করোনার মধ্যেই পঙ্গপাল ঠেকানোর লড়াই ভারতের
আন্তজার্তিক ডেস্ক
সত্যবাণী
ভারতঃ পঙ্গপালের বিশাল এক ঝাঁক ভারত ও পাকিস্তানের বিস্তীর্ণ এলাকায় আক্রমণ চালিয়েছে করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যেই।ছোট আকারের এই পোকার বিশাল ও আগ্রাসী বাহিনী ব্যাপকভাবে ফসল ধ্বংস করার ক্ষমতা রাখে। এই পঙ্গপাল বাহিনী পশ্চিম ভারতের ৫০ হাজার হেক্টরের বেশি মরু এলাকায় ২৪টির বেশি জেলায় আক্রমণ চালিয়েছে। তাদের আক্রমণের সবচেয়ে বড় শিকার হয়েছে রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ এবং গুজরাত।প্রতিবেশি পাকিস্তানের কর্তৃপক্ষ ফেব্রুয়ারি মাসে সারা দেশ জুড়ে জরুরি অবস্থা জারি করেছিল। তারা বলেছিল দুই দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে সেটা ছিল সবার্ধিক সংখ্যক পঙ্গপালের ঝাঁক।স্থানীয় রিপোর্টগুলোতে বলা হচ্ছে কৃষকদের ”প্রায় তিন দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ পঙ্গপাল মহামারির” মোকাবেলা করতে হচ্ছে। এবং এই মরু পঙ্গপাল বাহিনী ফসল ব্যাপকভাবে ধ্বংস করে ফেলছে, যার ফলে খাদ্যের দাম হু হু করে বাড়ছে।পাকিস্তানের প্রায় ৩৮ শতাংশ জুড়ে রয়েছে বালোচিস্তান, সিন্ধ এবং পাঞ্জাব প্রদেশ। এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) একটি প্রতিবেদন বলছে ওই এলাকাই এই প্রজাতির পঙ্গপালের ”বংশবৃদ্ধির মূল ক্ষেত্র”।
দুই পারমাণবিক শক্তিধর বৈরি দেশের মধ্যে সম্পর্ক কয়েক বছর ধরে শীতল। কিন্তু কর্মকর্তারা বলছেন তার পরেও এই অভিবাসী পঙ্গপালের হামলা মোকাবেলায় ভারত ও পাকিস্তান একযোগে কাজ করছে।দু্ই দেশের মধ্যে স্কাইপের মাধ্যমে নয়টি বৈঠক হয়েছে এপ্রিলের মাসের পর থেকে। ওই বৈঠকে আফগানিস্তান এবং ইরানের উদ্ভিদ সুরক্ষা বাহিনীর কর্মকর্তারাও যোগ দেন বলে ভারতের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা আমাকে জানিয়েছেন।কোভিড নাইনটিন মহামারি শুরুর আগে দুই পক্ষ সীমান্তে সামনাসামনি বৈঠক করেছে। ২০১৭-১৮য় পঙ্গপাল নিয়ন্ত্রণে তারা সীমান্তে পাঁচটি বৈঠক করেছে।
”আমরা সীমান্তের ওপার থেকে বড়ধরনের পঙ্গপাল আক্রমণ ঠেকাতে লড়ছি। প্রায় তিন দশকের মধ্যে এতবড় আক্রমণ হয়নি। এই পঙ্গপালের ঝাঁক খুবই বিশাল। নির্ধারিত সময়ের এক মাস আগেই এবার তারা বংশবিস্তার করেছে এবং সীমান্ত পার হয়ে চলে এসেছে,” বলছেন ভারতের পঙ্গপাল সতর্কীকরণ সংস্থার ডেপুটি ডিরেক্টার কে এল গুর্জার।পঙ্গপালের ঝাঁকটা পাকিস্তান থেকে ভারতে ঢুকেছে ৩০শে এপ্রিল নাগাদ। তারা রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশের ৫টি জেলায় এই মুহূর্তে ফসল ধ্বংস করছে। এক বর্গ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে থাকে ৪০ মিলিয়ন (৪ কোটি) পর্যন্ত পতঙ্গ। তারা ওড়ে খুব দ্রুত। কর্মকর্তারা বলছেন কখনও কখনও তারা একদিনে ৪০০ কিলোমিটার (২৪৮ মাইল) পর্যন্ত পথ পাড়ি দিতে পারে।”আমাদের ভাগ্য ভাল মাঠে এই মুহূর্তে কোন শস্য নেই। কিন্তু পঙ্গপালের ঝাঁক সবুজ পাতা, ডালপালা, ফল, ফুল, বীজ এবং গাছ খেয়ে নি:শেষ করে দেয়,” জানান মি. গুর্জর।কর্মকর্তারা বলছেন ছোট্ট একটা পঙ্গপালের ঝাঁক গড়ে যে পরিমাণ খাবার একদিনে খেয়ে শেষ করতে পারে, তা প্রায় আড়াই হাজার মানুষের একদিনের খাদ্যের সমান।
এই কোভিড ১৯ মহামারির মধ্যে পঙ্গপাল মোকাবেলায় কাজ করছে এমন প্রায় শ’খানেক কর্মীর জন্য এটা নতুন আরেকটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের মরুভূমির প্রচণ্ড গরমে গাড়িতে লাগানো স্প্রে-যন্ত্র, কীটনাশক এবং ড্রোন ব্যবহার করে এই পঙ্গপাল নিয়ন্ত্রণের কাজ করতে হচ্ছে।তাদের থাকতে হচ্ছে গ্রামে, সেখানে তাদের খাবার জোগাচ্ছেন স্থানীয়রা এবং ফেস মাস্ক ও চলনসই সুরক্ষা পোশাক পরে রাতের বেলা তাদের মাঠেঘাটে নামতে হচ্ছে পঙ্গপাল শিকারে।”পাকিস্তানের মরু এলাকায় জন্মানোর পর এই পঙ্গপালের ঝাঁক ঢুকেছে ভারতে। এটা খুবই ভয়াবহ মাত্রার আক্রমণ,” রাজস্থান রাজ্যে কর্মরত উদ্ভিদ রক্ষা কর্মকর্তা ওম প্রকাশ জানান।গত কয়েক বছরে ভারতকে বেশ কয়েকবারই পঙ্গপাল হামলার মোকাবেলা করতে হয়েছে : ১৯৬৪ থেকে ১৯৯৭ সালের মধ্যে পঙ্গপালের আক্রমণে শস্যের মড়ক ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতির ২৫টি রেকর্ড রয়েছে।
বেশ কয়েকবার পরপর পঙ্গপালের ঝাঁক হামলা চালানোর পর ১৯৩৯ সালে ঔপনিবেশিক শাসকরা করাচিতে পঙ্গপাল সতর্কীকরণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। ভারত তাদের পৃথক পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলে ১৯৪৬য়ে। নিয়ন্ত্রণ করা না হলে, এই মরু পঙ্গপাল খাদ্য সরবরাহ নি:শেষ করে ফেলতে পারে, যার ফলে দেখা দিতে পারে দুর্ভিক্ষ। ৯০টি দেশে প্রায় সাড়ে চার কোটি বর্গ কিলোমিটার এলাকাকে পঙ্গপালের হামলাপ্রবণ এলাকা বা সম্ভাব্য ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা বলে চিহ্ণিত করেছে খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এফএও।দ্বিতীয় এক দফা পঙ্গপাল হামলা হয়েছে পূর্ব আফ্রিকাতেও। আফ্রিকার দ্বিতীয় সবচেয়ে ঘনবসতির দেশ ইথিওপিয়া, সেইসঙ্গে ওই এলাকার অর্থনৈতিক প্রাণকেন্দ্র কেনিয়া এবং রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল সোমালিয়া বড়ধরনের পঙ্গপাল হামলার কবলে পড়েছে।
জাতিসংঘ ধারণা করছে দ্বিতীয় দফা পঙ্গপালের ঝাঁক ফেরত এলে তাদের আকার হবে প্রথম ঝাঁকের চেয়ে বিশগুণ বড়। জুন মাস নাগাদ সেটা ঘটলে সেই ঝাঁক আকারে ৪০০গুণ বড় হবে। বিশ্ব ব্যাংক হামলায় ফসলের ক্ষতি সামলে ওঠার জন্য পূর্ব আফ্রিকা ও মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলোকে অনুদান এবং স্বল্প সুদে ঋণ বাবদ ৫০কোটি ডলারের অনুমোদন দিয়েছে।জাতিসংঘ বলছে ২০১৮-১৯এর ঘূর্ণিঝড় মৌসুমের পর বর্তমান পঙ্গপালের ঝাঁকের উপদ্রব শুরু হয়। ওই ঘূর্ণিঝড়ের পর আরব উপদ্বীপে প্রচুর বৃষ্টি হয়যার ফলশ্রুতিতে নজিরবিহীন এক জন্মচক্র থেকে অন্তত তিন প্রজন্ম পঙ্গপাল জন্ম নেয়। সেটা প্রথমে জানা যায়নি। এরপর থেকে পঙ্গপালের ঝাঁক ছড়িয়ে পড়ে দক্ষিণ এশিয়া আর পূর্ব আফ্রিকায়।
সামনের মাসগুলো ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
“আমাদের সতর্ক থাকতে হবে, বিশেষ করে এখন যেসব রাজ্যে পঙ্গপাল হানা দিয়েছে সেগুলো কোভিড মহামারি সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে, এছাড়া এসব রাজ্যে এখন প্রচণ্ড দাবদাহও শুরু হয়েছে,” বলছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংস্থা সাসটেনেবল এনভায়রমেন্ট অ্যান্ড ইকোলজিক্যাল সোসাইটির অংশু শর্মা।
পঙ্গপালের ঝাঁক ধ্বংস করা হয় কীভাবে
বিশ্রামরত পঙ্গপালের ঝাঁকের ওপর সুনির্দিষ্ট পরিমাণ কীটনাশক স্প্রে করে নিয়ন্ত্রণকারী কর্মীরা পায়ে হেঁটে, এছাড়াও মাটি থেকে ব্যবহার করা যান দিয়ে ও বিমান থেকে কীটনাশক স্প্রে করে পঙ্গপাল ধ্বংস করা হয়। সূত্র : বিবিসি।