চাঁদাবাজিতে ‘বেপরোয়া’ বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ি
চঞ্চল মাহমুদ ফুলর
সত্যবাণী
সিলেট থেকেঃ নানা বিতর্কের পরও থেমে নেই সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ (এসএমপি)’র বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যদের চাঁদাবাজি। এ ফাঁড়ির আওতাধীন অস্থায়ী ৬শ’ ভাসমান হকারের কাছ থেকে প্রতিদিন লক্ষাধিক টাকা ‘চাঁদা’ আদায় হচ্ছে মর্মে সরেজমিন অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে। আর এই চাঁদা উত্তোলনের দায়িত্বে রয়েছে চিহ্নিত কিছু লাইনম্যান (দালাল)। তবে, চাঁদাবাজির সঙ্গে নিজেদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি অস্বীকার করেছে পুলিশ। আইনজ্ঞরা বলছেন, চাঁদা আদায় নিয়েই এই ফাঁড়িতে আলোচিত রায়হান হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়। এরপরও এখানকার দায়িত্বরতরা শোধরাচ্ছে না।
ফুটপাতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভাসমান হকার এবং স্থায়ী ব্যবসায়ীদের দোকানের সামনের ফুটপাত দখল করতে দেখা যায়, নগরির বন্দরবাজার, জিন্দাবাজার, রাজা ম্যানশন, লালদিঘীরপাড়, কোর্টপয়েন্ট, জেলা পরিষদ প্রাঙ্গণ, হাসান মার্কেট প্রাঙ্গণ ও ক্বিনব্রিজের নিচের সুরমা নদীর পাড় ঘেঁষা এলাকায়। ফুটপাতের এসব ভাসমান হকাররা বছরের পর বছর ধরে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির জন্য আশীর্বাদ হয়ে আছে। যারাই ফাঁড়ির দায়িত্বে আসেন তারাই কিছুদিনের মধ্যে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যান। এসব কারণে বন্দরবাজার ফাঁড়িটি বারবার আলোচনায় আসে, বিতর্কিত হয় নানামহলে। তবে সবশেষে রায়হান হত্যার পর ফাঁড়িটি দেশব্যাপী তুমুল সমালোচনার মুখে পড়ে।অনুসন্ধানে জানা গেছে, লালদিঘীরপাড় থেকে শুরু হয়ে পোস্ট অফিসের মূল ফটক, রাজা জিসি স্কুল ফটক, মধুবন থেকে করিমউল্লাহ মার্কেট হয়ে বঙ্গবীর ওসমানী শিশু উদ্যান, সিটি কর্পোরেশন ফটক থেকে একেবারে বাংলাদেশ ব্যাংকের মূলফটক পর্যন্ত দীর্ঘ জায়গা জুড়ে বিস্তৃত ফুটপাতের ভাসমান হকারদের পসরা সাজানো থাকে। দীর্ঘ এই সীমানার মধ্যে প্রতিদিন প্রায় ৬ শতাধিক ভাসমান হকার বসেন। মসলা থেকে শুরু করে মাছ, সবজি, ফলমূল, ডিম, চা ও কাপড় সবকিছুই বিক্রি হয় ফুটপাতে। এই তালিকার বাইরে ছোট ছোট আরো অনেক হকার আছেন, যারা বন্দী হয়ে আছেন পুলিশের চাঁদাবাজির জালে।
বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জের বর্তমান দায়িত্বে আছেন এসআই সাজিদুল। টুআইসি হিসেবে রয়েছেন নিশু। এছাড়া ফাঁড়িতে রয়েছেন এএসআই ৬জন, সহকারী এএসআই ১জন এবং ২০জন কনস্টেবল।অভিযোগ রয়েছে, ইনচার্জ থেকে শুরু করে কনস্টেবল পর্যন্ত চাঁদার ভাগ-বাটোয়ারা হয়। তবে সবগুলো ফুটপাতের লাইনম্যানের তত্ত্বাবধানে রয়েছেন ফাঁড়ির এএসআই উৎপল। লাইনম্যানরা প্রতিদিন টাকা উত্তোলন করে তার কাছে জমা দেন। তৎপরবর্তীতে একের পর এক হাত বদল হয়। উৎপলের পাশাপাশি এএসআই মুস্তাফিজও এই দায়িত্ব পালন করে থাকেন। বন্দরবাজার-জিন্দাবাজারের কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, ফাঁড়ির সাথে সিলেট সিটি কর্পোরেশন (সিসিক)-এরও কয়েকজন কর্মকর্তা এই চাঁদাবাজির সাথে জড়িত রয়েছেন।তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, বন্দরবাজার কিংবা নগরির যেকোনো ফুটপাতে নিজেদের ইচ্ছেমতো কোনো হকার বসতে পারেন না। এজন্য সিটি কর্পোরেশন, বন্দরবাজার ফাঁড়ির লোকজনকে ‘ম্যানেজ’ করতে হয়। এই অনুমতির একমাত্র মাধ্যম হলো ‘লাইনম্যান’। ফুটপাতের দোকানীদের নিয়ন্ত্রণ করা, চাঁদা তোলা থেকে শুরু করে সব ধরনের যোগাযোগের জন্য লাইনম্যান হলেন মাঠপর্যায়ের লোক। সাধারণত প্রতিদিন সন্ধ্যার পর থেকে রাত দশটার মধ্যে চাঁদা তোলা হয়।
আলাপকালে সংশ্লিষ্টরা জানান, নগরিতে ফুটপাতের সংখ্যা বাড়ার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণও রয়েছে। তারমধ্যে একটি হচ্ছে প্রধানবাজারকে কেন্দ্র করে লোকসমাগম। অন্যদিকে শহরকে ফুটপাত মুক্ত রাখতে ২০২০ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে হকার্স মার্কেটের ভেতরে একটি বাজারের ব্যবস্থা করে দেয়া হয়। সেখানে তালিকা করে হকারদের বসার ব্যবস্থা করে দেয় সিসিক। শুরুতে কিছুদিন হকাররা ওই মার্কেটে বসলেও ক্রমশ সেখানে তাদের সংখ্যা কমতে থাকে। লোকসমাগম বেশি না হওয়ায় অনেকে আবার ফিরে আসেন বন্দরবাজারের ফুটপাতে। আর সেই আসা ফাঁড়ির ‘চাঁদাবাজি’ বাড়িয়ে দিয়েছে।‘অস্থায়ী মার্কেটে’ বসানো সিসিকের করা এই তালিকা নিয়েও হকারদের একটি বড় অংশের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। সেই ক্ষোভের মধ্যে উস্কানি দেন সরকারি ও বিরোধী দলের নামধারী স্থানীয় কিছু চাঁদাবাজ। এ নিয়ে হকাররা ৩ ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন। একপক্ষ বেশি সুবিধার আশায় মেয়র আরিফের পক্ষ নেয়, আরেক পক্ষ বিরোধিতা শুরু করে। এই পক্ষের সঙ্গে যোগ দেন লাইনম্যান ও চাঁদার টাকার সুবিধাভোগীরা।
সিলেটের বিশিষ্ট আইনজীবী, জেলা বারের সাবেক সভাপতি ই ইউ শহীদুল ইসলাম শাহীন জানান, ‘এই অভিযোগ আমাদের কাছেও আসে সবসময়। এইসব অপরাধের কারণেই মূলত ২০২০ সালে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে সে সময়ের ফাঁড়ি ইনচার্জ আকবর হোসেন ভুঁইয়ার হাতে জীবন দিতে হয়েছে তরুণ রায়হানকে। আমরা ভেবেছিলাম সেই ঘটনার পর তাদের চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্ম নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। কিন্তু আসেনি, দিন দিন তারা আরো বেপরোয়া হয়ে যাচ্ছে। পুলিশ সুপার অফিসের নাকের ডগায় এমন কর্মকান্ড দায়সারাভাবে নেয়া যাবে না। তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া দরকার।’
সিলেট মহানগর ব্যবসায়ী ঐক্যকল্যাণ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. নাজমুল হক জানান, ‘প্রশাসনের নাকের ডগায় কর্মকান্ড চলছে, অথচ কেউ কথা বলছে না। আমরা চাই সব ধরনের চাঁদাবাজি বন্ধ করে দেয়া হোক। চাঁদাবাজি বন্ধ হলে, শহরও সুন্দর হবে। আর ফুটপাত দখল করা ভাসমান হকারদের উচ্ছেদ করলে নগরির প্রতিটি বিপনী বিতান বা মার্কেটে স্বাভাবিক ভাবেই ক্রেতাদের ভীড় হবে।’
এ বিষয়ে সিটি মেয়রের সাথে কয়েকবার কথা হয়েছে বলেও জানিয়েছেন সিলেট চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি এটিএম সুয়েব। তিনি বলেন, ‘চাঁদাবাজি বন্ধ করার দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের। তবে মেয়রের পক্ষে একা সম্ভব নয়। কারণ এটি পুরনো সিন্ডিকেট। বন্ধ করতে মেয়র, প্রশাসনসহ সব মহলের সহযোগিতা দরকার। এককভাবে কেউ বন্ধ করতে পারবে না।’
প্রসঙ্গে সিসিক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, ‘চাঁদাবাজির সাথে সিটি কর্পোরেশনের কেউ জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। আর বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখবো।’
এক সময় লাইনম্যানের দায়িত্বে ছিলেন, এখন নেই এমন কয়েকজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই প্রতিবেদককে জানান, ‘পুলিশ কর্মকর্তারা সরাসরি হকারদের হাত থেকে চাঁদা নেন না। প্রতি রাতে টাকা তুলে লাইনম্যানদের পক্ষ থেকে ফাঁড়িতে নিয়ে দিতে হয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ কর্মকর্তারা বিশেষ ব্যক্তির মাধ্যমেও ভাগের টাকা সংগ্রহ করে নিয়ে যান।’
কোন লাইনে কতটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান ফটক থেকে কুদরত উল্লাহ মার্কেট পর্যন্ত শতাধিক অস্থায়ী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সিটি কর্পোরেশন ফটক থেকে হকার্স মার্কেটের মুখ থেকে ভেতর পর্যন্ত আরো আছে দেড় শতাধিক। তারপর জেলা প্রশাসকের ফটকের ফুটপাত থেকে জিন্দাবাজার হয়ে রাজা ম্যানশন পর্যন্ত দীর্ঘ লাইনে রয়েছে অন্তত ২ শতাধিক। মধুবন, দুর্গাকুমার পাঠশালা, করিম উল্লাহ মার্কেট হয়ে ওসমানী উদ্যান পর্যন্ত রয়েছে ৭০টি অস্থায়ী দোকান। অপরদিকে, জালালাবাদ পার্ক ফটক থেকে ক্বিনব্রিজের নিচ পর্যন্ত আরো শতাধিক দোকান রয়েছে। আছে হাসান মার্কেটের প্রথম গেইট (ডানপাশে) পর্যন্ত শুধু ফলের অন্তত ২০টি দোকান।
কোন লাইনে কত টাকা চাঁদা
জেলা প্রশাসকের ফটক থেকে জিন্দাবাজার হয়ে রাজা ম্যানশন পর্যন্ত প্রতিটি দোকান ৭০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দেয়। হাসান মার্কেটের ১ নম্বর গেইট থেকে ফলের দোকানপ্রতি তোলা হয় ১৫০ থেকে সর্বোচ্চ ২০০ টাকা, মধুবন থেকে করিমউল্লাহ মার্কেট প্রাঙ্গণের আশপাশ হয়ে শিশুপার্ক পর্যন্ত প্রতিটি অস্থায়ী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে তোলা হয় ১৫০ টাকা করে, সিটি কর্পোরেশনের মূল ফটকের আশপাশ এলাকা থেকে দোকানপ্রতি তোলা হয় ১০০ টাকা করে, সিটি সুপার মার্কেট থেকে পোস্ট অফিস পর্যন্ত কাঁচামালের প্রতি দোকান থেকে ১০০ টাকা, পেপার পয়েন্ট থেকে লালদিঘীরপাড় ভেতর পর্যন্ত প্রতি সবজি বিক্রেতার কাছ থেকে ৪০ টাকা, পেপার পয়েন্ট থেকে হাফিজ কমপ্লেক্স পর্যন্ত সবজি ও ফলের দোকান থেকে তোলা হয় ৫০ টাকা, বাংলাদেশ ব্যাংকের মূল ফটকের আশপাশ এলাকা থেকে জেলা পরিষদ ফটকের সামনে পর্যন্ত দোকানপ্রতি ১০০ টাকা, সার্কিট হাউসের মূল ফটকের সামনে চটপটি, চা বিক্রেতাদের প্রতি দোকান থেকে ৮০ টাকা, কোর্টপয়েন্ট, রেজিস্ট্রি মাঠ, কালীঘাট সড়কের ফুটপাতের প্রতি দোকান থেকে প্রতিদিন ৮০ টাকা করে উত্তোলন করা হয় মর্মে অভিযোগ রয়েছে।
চাঁদা উত্তোলনকারীদের নাম
চাঁদা উত্তোলনের দায়িত্ব পালন করছে ১০ জন লাইনম্যান। তারমধ্যে জেলা পরিষদের সামনে সুমন, বন্দরবাজার যাত্রী ছাউনীর আশপাশে মোমিন, জিন্দাবাজার একাংশে ‘লেংড়া’ কামাল, দুর্গাকুমার স্কুলের সামনে সাব্বির, পোস্ট অফিস এলাকায় দাঁড়িওয়ালা একরাম, সিটি কর্পোরেশনের সামনে গেদু, হাসান মার্কেটের সামনে উজ্জ্বল, জিন্দাবাজার মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সামনে ফারুক, ক্বিনব্রিজের নিচে রাসেল এবং চৌহাট্টা-আল হামরা এলাকায় চাঁদা তোলার দায়িত্ব পালন করছে মিজান।
এই হিসেবের বাইরে হকার্স মার্কেটের গলির ভেতরেও প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০ জনের কাছ থেকে চাঁদা উত্তোলন করা হয়ে থাকে। লাইনম্যানরা প্রতিদিন সন্ধ্যার পর থেকে চাঁদা উত্তোলন শুরু করে। রাত ১০টা পর্যন্ত কালেকশন চলে বিভিন্ন কৌশলে। ফুটপাতের ব্যবসায়ী ছাড়া প্রতিদিন আরো কয়েকটি উৎস থেকেও চাঁদা উত্তোলন করে লাইনম্যানরা। তার মধ্যে কোর্টপয়েন্ট এলাকায় রাতের পাহারাদারের বেতন বাবদ প্রতিদিন ৩০ টাকা করে অন্তত শতাধিক দোকান থেকে চাঁদা তোলা হচ্ছে। অন্যদিকে রাতের বেলা সিটি কর্পোরেশনের মূল ফটকের সামনে ‘সাজু’ নামে একজন সুপারভাইজার তুলছে ৫০০ টাকা করে। এই ৫শ’ টাকা লাইনম্যান একরাম ও উজ্জ্বলের কাছ থেকে প্রতিদিন সংগ্রহ করে থাকে সাজু।অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বন্দরবাজার ফাঁিড়র ইনচার্জ সাজিদুল জানান, ‘তিনি বা তাঁর কোনো কর্মী চাঁদার টাকা নেন না। তিনি তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেন।মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. নিশারুল আরিফ জানান, ‘এসবের সাথে তারা যাতে জড়িত না হয়, সেজন্য কঠোর নির্দেশনা দেয়া আছে। এরপরও যদি অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া যায় তাহলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।’