি) হাইস্কুলে দশম শ্রেণীতে অধ্যয়ন করতেন। গ্রামের বাড়ি সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার রতনপুর গ্রামে। ওই গ্রামেরই অধিবাসী হাতেম আলী ও গুলজান বিবি দম্পতির তৃতীয় সন্তান। বীর মুক্তিযোদ্ধা মানিকের সহোদর ছিলেন তৎকালীন সিলেট-৫ আসনের এমপিএ এবং আওয়ামী লীগের জেলা পর্যায়ের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা। এ কারণে তিনি বেড়ে উঠেছিলেন রাজনৈতিক পরিমন্ডলের মধ্যে। আর বড় ভাই এমপিএ হওয়ার সুবাদে ওই অল্প বয়সেই তিনি ছিলেন প্রখর রাজনৈতিক সচেতন।
শিক্ষানুরাগী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ মুজিবুর রহমান মানিক বর্তমানে একজন সফল ব্যবসায়ী। তিনি মূলতঃ জ্বালানি ব্যবসার সাথে জড়িত। ব্যবসা ছাড়া শিক্ষাবিস্তারেও তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। ব্যবসায়িক সংগঠন হিসেবে তিনি বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম ডিলারস, ডিস্ট্রিবিউটারস, এজেন্টস্ এন্ড পেট্রোলপাম্প ওনার্স এসোসিয়েশন সিলেট বিভাগীয় কমিটির সিনিয়র সহ-সভাপতি এবং বাংলাদেশ সিএনজি ফিলিং স্টেশন এন্ড কনভার্শন ওয়ার্কশপ ওনার্স এসোসিয়েশন সিলেট বিভাগীয় কমিটিরও সাধারণ সম্পাদকের গুরুদায়িত্ব পালন করছেন। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাথে তো জড়িত রয়েছেনই, একই সাথে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা চেতনা বাস্তবায়ন পরিষদ সিলেট বিভাগীয় কমিটির যুগ্ম আহবায়কও তিনি। এছাড়া নগরির পূর্ব শিবগঞ্জে অবস্থিত স্বনামধন্য হাতিম আলী উচ্চ বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি, মেজরটিলার ইসলামপুরস্থ লন্ডন-গ্রেস স্কুল এন্ড কলেজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও ম্যানেজিং কমিটির বর্তমান সভাপতি হিসেবে সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করছেন। পাশাপাশি তিনি সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার চতুলবাজার সংলগ্ন দূর্গাপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের ভূমিদাতাও বটে। এসব ছাড়াও মানিক ভাই বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া সংগঠনের সাথে জড়িত।
সম্প্রতি এই মহান বীরের সাথে আলাপকালে উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধ যাত্রা ও মুক্তিযুদ্ধকালে তাঁর দুঃসাহসিক অভিযানে অংশগ্রহণের অনেক অজানা কথা। পাঠকদের জ্ঞাতার্থে এখানে তার কিছু তুলে ধরা হলো-
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন বাঙালিদের ওপর কাপুরুষের মত পৈচাশিক আক্রমণ চালায় তখন সিলেট শহরের টিলাগড়ের বাসা ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয়। প্রাণ রক্ষার্থে মানিকের পরিবার গ্রামের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। তখনকার প্রেক্ষাপটে অজ-পাড়াগাঁয়ের বাড়িতেও স্বস্তি ছিল না। পাক-হানাদার বাহিনী বাঙালি অমুসলিম জনগোষ্ঠী এবং আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়ি ঘরে হামলা চালিয়ে সেগুলো জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ধ্বংস করে দিচ্ছিল। আর যেহেতু বীর মুক্তিযোদ্ধা মানিকের সহোদর হাবিবুর রহমান তখনকার এমপিএ, তাই তাঁদের পৈতৃক নিবাস যে পাক হানাদারদের লক্ষ্যবস্তু হবে, এটা নিশ্চিত বলেই ধরে নিয়েছিলেন পরিবারের লোকজন। উপজেলা সদর থেকে ‘জ্বালাও-পোড়াও’ করে পাক সৈন্যরা মানিকের রতনপুর গ্রামের পাশের গ্রামে চলে এসেছে। পাশের গ্রাম সরুখেলের বাসিন্দা ও পুরোনো জমিদার গৌরীচরণের সুদৃশ্য বাড়িটি ছাই করে দেয় পাক সেনারা। পুরনো এই জমিদার বাড়িটি দখলের উদ্দেশ্যে স্থানীয় এক দালাল পাক সৈন্যদের সরুখেলে নিয়ে এসেছিল। নিয়তির কি নির্মম পরিহাস! যে দালাল অন্যের বাড়ি দখল করার অসৎ উদ্দেশ্যে পাকসেনাদের নিয়ে এসেছিল, সেই দালালের বাড়িই পাক বাহিনী জ্বালিয়ে ধ্বংস করে আসার পথে দালালকে বুকে গুলি করে হত্যা করে চলে যায়। এই দালালরা যে স্বার্থের মোহে কতটা অমানবিক হতে পারে সে দৃশ্যও দেখেছেন কিশোর মানিক। ওই গ্রামের আরেক দালাল ছিল মোহাম্মদ চৌধুরী। সে দালালের নেতৃত্বে রাজাকাররা দিনে-দুপুরে জমিদার গৌরীচরণের বাড়ির কয়েক হাজার মন ধান লুট করে নিয়ে যায়।
সম্ভ্রান্ত পরিবারের গৌরীচরণের সাথে মানিকের বাবা হাতেম আলীর ছিল ঘনিষ্ট সম্পর্ক। আর ওই পরিবারের উপর এমন পৈচাশিক অত্যাচার কিশোর মানিকের মনে প্রচন্ড দাগ কাটে। তিনি ভাবতে থাকেন এই অত্যাচারিদের প্রতিহত করার পাশাপাশি ওদের হাত থেকে যেকোন উপায়ে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করতে হবে। তখনই তিনি সিদ্ধান্ত নেন মুক্তিযুদ্ধে যাবার। আর সে উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেন বড় ভাই এমপিএ হাবিবুর রহমানের কাছে। এর অনেক আগেই এমপিএ হাবিবুর রহমান ভারতে চলে গিয়েছিলেন। কিশোর মানিকও গেলেন মুক্তারপুরে যেখানে তাঁর ভাই থাকার কথা। জানতে পারেন সহোদর এমপিএ ডাউকিতে আছেন। অবশেষে সেখানে গেলেন মানিক এবং বড় ভাইয়ের সাথে থেকে গেলেন কয়েকদিন। অতঃপর যোগ দেন ইস্টার্ন কমান্ড ওয়ান-এর ইকো-ওয়ানে। ইকো-ওয়ান ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প। দেখলেন তাঁর মতো অনেক কিশোর-তরুণ সেখানে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। তাদের দেখে মানিকের উৎসাহ আরো বেড়ে যায়। যোগ দেন প্রশিক্ষণ শিবিরে।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর গোর্খা রেজিমেন্টের ‘সুবেদার থাব্বা’ প্রশিক্ষণ প্রদান করছেন। কোমলে-কঠোরে মেশানো মিঃ থাব্বা ছিলেন অসম্ভব সাহসী আর পরিশ্রমী সেনা কর্মকর্তা। ট্রেনিংকালে তিনি ছিলেন অত্যন্ত কড়া আবার ব্যক্তিগত সময়ে একজন অমায়িক মানুষ। বিশেষ করে কিশোর যোদ্ধাদের তিনি সন্তানের মতো ভালবাসতেন। আরেক প্রশিক্ষক ছিলেন শিখ ধর্মাবলম্বী এক ক্যাপ্টেন। আলাপকালে মানিক ওই শিখ ক্যাপ্টেনের নামটি মনে করতে পারছিলেন না। এ দু’জন ছাড়াও আরো কয়েকজন প্রশিক্ষকের অধীনে মাসাধিককাল প্রশিক্ষণ নিতে হয়েছে তাঁদের। প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মন অস্থির হয়ে যায় মানিক ভাইয়ের। দেশে না গেলে যে যুদ্ধ করা যাবে না। শেষ পর্যন্ত এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, জানিয়ে দেয়া হলো ‘তোমরা এবার যুদ্ধে যাওয়ার জন্য উপযুক্ত হয়েছো।’
তারপর মানিক সহ একদল মুক্তিযোদ্ধাকে পাঠানো হলো ভারতীয় সীমান্তের নো-ম্যান্স ল্যান্ডস সংলগ্ন সিলেটের তামাবিলে। প্রশিক্ষণকালেই জানতে পারেন সরাসরি রাইফেল চালানোর যুদ্ধে তিনি যুক্ত হবেন অন্যদের তুলনায় কম। তবে যা করবেন তা হবে বেশ আনন্দায়ক। কাছে থেকেই সুফল দেখা যাবে সেই যুদ্ধের। তাঁকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল ‘বিস্ফোরক প্রতিস্থাপন’ প্রক্রিয়াটি। কাজটি ছিল শত্রু বাহিনীর চলার পথের ব্রিজ ও কালভার্ট ধ্বংস করে দেয়া। প্রয়োজনে অন্য স্থাপনাও গুঁড়িয়ে দেয়া যাবে। সামনা-সামনি ফল দেখার সুযোগ পাওয়ার আনন্দও আছে। সেই কারণেই হয়তো তিনি কাজটিকে আগ্রহের সাথে নিয়েছিলেন। আর বাস্তবে তাঁর দক্ষতার প্রমাণ দেখালেন। আর দক্ষতা ও আন্তরিকতার কারণে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ওই সাব-সেক্টরে তিনি এক্সপ্লোসিভ ইনচার্জ হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলেন। ওই এলাকার অধিনায়ক ছিলেন ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী (বিএসএফ)-এর ‘মেজর রাও’। তামাবিল পৌঁছার পর নিরাপদ স্থান দেখে নিজের জায়গা করে নিলেন। তামাবিলে এখন যেখানে কাস্টমস্ অফিস তাতেই তিনি বিস্ফোরক দ্রব্যসহ নিজের থাকার জায়গা করেন। দেশের মাটিতে এবং একজন সাহসী যোদ্ধার অধীনে থাকার সুযোগ পেয়ে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা মানিক নিজেকে ধন্য মনে করলেন।
বিস্ফোরক দিয়ে ব্রিজ কিংবা স্থাপনা উড়িয়ে দেওয়ার কাজটি প্রতিদিন করতে হতো না। ফলে তিনি বাড়তি সুযোগ হিসেবে সম্মুখ সমরে অংশ নেওয়ার চেষ্টা করেন। অন্যদিকে যুদ্ধের প্রয়োজনেও বাড়তি যোদ্ধা সঙ্গে নিতে হতো মুক্তিযোদ্ধাদের। যারা সমানতালে যুদ্ধের ময়দানে অস্ত্র চালিয়েছেন।
স্মরণে থাকা একটি অপারেশনের কিছু কথা বললেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মুজিবুর রহমান মানিক। তিনি জানালেন- গোয়াইনঘাট রাস্তার আটালিয়াই নামে একটি ব্রিজ ধ্বংস করার জন্য তাঁকে দায়িত্ব দেয়া হয়। সে অপারেশনে লেঃ রফিকুল আলম ছিলেন অধিনায়ক। গভীর রাতে তাঁরা রওয়ানা হন অপারেশনের উদ্দেশ্যে। আগেই ‘রেকি’ (অর্থাৎ আগাম খোঁজ-খবর নেয়া। যুদ্ধের ভাষায় যাকে রেকি বলে) করে সব ঠিক করা হয়েছিল। গাইড হিসেবে আসে গফুর নামক একজন। এক সময় সে ডাকাতি করতো। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসে। মূলতঃ গোলাবারুদ বয়ে আনা কিংবা গাইড হিসেবে কাজ করতো সে। তাঁর পথ-নির্দেশনায় এগিয়ে গেলেন তাঁরা। এভাবে নির্ঝঞ্ঝাটে গন্তব্যে পৌঁছুলেন। সাধারণতঃ এ ধরণের ব্রিজগুলো পাহারা দিতো রাজাকার ও পাকিস্তানি মিলিশিয়া বাহিনীর সদস্যরা। অপারেশনের সময় রাজাকাররা ছিল বাংকারে। বাংকারে না থাকলেও তারা ঠিকে থাকতো পারতো না। কারণ, ওই অপারেশনে পুরো এক কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা অংশ নিয়েছিল। এক কোম্পানি সু-সজ্জিত মুক্তিযোদ্ধার সামনে কয়েকজন রাজাকার কি আর ঠিকে থাকতে পারে? বলতে গেলে বিনাযুদ্ধেই রাজাকারগুলো আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হয়। তাদের ধরে ফেলা হয়। রাজাকাররা আত্মসমর্পনের পর মানিকের কাজ শুরু হয়। তিনি নিরাপদে ব্রিজে বিস্ফোরক দ্রব্য প্রতিস্থাপন করেন। ঠিক সময়ে বিস্ফোরকের প্রচন্ড শব্দে ও ধাক্কায় ধ্বংস হয়ে যায় ব্রিজটি। এই সফল অপারেশনে কয়েকজন তাঁর সহযোগী ছিলেন। এবার ফিরে যাওয়ার পালা। রাজাকাররা পরামর্শ দিল, আপনারা যে পথে এসেছেন, সেই পথেই আবার ফিরে যান। কিন্তু অপারেশন অধিনায়ক লেঃ রফিকুল আলম বললেন, আমরা আমাদের নিয়ম মেনেই ফিরে যাবো।
এদিকে, কিভাবে যে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ পরিকল্পনাগুলো পাকিস্তানি বাহিনী জেনে যায়। ফিরে যাওয়ার পথে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সৈন্যদের হামলার মুখে পড়ে যান। আগেই পাক-বাহিনী এ্যাম্বুশ (উঁৎ পেতে থাকা) নিয়ে রেখেছিল মাঝপথে। এই এ্যাম্বুশে পড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মারাত্মক ক্ষতি হয়। গফুরসহ ১৮ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা সেখানে শাহাদাত বরণ করেন। সমস্ত কোম্পানি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সহযোদ্ধাদের প্রাণ হারানোর পাশাপাশি বন্দী হওয়া রাজাকাররাও পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। মানিকও পুরো দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন। আত্মরক্ষার্থে আশ্রয় নিয়েছিলেন পাশের একটি ধানক্ষেতে।
আটালিয়াই ব্রিজ ভাঙার পর গোয়াইনঘাট ও রাধানগর আক্রমণেও বীর মুক্তিযোদ্ধা মুজিবুর রহমান মানিক অংশ নেন। দু’টি আক্রমণেই অধিনায়ক ছিলেন এস আই এম নুরুন্নবী চৌধুরী। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে নুরুন্নবী চৌধুরী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর লেঃ কর্নেল পদে উন্নীত হয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য তাকে ‘বীর বিক্রম’ খেতাব দেওয়া হয়। পরবর্তীতে সামরিক শাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের শাসনকালে তাঁকে সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত করা হয়। অবশ্য আরো পরে অন্য সরকার বরখাস্তের নির্দেশ প্রত্যাহার করে এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে সম্মানিত করেছিল।
গোয়াইনঘাটের রাধানগরে অনেক যুদ্ধ হয়েছে। সবসময়ই ভারতীয় সৈন্যরা ‘আপার ক্যাম্প’ থেকে সহযোগিতা করতেন। ওই সময় বারোয়াল অপারেশনে মানিক অংশ নিয়েছিলেন। সেখানে পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন মোশারত ছিল মারাত্মক অত্যাচারী। ধর্ম-বর্ণ বিচার না করে শুধুমাত্র বাঙালি দেখলেই গুলি করতো। মানিক ভাইয়ের অধিনায়ক গোয়েন্দা মাধ্যমে অবহিত হন অক্টোবর মাসের কোন একদিন ক্যাপ্টেন মোশারত বারোয়াল আসছেন। অধিনায়ক নির্দেশ দিলেন সেখানে মাইন বসাতে হবে। যাতে করে মোশারতের গাড়ি আসামাত্রই বিস্ফোরণের মুখে পড়ে। পরিকল্পনা অনুযায়ী মানিক ভাই সহযোদ্ধাদের নিয়ে যান স্থানীয় সোলেমানের বাড়ির সামনে। সোলেমানের বাড়িটি ছিল সড়কের পাশে। সড়কের দু’দিকে কিছুটা ঝোপঝাঁড় থাকায় নিজেদের আড়াল করে রাখার সুবিধা ছিল। পাকিস্তানি সৈন্যদের গাড়ি আসতে দেখা গেলে দ্রুত আত্মগোপনে যাওয়া সম্ভব হবে। সেদিক বিবেচনা করে সড়কের পাশে গর্ত করে এন্টি-ট্যাংক মাইন বসিয়ে গোবর দিয়ে ঢেকে দিলেন মানিক। সফলভাবে মাইন প্রতিস্থাপনের কাজ শেষে মানিকের দল ফিরে আসে ক্যাম্পে।
পরেরদিন ঠিকই অত্যাচারী ক্যাপ্টেন মোশারতের নেতৃত্বে পাকিস্তানি বাহিনীর একদল সৈন্য সেখানে এসে উপস্থিত হয়। কিন্তু চালাক মোশারত বেঁচে যায়। তবে তার সঙ্গে থাকা সৈন্যবাহী একটি গাড়ি মাইন বিস্ফোরণের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। পুরো গাড়িই দুমড়ে-মুচড়ে যায়। আরোহিদের সবাই ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। সামনা-সামনি যুদ্ধে ঝুঁকির মধ্যে না গিয়ে গেরিলা কায়দায় শত্রু সৈন্যদের খতম করার মধ্যে আলাদা একটি তৃপ্তি রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকালীন স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত ‘চরমপত্র’ নামের অনুষ্ঠানে এ ধরণের অপারেশনকে অত্যন্ত সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হতো। চরমপত্রের লেখক ও উপস্থাপক এম আর আখতার মুকুল ‘বিচ্ছুদের কারবার’ শিরোনামে আখ্যায়িত করতেন এ ধরণের অপারেশনগুলোকে।
যাই হোক, পাকিস্তানি বাহিনীকে ঘায়েল করতে পেরে বীর মুক্তিযোদ্ধা মানিক বেশ পুলকিত হয়েছিলেন। এই সাফল্যের কারণে সিনিয়র যোদ্ধারা তাঁকে অভিনন্দনও জানিয়েছিলেন। মানিক বাকি সময় জেমস্ ফিনলে চা বাগানসহ বিভিন্ন জায়গায় মাইন বসিয়েছেন। এর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলো- গুলনি চা বাগান ও বড়জান চা বাগানে এনটি পারসোনাল মাইন স্থাপন, সিলেট-গোয়াইনঘাট সড়কের বারহাল নামক স্থানে চুনু মিয়ার বাড়ির পাশে এনটি ট্যাংক মাইন স্থাপন করেন। মাইন বিস্ফোরণের কারণে রাস্তাঘাট ধ্বংস হওয়ায় পাক হানাদার বাহিনী বারহালে ক্যাম্প স্থাপন করতে পারেনি। বড়ভাঙ্গা ব্রিজ, গোছরভাঙ্গা ব্রিজ, আটলাই ব্রিজ এক্সপ্লোসিভ বসিয়ে ধ্বংস করেন মানিকের মুক্তিযোদ্ধা দল। আটলাই ব্রিজ ধ্বংসের সময় একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এভাবে অনেক জায়গাতেই পাকিস্তানি বাহিনী যুদ্ধ ছাড়াই মানিক ভাইয়ের ক্যারিশ্মায় উৎখাত হয়েছে।
ওই অপারেশনের সময় অদূরে দেখতে পান সমছু নামের একজনকে। মনে করলেন গ্রামবাসী কেউ হবে। জিজ্ঞেস করতেই বলল ওই এলাকাতেই তার বাড়ি। সমছুকে বললেন, তাঁর গাইড হিসেবে কাজ করতে। অপারেশন শেষে সেই মানিক ভাইকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। কিছু দূর যেতেই দেখেন সারী নদী। এখন নদী পাড়ি দিয়েই যেতে হবে তাদের। যুদ্ধের নিয়ম অনুযায়ী অচেনা কাউকে অতিরিক্ত বিশ্বাস করতে নেই। সেটা মনে রাখেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মানিক। ভাবলেন যদি পাকিস্তানি বাহিনীর চর হয়ে থাকে। আর এই নদীর পাড়ে যদি পাকিস্তানি সৈন্যদের অবস্থান হয়, তাহলে মানিককে নদীতেই গুলি খেয়ে মরতে হবে। দ্বিধাগ্রস্ত মানিককে অভয় দেন সহযাত্রী সমছু। কিন্তু তবুও তিনি যেন নিশ্চিত হতে পারছিলেন না। শেষ পর্যন্ত সমছুকে বললেন, তুমি সাঁতরে নদী পেরিয়ে যাও। সমছু নদী পেরিয়ে গেলেন আবার ফিরেও আসলেন। তখন নিশ্চিত হওয়া গেল যে, আশেপাশে পাক হানাদার বাহিনী নেই। এরপরে সারী নদী পাড়ি দিয়ে গেলেন মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে। জানতে পারলেন গোর্খা রেজিমেন্টের একজন সৈনিকও শহীদ হয়েছেন। ক্যাম্পে যাওয়ার পর সহযাত্রী সমছু সম্পর্কে যে তথ্য পেলেন, তাতে তাঁর পিলে চমকে যাওয়ার মতো অবস্থা। প্রমাণ পাওয়া গেল মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান সম্পর্কে পাকিস্তানি বাহিনীকে গোপন খবরটি দিয়েছে তাঁর গাইড হিসেবে আসা সমছু নিজে। স্বাভাবিকভাবেই তাকে শাস্তি পেতে হবে। বাঘের খাঁচা থেকে বেঁচে এসেছেন ভেবে মানিক হাফ ছেড়ে বাঁচলেন।
এখানে উল্লেখ্য যে, মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানিদের পক্ষে কাজ করেছে সমছুর মতো কিছু বাঙালি। যাদের রাজনৈতিক পরিচয় ছিলো মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামী ইসলামী ও পিডিপি। তবে তাদের সংখ্যা ছিল দেশের মোট জনসংখ্যার তুলনায় অতি সামান্যই।
সমছুর মতো কিছু রাজাকার ছিল এলাকায়। যারা পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতা করা ছাড়াও স্থানীয় মানুষের ওপর জঘন্য অত্যাচার চালাতো। পাকিস্তানি সৈন্যদের ডেকে এনে মানুষ খুন করানোর পাশাপাশি নিজেরাও লুটপাটে অংশ নিতো। তেমনি একজন ছিল ফতেহপুর ইউনিয়ন পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান মদরিছ। সেটা তামাবিল সীমান্ত পয়েন্ট থেকে অন্তত কুড়ি মাইল দক্ষিণে। নির্দেশ আসলো সেই মদরিছ রাজাকারকে ধরে আনতে হবে। এই অপারেশনের নেতৃত্ব দেয়া হলো ফখরুল ইসলামকে। যিনি পরবর্তীতে মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য ‘বীরপ্রতীক’ খেতাব পেয়েছিলেন। তাঁর অধিনায়কত্বে মানিক সহ তাঁর সহযাত্রীরা নৌকায় করে হাদারপাড় নামক স্থানে আসেন। রাস্তার দূরত্ব বেশী হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের ওই দলটিকে হাদারপাড়ে বিশ্রাম নিতে হয়। এক সময় মদরিছ চেয়ারম্যানের বাড়ি পৌঁছান। অনেক মুক্তিযোদ্ধা ছিল সে গ্রুপে। মুক্তিযোদ্ধারা তার বাড়ি ঘেরাও করে তাকে পাকড়াও করেন একপর্যায়ে। কিন্তু ধুরন্ধর মদরিছ রাজাকার মুক্তিযোদ্ধাদের হাত থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। কিন্তু তার ছেলে শাহজাহান মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়ে। তাকে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা রওয়ানা হন নিজেদের ক্যাম্পের  দিকে। রাজাকার মদরিছ পালিয়ে যাওয়ার সময় মুক্তিযোদ্ধারা কিছু গোলাগুলি করেছিলেন। ফলে রাজাকারদের সবাইকে জীবিত আটক করে আনা সম্ভব হয়নি। গোলাগুলিতে কিছুসংখ্যক রাজাকার মারা যায়। আসার সময় কয়েকজন রাজাকার ও চেয়ারম্যানের ছেলে শাহজাহানকে নিয়ে আসে মুক্তিযোদ্ধারা। কিন্তু পরবর্তীকালে পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত হয় যে, এই ছেলেটির বাবা কুখ্যাত রাজাকার। তবে ছেলেটি নিরাপরাধ। তাই তাকে কোন শাস্তি দেয়া ঠিক হবে না। সে কারণে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়।
পুরো যুদ্ধকালে মুজিবুর রহমান মানিক বেশ কিছু ব্রিজ ধ্বংস করেছিলেন। তার মধ্যে বড়ভাঙ্গা ব্রিজটি উল্লেখযোগ্য। ডিসেম্বর মাসে ভারতীয় বাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। ভেতরে আসতে আর তাদের কোন অসুবিধা হয়নি। মেজর রাওয়ের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানীরা সিলেট অভিমুখে রওয়ানা হয়। তখন দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। সিলেটের আকাশে পত পত করে উড়ছে লাল-সবুজ পতাকা।
(বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ মুজিবুর রহমান মানিক রচিত ‘মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা:রাজা জিসি হাইস্কুল থেকে রণাঙ্গণে’ গ্রন্থ থেকে কিঞ্চিত সংগৃহিত।)

You might also like