“কোভিড ভ্যাকসিন কি হালাল নাকি হারাম”


ডা: জাকি রেজওয়ানা আনোয়ার এফআরএসএ

 

যে কোন ভ্যাক্সিন গ্রহণের আগে ভ্যাক্সিনটি সম্পর্কে মনের মধ্যে উঁকি দেওয়া সব প্রশ্নের জবাব আদায় করার অধিকার প্রতিটি মানুষের রয়েছে। কোন প্রশ্নই ছোট নয় – অবান্তর তো নয়ই! গত কয়েক মাস ধরেই বিভিন্ন মিডিয়াতে, অনলাইনে, অফলাইনে ভ্যাক্সিন নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি, হচ্ছি। দু:খজনকভাবে ইনফরমেশন এবং মিসইনফরমেশনের একটি অসমসত্ব মিশ্রণে এসব প্রশ্নের উত্তরের নানা ভার্সন ইতোমধ্যেই বাজারে চালুও রয়েছে। এ আর নতুন কি? আমার মতে প্যান্ডেমিক এবং ইনফোডেমিক দুটোই ভয়ঙ্কর।ঐতিহাসিকভাবে ইনফোডেমিক প্যান্ডেমিককে দীর্ঘায়িত করেছে, এবারের কোভিড প্যান্ডেমিকেও তার ব্যতিক্রম হয় নি।

কোভিড ভ্যাক্সিন নিয়ে ধর্মীয় গুরুদের মধ্যে দু’ধরনের মতবাদ রয়েছে। আসুন এর বৈজ্ঞানিক তথ্য থেকে আমরা বিষয়টি বুঝে নেই। সেটি বোঝার জন্যে আমাদেরকে প্রথমেই জেনে নিতে হবে একটি ভাইরাসের ভ্যাক্সিনের উপাদানগুলো কি কি?

ভ্যাক্সিনে প্রধান যে উপাদানটি থাকে তা হচ্ছে এক্টিভ ইনগ্রিডিয়েন্ট। এই এক্টিভ ইনগ্রিডিয়েন্ট হিসেবে কখনো ব্যবহার করা হয় জীবিত কিন্তু একবারে দুর্বল ক’রে দেওয়া ভাইরাস, অথবা মৃত ভাইরাস অথবা ভাইরাসের দেহের একটি অংশ। এই এক্টিভ ইনগ্রিডিয়েন্টটি এমনভাবে দেওয়া হয় যাতে এটি আপনার শরীরে প্রবেশ করালে আপনি অসুস্থ হবেন না, কিন্তু আপনার শরীর চিনে রাখবে এই শত্রুকে যাতে ভবিষ্যতে এই শত্রু অর্থাৎ এই ভাইরাস আক্রমণ করলে আপনার শরীর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। এই এক্টিভ ইনগ্রিডিয়েন্ট ছাড়া বিশেষ করে যেসব ভ্যাক্সিন ইনজেকশনের মাধ্যমে দেওয়া হয় সেগুলোতে পানি থাকে। এই ভ্যাক্সিনে বিশেষ করে যেসব ভ্যাকসিন জীবিত ভাইরাস থেকে তৈরীর করা হয় সেসব ভ্যাক্সিনকে সংরক্ষণ এবং স্থিতিশীল রাখতে ষ্টেবিলাইজার হিসেবে ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন ধরনের যৌগিক লবণ অথবা চিনি অথবা প্রাণীর দেহ থেকে নেওয়া জেলাটিন। ভ্যাক্সিন তৈরীর সময় দেখা হয় কোন্ ষ্টেবিলাইজার ব্যবহার করলে ঐ ভ্যাক্সিনটি সব চাইতে সুরক্ষিত থাকবে আর এর কার্যকারিতা অটুট থাকবে। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে এই জেলাটিন তৈরীর করা হয় কিভাবে? বিভিন্ন প্রাণীর যেমন: মাছ, মুরগী, গরু ও শুকরের দেহ থেকে কোলাজেন নামের এক ধরনের প্রোটিন নিয়ে তাকে হাইড্রোলাইজ করে অর্থাৎ পানির সঙ্গে মিশিয়ে একেবারে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণায় ভেঙে তা ভ্যাক্সিনে ব্যবহার করা হয়। শুকরের দেহ থেকে যে জেলাটিন তৈরীর করা হয় তাকে বলা হয় ‘পোর্সাইন জেলাটিন’।

বৃটেনে এ পর্যন্ত যে তিনটি ভ্যাক্সিনকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে (অক্সফোর্ড এষ্ট্রাজেনেকা,ফাইজার বায়োন্টেক ও মডেরনা) সেগুলোর সব উপাদানগুলো পড়লেই যে কেউ নিশ্চিত হতে পারবেন যে এগুলোর কোনোটিতেই পোর্সাইন জেলাটিন বা শুকরের দেহ থেকে তৈরী জেলাটিন নেই। এই তথ্যটি পাবলিক ডমেইন – যে কেউ চাইলে এই ভ্যাক্সিনের উপাদানগুলো কি তা পড়ে নিতে পারেন।

বৃটেনে ইমিউনাইজেশন প্রোগ্রামের মাধ্যে তিনটি ভ্যাকসিনে পোর্সাইন জেলাটিন রয়েছে: (১) শিশুদের মাম্পস, মিসেলস ও রুবেলা প্রতিরোধে এম-এম-আর ভ্যাক্সিনের একটি ভার্সনে (২) নেজাল স্প্রেয় ফ্লু ভ্যাকসিন যা বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে কোনো কোনো শিশুদের দেওয়া হয় ফ্লু থেকে রক্ষার জন্যে (৩) জোষ্টাভ্যাক্স যা বয়স্কদের শিঙেলস থেকে রক্ষা করার জন্য দেওয়া হয়।

নেজাল স্প্রেয় ভ্যাক্সিনের উপর পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখা গেছে খুব শক্তিশালী অনুবিক্ষণ যন্ত্র দিয়েও এই ভ্যাক্সিনে শুকরের দেহের ডি এন এ খুঁজে পাওয়া যায় নি। অর্থাৎ এটি যে শুকরের দেহ থেকে নেওয়া হয়েছে সেটি বোঝারই উপায় নেই।

মাত্র দু’বছর আগে ইন্দোনেশিয়াতে হঠাৎ করে শিশুদের মধ্যে মিসেলসের প্রকোপ বেড়ে গিয়েছিল সামাজিক মাধ্যমে ভ্যাক্সিন বিরোধী প্রচারণার ফলে। যারা এ ধরনের তথ্য সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়েছেন তাদের বেশীরভাগই সঠিক তথ্যগুলো জানতেন না। কাজেই মোরাল অফ টা ষ্টোরী হচ্ছে, আপনার খুব কাছের বন্ধুও যদি কোন তথ্য পাঠায় তাহলে যাচাই বাছাই না করে কাউকে ফরোয়ার্ড করবেন না, বিশেষ কোরে তা যদি হয় জনস্বাস্থ্যের জন্যে হুমকিস্বরূপ কোন তথ্য।।

(লেখক: মা ও শিশু বিশেষজ্ঞ, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ও সংবাদ পাঠক)

You might also like