গ্যাস সংকটে বন্ধ শাহজালাল সারকারখানার উৎপাদনঃ ৭৭৯ কোটি টাকা দেনা

সিলেট অফিস 
সত্যবাণী
গ্যাস সংকটে ১ মাসের বেশী সময় ধরে বন্ধ রয়েছে দেশের বৃহৎ ইউরিয়া সার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার শাহজালাল ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিঃ (এসএফসিএল)। ইউরিয়া সার উৎপাদনের অন্যতম কাঁচামাল প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েছে এই বৃহৎ প্রতিষ্ঠানটি।
গ্যাস সরবরাহ করে কবে নাগাদ সংকট কাটবে এরকম সরকারি কোনো উদ্যোগের খবর না পাওয়ায় সার কারখানার উৎপাদন নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চিয়তা। এবার নিয়ে চলতি অর্থবছর দু’’দফায় উৎপাদন বন্ধের কবলে পড়েছে সার কারখানাটি। আধুনিক ওই সার কারখানা দীর্ঘদিন এভাবে বন্ধ থাকলে এর স্বয়ংক্রিয় মেশিনগুলোতে ত্রুটি দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কাও রয়েছে।
ফেঞ্চুগঞ্জ থেকে সংবাদদাতা জানান, বাপেক্সের নিয়ন্ত্রণাধীন জালালাবাদ গ্যাস জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করে দিলে গত ১৩ মার্চ থেকে বন্ধ হয়ে যায় শাহজালাল সার কারখানার উৎপাদন। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় ইতিমধ্যেই ১২৫ কোটি টাকা মূল্যের প্রায় ৫০ হাজার টন সার উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। শাহজালাল সার কারখানা ফের কবে চালু হবে তা সঠিক করে কেউ বলতে পারছেন না।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, উৎপাদনক্ষম শাহজালাল সার কারখানা জ্বালানি সংকটে বন্ধ রাখার ফলে অর্থবছরে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না । চলতি অর্থবছর শাহজালালের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ ছিল ৩ লাখ ৮০ হাজার টন।
১২ মার্চ পর্যন্ত এ কারখানায় উৎপাদন হয়েছে প্রায় ২ লাখ ৪০ হাজার টন। বিদ্যমান পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে ২ মাস পর আগত নতুন অর্থবছরেও এর বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন সংশ্লিষ্টরা।

গ্যাস সরবরাহ বন্ধ প্রসঙ্গে বাপেক্সের পরিচালক (অপারেশন) প্রকৌশলী কামরুজ্জামান জানান, শাহজালাল সার কারখানার জন্য বর্তমানে গ্যাস সরবরাহের বরাদ্দ নেই, তাই বন্ধ করা হয়েছে। মন্ত্রণালয় বরাদ্দ দিলে গ্যাস সরবরাহ পুনরায় দেয়া হবে। শাহজালাল সার কারখানার কাছে জালালাবাদ গ্যাসের বিপুল বকেয়া পাওনা জমা হয়েছে। সরকার গ্যাসের মূল্য পুনঃনির্ধারণ করে প্রতি ঘনমিটার ১৬ টাকা করলেও শাহজালাল সার কারখানা আগের দর ঘনমিটার প্রতি ৪ টাকা করে পরিশোধ করছে। ফলে বিপুল পাওনা জমা পড়েছে শাহজালাল ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিঃ’র কাছে। গ্যাস সরবরাহের ব্যাপারে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে তিনি জানান।
শাহজালাল ফাটিলাইজার কোম্পানি লিঃ’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক জিয়াবুল হোসেন জানান, সার কারখানা শুধুমাত্র গ্যাসের জন্যই বন্ধ আছে। গ্যাস পেলেই পুনরায় কারখানা চালু করা হবে। এ ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ করা হচ্ছে।
জালালাবাদ গ্যাসের পাওনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিষযটি সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের সিদ্ধান্তের ব্যাপার। গ্যাসের মূল্য ইউনিট প্রতি ৪ টাকা থেকে ১৬ টাকা করা হয়েছে। শাহজালাল সার কারখানায় বর্তমানে প্রতিটন সার উৎপাদনে খরছ হয় প্রায় ৩৬ হাজার টাকা। কিন্তু সরকার নির্ধারিত প্রতিটন সারের বিক্রয় মূল্য ২৫ হাজার টাকা। প্রতি টনে প্রায় ১১ হাজার টাকা ঘাটতি হয়। অন্তত এই ঘাটতি কীভাবে পুষিয়ে নেয়া যায় সেই চেষ্টায় শিল্প, কৃষি এবং অর্থ মন্ত্রণালয় কাজ করে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, গ্যাসের মূল্য ইউনিট প্রতি ৪ টাকা দর দিয়েই উল্লেখিত ঘাটতি। এর বেশি দিলে সার কারখানার ফান্ডে কোনো টাকাই থাকবে না। সার কারখানা পুনরায় চালুর ব্যাপারে এখন পর্যন্ত তার কাছে কোনো তথ্য আসেনি বলেও তিনি জানান। শাহজালাল সার কারখানার জিএম (একাউন্ট) মো: আব্দুল বারিক জানান, প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের মূল্য ১৬ টাকা ধার্য্য করা হয়েছে। জুন ২০২২ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত জালালাবাদ গ্যাস শাহজালাল ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিঃ’র কাছে বকেয়া পাওনা পাবে ৭৭৯ কোটি টাকা। শাহজালাল সার কারখানার উৎপাদনের সফলতা নিয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, নির্মাণের পর এ পর্যন্ত শাহজালাল ফার্টিলাইজার কোম্পানি সরকারের কোষাগারে সার বিক্রি করে অর্থ জমা দিয়েছে ৫৫৫ কোটি টাকা।
প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন বিভাগ সুত্র জানায়, বর্তমানে দৈনিক ১৩-১৪শ’’ টন ইউরিয়া উৎপাদন হয় শাহজালাল সার কারখানায়। নির্মাণের পর ২০১৬ সালে শাহজালাল সার কারখানা পুরোদমে উৎপাদনে যায়। যাত্রার পর থেকে এ সার কারখানায় নিরবচ্ছিন্ন উৎপাদন দিয়ে আসছিল।
জানা যায়, চলতি অর্থবছরের অক্টোবরে শাহজালাল সার কারখানার বিদ্যুতের সাবস্টেশনে গোলযোগ থেকে সৃষ্ট ফ্লাশিংয়ে কারখানার পাওয়ার হাউজের বয়লার শাটডাউন হয়ে পুরো সার কারখানার সব ক’টি প্ল্যান্ট বন্ধ হয়ে যায়। ওই সময় একটানা ৩৩ দিন বন্ধ ছিল সার কারখানার উৎপাদন।
বিশেষজ্ঞ মহলের মতে, বাংলাদেশে বিদ্যমান সার কারখানাগুলো উৎপাদনোক্ষম রাখা দরকার। কারণ দেশে একটন ইউরিয়া সার উৎপাদনে খরচ হয় ৩৫-৩৬ হাজার টাকা। অপরদিকে বিদেশ থেকে ইউরিয়া আমদানি করতে প্রতি টনের খরছ হয় ৬০-৬৫ হাজার টাকা।
ফেঞ্চুগঞ্জ ডিগ্রি কলেজের প্রাক্তন জিএস স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল মতিন জানান, ফেঞ্চুগঞ্জে পুরাতন সার কারখানার স্থলে একটি নতুন সার কারখানা স্থাপন ছিল এই অঞ্চলের মানুষের প্রাণের দাবি। দীর্ঘ প্রতীক্ষা ও অনেক ত্যাগ-তীতিক্ষার পর প্রয়াত এমপি মাহমুদ উস-সামাদ চৌধুরীর প্রচেষ্ঠা ও প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিকতার ফসল এই শাহজালাল সার কারখানা। দেশে সারের চাহিদা বিবেচনা করে সিলেটবাসীর প্রাণের এই প্রতিষ্ঠান নবনির্মিত শাহজালাল সার কারখানাকে যেকোনো মূল্যে টিকিয়ে রাখতে সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করেন তিনি।

You might also like