এখনো স্প্রিন্টার যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছেন নেতাকর্মীরা দীর্ঘ দেড় যুগেও গুলশান সেন্টারে গ্রেনেড হামলার বিচার শেষ হয়নি
চঞ্চল মাহমুদ ফুলর
সত্যবাণী
সিলেট থেকেঃ সিলেট নগরীর তালতলার গুলশান সেন্টারে গ্রেনেড হামলা মামলার বিচার কার্যক্রম দীর্ঘ দেড় যুগেও শেষ হয়নি। দফায় দফায় তদন্তের পর মামলার অভিযোগপত্র দেয়া হলেও তেমন গতি আসেনি বিচার কার্যক্রমে। ন্যায়বিচার পেতে অপেক্ষার প্রহর গুণছেন গ্রেনেডের স্প্রিন্টার বয়ে বেড়ানো নেতা-কর্মীরা।আ’লীগের নেতাকর্মীদের হত্যা করতে গুলশান সেন্টারে ২০০৪ সালের ৭ আগস্ট পাকিস্তানপন্থী কুলাঙ্গার জঙ্গী গোষ্ঠী গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিল। আজ রোববার বর্বরোচিত হামলার ঘটনার ১৮ বছর পূর্ণ হচ্ছে।
যোগাযোগ করা হলে মহানগর দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত পিপি এ্যাডভোকেট সৈয়দ শামীম আহমদ সংবাদমাধ্যমকে বলেন, বর্তমানে মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে। করোনার ফলে আদালত বন্ধ থাকায় চাঞ্চল্যকর এই মামলার বিচার কার্যক্রমে তেমন অগ্রগতি হয়নি। বার বার লকডাউনের ফলে সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণও বিলম্বিত হয়। অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে মামলার বিচার কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত পিপি এ্যাডভোকেট জুবায়ের বখত জুবের জানান, করোনা শুরুর আগে সর্বশেষ সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। এরপর লকডাউনে আদালত বন্ধ থাকায় সাক্ষ্যগ্রহণ করা যায়নি। লকডাউনের পরে আদালতের কার্যক্রম শুরু হলে সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে আসলেও আসামীরা অনুপস্থিত থাকায় সাক্ষ্যগ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। বর্তমানে সিলেটের অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে মামলার বিচার কার্যক্রম চলছে। এই আদালতেই মামলার বিচার কার্যক্রম সম্পন্ন হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সিলেটের অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে গুলশান সেন্টারে গ্রেনেড হামলার ঘটনায় বিস্ফোরক আইনে মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। মামলার ৬৪ সাক্ষীর মধ্যে এ পর্যন্ত প্রায় অর্ধেক সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন। ২০১৫ সালের ১৫ জুন এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। এই সালের ৭ মে ৮ আসামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। ২০১৭ সালের ১৬ এপ্রিল ৮ আসামীর মধ্যে মুফতি আব্দুল হান্নান, শরীফ সাহেদুল আলম বিপুল ও দেলোয়ার হোসেন রিপনের ফাঁসি কার্যকর হয়। ব্রিটিশ হাই কমিশনার আনোয়ার চৌধুরী’র উপর গ্রেনেড হামলা মামলায় ফাঁসি কার্যকর হয় এই ৩ জঙ্গীর। অপর ২ আসামী মাওলানা তাজ উদ্দিন ও হুমায়ুন কবির হিমু ঘটনার পর থেকে পলাতক রয়েছে। বর্তমানে মামলার অপর ৩ আসামী মুফতি মঈন উদ্দিন ওরফে আবু জান্দাল ওরফে মাসুম বিল্লাহ ওরফে খাজা মো. মফিজুল ইসলাম ওরফে মফিজ ওরফে অভি ওরফে মহিব উল্লাহ ও পাকিস্তানী নাগরিক আব্দুল মাজেদ ভাট ওরফে ইউসুফ ভাট কারাগারে আটক রয়েছে। একই ঘটনায় দায়েরকৃত হত্যা মামলাটিও বর্তমানে বিচারাধীন রয়েছে।
২০১৮ সালের ২১ অক্টোবর সিলেটের জননিরাপত্তা বিঘœকারী অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালে ৫ আসামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। বিস্ফোরক মামলায় কারাগারে আটক ৩ আসামী ও পলাতক ২ আসামীসহ এই ৫ আসামী হত্যা মামলারও আসামী।জানা গেছে, সিআইডি’র অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার রওনকুল হক চৌধুরী সর্বশেষ তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে চাঞ্চল্যকর এ মামলার পুনঃতদন্ত করেন। তদন্তে ঘটনার সাথে আলী এন্টারপ্রাইজের মালিক সিলেট-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এম ইলিয়াস আলীর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে বেরিয়ে আসে। সিআইডি এ বিষয়ে ২০১১ সালে বিএনপি নেতা এম. ইলিয়াস আলীকেও জিজ্ঞাসাবাদ করে।২০১৩ সালের ১৭ জুলাই আগের অভিযোগপত্রের ৬ আসামীসহ মাওলানা তাজউদ্দিন ও মাজেদ ভাটকে আসামী করে ৮ জনের বিরুদ্ধে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেয়া হয়। সম্পূরক অভিযোগপত্র নং ১৭৮।
মামলার নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, ওই হামলার ব্যাপারে জঙ্গী শরীফ সাহেদুল আলম বিপুল ২০০৬ সালের ৬ অক্টোবর সিলেটের প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট নুরে আলম সিদ্দিকীর আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়।
গুলশান সেন্টারে গ্রেনেড হামলায় মহানগর আ’লীগের তৎকালীন প্রচার সম্পাদক ইব্রাহিম আলী নিহত হন। তৎকালীন নগর আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক ও দলের সাবেক কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এ্যাডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ, আ’লীগ নেতা এনামুল হক, এ্যাডভোকেট মফুর আলী, এ্যাডভোকেট রাজ উদ্দিন, তুহিন কুমার দাস (মিকন), ফয়জুল আনোয়ার আলাওর, নগর আ’লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জাকির হোসেন, দলের নেতা কবির উদ্দিন আহমদ, এ্যাডভোকেট রাধিকা রঞ্জন চৌধুরী, এটিএম হাসান জেবুল, শওকত আলী, এ্যাডভোকেট শেখ মকলু মিয়া, প্রদীপ পুরকায়স্থ, তপন মিত্র, আজম খান, জুবের খান, জামাল চৌধুরী ও আব্দুস সুবহান আহত হন। আহতদের শরীরে এখনো গ্রেনেডের স্পিøন্টার রয়েছে। সেনাবাহিনীর বিশেষজ্ঞরা ওই গ্রেনেডকে আর্জেস হ্যান্ড গ্রেনেড বলে মতামত দেন।নথিতে উল্লেখ করা হয়, হামলায় ব্যবহৃত আর্জেস গ্রেনেড চট্টগ্রাম থেকে এক পাকিস্তানি নাগরিকের কাছ থেকে আরেক পাকিস্তানি জঙ্গী নেতা আব্দুল মাজেদ ভাট ওরফে ইউসুফ ভাট সংগ্রহ করে। এরপর রাজধানী ঢাকার মুহাম্মদপুরস্থ মাজেদ ভাটের বাসায় সেটি মজুদ করা হয়। পরে জঙ্গী নেতা মুফতি হান্নানের মাধ্যমে গ্রেনেডটি সিলেটে নিয়ে আসা হয়। পাকিস্তানি জঙ্গী মাজেদ ভাটই এই গ্রেনেড সরবরাহ করে। এরপর পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী আ’লীগ নেতৃবৃন্দকে হত্যার উদ্দেশ্যেই গ্রেনেড হামলা করা হয় বলে মামলার নথিপত্রে উল্লেখ রয়েছে।গ্রেনেড হামলার পরদিন এসআই এনামুল হক বাদী হয়ে কোতয়ালী থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। এসআই ফজলুল আলম ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি’র এএসপি মুন্সী আতিকুর রহমান মামলার তদন্ত করেন।
২০০৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বর সিআইডির পরিদর্শক জুবের আহমদ আদালতে অভিযোগপত্র দেন। এতে মুফতি হান্নান, বিপুল, মুফতি মঈনুদ্দিন, মহিবুল্লাহ, রিপন ও পলাতক হিমুকে আসামী করা হয়। ২০১১ সালের ২ আগস্ট সিলেটের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ ৩য় আদালতের বিচারক গ্রেনেড হামলার প্রকৃত নির্দেশদাতা,প্ররোচণাদানকারী, গ্রেনেড সরবরাহকারী এবং আলী এন্টারপ্রাইজের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে মামলাটি পুনঃতদন্তের জন্যে সিআইডির এএসপি পদমর্যাদার কর্মকর্তা দ্বারা তদন্তের আদেশ দেন।সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার রওনকুল হক চৌধুরী মামলার পুনঃতদন্ত করে আদালতে সম্পূরক অভিযোগপত্র জমা দেন।