খেলাঘর ইউকের আয়োজনে মা দিবস ও গুণীজন সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত

নিলুফা ইয়াসমীন হাসান
বার্তা সম্পাদক, সত্যবাণী

লন্ডন: পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম মধুর শব্দ ‘মা‘। শব্দটি ছোট হলেও এর ব্যাপ্তি অনেক। মা হলো প্রত্যেক সন্তানের কাছে সবচেয়ে নিরাপদ ও শান্তির আশ্রয়। মায়ের সম্মানে তাঁরই চরণে নত সবাই, এই উপলব্দি ও ভালবাসায় লন্ডনে শিশু সংগঠন খেলাঘর এর প্রাক্তন সদস্যরা সন্তান এবং মায়েদের নিয়ে পালন করেছে মা দিবস।স্বনামধর্মী সঙ্গীত শিল্পী গৌরী চৌধুরী ও অন্যান্য শিল্পীদের সমবেত কন্ঠে ‘পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়/ ও সেই চোখে দেখা, প্রাণের কথা, সে কি ভোলা যায়/ আয় আর একটিবার আয় রে সখা, প্রাণের মাঝে আয়/ মোরা সুখের দুখের কথা কব, প্রাণ জুড়াবে তায়‘ গানের মাধ্যমে গত ১৯ শে মার্চ রোববার পূর্ব লন্ডনের ব্রাডি আর্টস সেন্টারে মা দিবস পালন, খেলাঘর সংগঠন নিয়ে স্মৃতিচারণমূলক আলোচনা, শিশু-কিশোরদের চিত্রাঙ্গন প্রতিযোগীতা, গুণিজন সবংর্ধনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়।

সৈয়দ জাফর ও এরিনা সিদ্দিকীর প্রাঞ্জল উপস্থাপনায় প্রথমেই সূচনা বক্তব্য রাখেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শাহাব উদ্দিন বাচ্চু। মার্চ মাসে মহান স্বাধীনতা দিবস, মা দিবস এবং আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষ্যে শুভেচ্ছা জানিয়ে তিনি খেলাঘরের ইতিহাস তুলে ধরে বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে শিশু-কিশোর সংগঠন খেলাঘরের সংযোগ জড়িয়ে আছে। শিশু-কিশোরদের শারিরীক, মানসিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের ক্ষেত্রে নিরলস কাজ করে তাদেরকে ভবিষ্যতের যোগ্য এবং সচেতন নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার পথে সব ভালো কাজের একনিষ্ঠ অংশীদার হয়ে আছে খেলাঘর। মহান মুক্তিযুদ্ধের আগে ও পরে প্রগতিশীল সব আন্দোলন-সংগ্রামে সংগঠনভাবে খেলাঘর এবং খেলাঘরের নেতাকর্মীরা অত্যন্ত সক্রিয় ও কার্যকর অবদান রেখেছেন এবং এখনো রাখছেন। প্রধান বক্তা প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মাহমুদ আব্দুর রউফ বলেন, খেলাঘরের জন্ম ১৯৫২ সালের ২রা মে। তবে, প্রকৃত শিশু-কিশোর সংগঠন বলতে যা বুঝায়, ঠিক সেভাবে খেলাঘর সৃষ্টি হয়নি। এর সৃষ্টিতেও সৃজনশীলতার ছোঁয়া আছে। পঞ্চাশের দশকে ‘দৈনিক সংবাদ‘ এর সাপ্তাহিক শিশু সাহিত্য পাতার নাম ছিল ‘খেলাঘর‘। সেইসময়ে একদল তরুণ ও উদীয়মান লেখক নিয়মিত খেলাঘর পাতায় লেখালেখি শুরু করেন। সংবাদ কার্যালয়ে তাঁরা জমায়েত হতেন। এইভাবেই তাদের মধ্যে খেলাঘরকে একটি সংগঠনে রূপ দেওয়ার চিন্তা শুরু হয়।এক পর্যায়ে সংগঠন গড়ে উঠে। এইভাবেই চলতে থাকে খেলাঘরের এগিয়ে যাওয়া।

আব্দুর রউফ আরো বলেন, খেলাঘরের সবচেয়ে বড় অবদান হলো, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে পুরো সংগঠনই ঝাঁপিয়ে পরেছিল স্বাধীনতা যুদ্ধে। খেলাঘরের প্রথম যুগের কর্মীদের অনেকেই ঐতিহাসিক ভাষা আন্দেলোনেও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন।
রেডব্রিজ কাউন্সিলের মেয়র কাউন্সিলর জোসনা রহমান খেলাঘরের উত্তর উত্তর সমৃদ্ধি কামনা করে বলেন, ছোটবেলায় খেলাঘরের সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম বলে আজকে সমাজের জন্য, মানুষের জন্য কাজ করতে পারছি। রাজনীতিতে তাঁর এই অবস্থানে আসার জন্য খেলাঘরের শিক্ষা কাজে লেগেছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আ্যালামনাই ইন দ্য ইউকের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি প্রশান্ত পুরকায়স্থ বলেন, স্বাধীনতার পর খেলাঘরের মূল গান হয়ে দাঁড়ায় ‘এসো গড়ি খেলাঘর, এসো গড়ি বাংলাদেশ। এক সময় সংবাদের সম্পাদক বজলুর রহমান খেলাঘরের পরিচালকের (খেলাঘরের ভাইয়া) দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি খেলাঘরকে সমাজভিত্তিক শিশু সংগঠনের দিকে নিয়ে যান। শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের আন্দোলন এ সময় খেলাঘরের মৌলিক চেতনা হয়ে উঠে। দৈনিক সংবাদের খেলাঘর পাতায় তাঁর নিজের লেখা প্রকাশিত হওয়ার কথাও স্মরণ করেন প্রশান্ত পুরকায়স্থ।রাজনীতিবিদ মারুফ চৌধুরীও খেলাঘরের সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততার কথা স্মরণ করে বলেন, দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনে এমন কোন বিশিষ্ট ব্যক্তি নেই, যিনি কোন না কোনভাবে খেলাঘরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হননি। এটা খেলাঘরের সাফল্যের একটি দিক। খেলাঘর সংগঠনের মা দিবস পালন অনুষ্ঠানে অনেক মায়ের উপস্থিতিতে তিনি অভিভূত হয়েছেন বলে উল্লেখ করেন।

অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে দুজন প্রাক্তন খেলাঘর কর্মীকে তাঁদের স্ব স্ব ক্ষেত্রে অবদানের জন্য সংগঠনের পক্ষ থেকে এ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়।প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী এবং গানের শিক্ষক গৌরী চৌধুরীর হাতে সম্মাননা তুলে দেন প্রশান্ত পুরকায়স্থ ও শাহাবুদ্দিন আহমেদ বাচ্চু। এ্যাওয়ার্ড প্রাপ্তির পর সঞ্চালক এরিনা সিদ্দিকীর প্রশ্নের জবাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে গৌরী চৌধুরী বলেন, ছয় বছর বয়সে সিলেটে খেলাঘরের সাথে তিনি সম্পৃক্ত হয়েছেন। পঁয়ত্রিশ বছর ধরে যে বাংলা গানকে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় করে তোলার আন্দোলনের সাথে কাজ করছেন সেটা খেলাঘরেরই অবদান। তিনি লন্ডনে খেলাঘরের আদলে শিশুদের জন্য সংগঠন গড়ে তুলতে চান বলেও উল্লেখ করেন।প্রাক্তন খেলাঘর কর্মী লেখক, গবেষক ও পরিবেশ আন্দোলন কর্মী সৈয়দ ইকবালের হাতে সম্মাননা তুলে দেন মেয়র কাউন্সিলর জোসনা রহমান ও মাহমুদ আব্দুর রউফ। পরিবেশের উপর সৈয়দ ইকবালের লেখা সদ্য প্রকাশিত বই সম্পর্কে সঞ্চালক সৈয়দ জাফরের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন সৈয়দ ইকবাল। বিশ্বে পরিবেশ দূষণের ভয়াবহ অবস্থা সম্পর্কে তিনি বিস্তারিত তুলে ধরেন। সৈয়দ ইকবালের সঙ্গে প্রশ্নোত্তর পর্বে আলোচনায় আরো অংশ নেন তাঁরই সহকর্মী মাইকেল ডিকিন।

অনুষ্ঠানের তৃতীয় পর্বে কেক কেটে মা দিবস উদযাপন করা হয়। দিবস উপলক্ষ্যে কিশোর সৈয়দ তাইসির মা‘কে নিয়ে বক্তব্য রাখেন। একটি সন্তানকে শিশুকাল থেকে বড় করে তুলতে মায়ের যে জীবন-সংগ্রাম তা বিস্তারিত সুন্দরভাবে তুলে ধরে সৈয়দ তাইসির। মায়েদের পক্ষ থেকে সৈয়দ তাইসিরের চমৎকার উপস্থাপনার জবাবে সাংবাদিক নিলুফা হাসান পৃথিবীর সকল মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, সকল দুঃখ-কষ্টে, আনন্দে, সাফল্যে একমাত্র নিঃস্বার্থ সাথী হলেন মা। মায়ের তুলনা শুধুই মা। মায়ের শিক্ষাই শিশুর ভবিষ্যতের বুনিয়াদ, মা-ই হচ্ছেন শিশুর সর্বোৎকৃষ্ট বিদ্যাপীঠ। মায়ের কোলে মাথা রাখলে যে শান্তি তা আর কোথায়ও খুঁজে পাওয়া যায়না। নিলুফা হাসানের মাকে নিয়ে আবেগঘন বক্তব্যের সময়ে উপস্থিত সবাই তাঁদের নিজের মায়ের কথা মনে করে আবেগে আপ্লুত হয়ে পরেন।মা দিবসে মায়েদের নিয়ে এই চমৎকার আয়োজন করায় তিনি খেলাঘরকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, প্রত্যেকটা দিবস পালনেরই একটা তাৎপর্য আছে, মা দিবস পালনও এর ব্যতিক্রম নয়। নিলুফা হাসান মা দিবসের ইতিহাস তুলে ধরে বলেন, প্রত্যেকটি দেশের ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে বিভিন্ন তারিখে মা দিবস উদযাপিত হয়। চারশ বছর আগে থেকেই যুক্তরাজ্যে মাদারিং সানডে পালনের সূত্রপাত হয়। বর্তমানে যুক্তরাজ্যে এটি মাদার্স ডে বা মা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। খেলাঘরের পক্ষ থেকে সকল মা-কে ক্রেস্ট প্রদান করা হয়। হাসনীন চৌধুরী, আমেনা হক, মাহফুজা তালুকদার, হেলেন ইসলাম ও এম সি মেরীন মায়েদের হাতে ক্রেস্ট তুলে দেন।শিশু-কিশোরদের চিত্রাঙ্গণ প্রতিযোগিতায় সকল প্রতিযোগীকে পুরষ্কৃত করা হয়। পুরষ্কার হিসেবে রাইনার হাতে ক্রেস্ট তুলে দেন কাউন্সিলর সামসুল ইসলাম। তাসকিন এর হাতে ক্রেস্ট তুলে দেন কবি ও সাংবাদিক হামিদ মোহাম্মদ। নাশিতা নূর, রাহা দেওয়ান সাঈদ, আরশি চৌধুরী, অনিন্দি চৌধুরী, সাজ্জাদ আল রাজ্জাক, আররাদ দেওয়ান, আলমীর বেহ্্ফার, মান্না মেহ্্ভনি, ওয়াজেদ সুহা রাজ্জাক ও তাহির সাঈদ এর হাতে ক্রেস্ট তুলে দেন যথাক্রমে ব্যারিস্টার মাহারুন আহমেদ মালা, ব্যারিস্টার এম কিউ হাসান, ব্যারিস্টার কেজিবি কনক, সুলতানা নাহার শেলী, এমদাদ তালুকদার এমবিই, মোহাম্মদ হেলাল আহমেদ, সুরিদ রাজ্জাক, সৈয়দ আনিসুজ্জামান, সৈয়দ হামিদুল হক ও নূর ঊদ্দিন আহমেদ।

অনুষ্ঠানের শেষ পর্বে ছিল মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এতে গান পরিবেশন করেন গৌরী চৌধুরী ও তাঁর দুই শিক্ষার্থী শুভাঙ্গী ও শাওন, শিবলু রহমান, হেলেন ইসলাম, নূরুল ইসলাম, ইভা আহমেদ, তামান্না ইকবাল, সালেহ মওসুফ, মোস্তফা কামাল মিলন ও রীপা রকিব। আবৃত্তি করেন ব্যারিস্টার এম কিউ হাসান ও লেনিন হক। নৃত্য পরিবেশনায় ছিলেন তোড়া দে। সংগত করেছেন প্রীতম এবং পাপ্পু।অনুষ্ঠানকে সাফল্যমন্ডিত করতে আরো যারা কাজ করেছেন তারা হলেন, এহসানুল হক সুমন, নাজমুল ইসলাম বিপ্লব, শাহেদ ইউনুস, মন্জুর উদ্দিন, সৈয়দ আদিত্য হক, আহমাদুর রহমান ও আরো অনেকে। সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে সংগঠনের পক্ষে আবু সুয়েব তানজাম অনুষ্ঠানের ইতি টানেন। সবশেষে উপস্থিত সকলের অংশগ্রহণে জাতীয় সংগীত গেয়ে অনুষ্ঠানের পরিসমাপ্তি হয়।

You might also like