চোরাই চিনির দখলে সিলেটের হাট-বাজার

চঞ্চল মাহমুদ ফুলর
সত্যবাণী

সিলেট থেকেঃ অবৈধপথে আসা চিনি দখল করে নিচ্ছে সিলেটের হাট-বাজার। বাংলাদেশের চেয়ে ভারতে চিনির দাম কম থাকায় এর সুযোগ নিচ্ছে চোরাকারবারিরা। এতে দেশি ও আমদানি করা চিনির বিক্রি কমে গেছে। সংশ্লিষ্ট সিন্ডিকেট লাভবান হলেও সরকারি কোষাগারে কানাকড়িও জমা হচ্ছে না। সিলেটের প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র কালীঘাটে-ই দৈনিক প্রায় দেড় কোটি টাকার চোরাই চিনি কেনাবেচা হয় বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এরপর দেশীয় নানা ব্র্যান্ডের স্টিকারযুক্ত বস্তায় ভরে এসব চিনি পাঠানো হয় দেশের বিভিন্ন এলাকায়। চোরাচালানে আসা এসব চিনি স্থানীয়ভাবে ‘বুঙ্গার চিনি’ নামে পরিচিত।সীমান্ত এলাকার বাসিন্দা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, জেলার জৈন্তাপুর, জকিগঞ্জ, কানাইঘাট, গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ এবং বিয়ানীবাজার উপজেলার সীমান্তবর্তী শতাধিক পয়েন্ট দিয়ে চোরাই পণ্য সিলেটে প্রবেশ করে। সীমান্ত এলাকার অন্ততঃ ১ হাজার চোরাকারবারি এই অপকর্মে জড়িত। প্রায়ই চোরাই চিনি আটকের খবর পাওয়া গেলেও পাচারের পরিমাণের তুলনায় তা খুবই কম বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।

সীমান্ত এলাকার মানুষের অভিযোগ, একটি রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মী এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্য চোরাচালান চক্রের সঙ্গে যুক্ত।
জেলা পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, গত ১ জুলাই থেকে ১১ আগস্ট পর্যন্ত জেলার ৬ টি উপজেলা থেকে ১ হাজার ৪৩১ বস্তা ভারতীয় চিনি উদ্ধার করা হয়েছে। এসব বস্তায় ৭১ হাজার ৪৯ কেজি চিনি ছিল। এসব ঘটনায় ২৩টি মামলা হয় এবং পুলিশ ১৯ জনকে গ্রেপ্তার করে। বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, বিজিবি সিলেট সেক্টরের আওতাধীন সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার ৩টি ব্যাটালিয়ন সীমান্ত এলাকায় গত ১ জুলাই থেকে ১২ আগস্ট পর্যন্ত মোট ২ লাখ ৯ হাজার ২৫২ কেজি ভারতীয় চিনি জব্দ করে, যার দাম ২ কোটি ৮৮ লাখ ৪০ হাজার ৪৩৫ টাকা।ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য অনুযায়ী, আগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ‘ম্যানেজ করে’ সড়কপথে ভারতীয় চিনি কালীঘাটে নিয়ে আসা হতো। সীমান্তবর্তী এলাকার কিছু বাসিন্দা ‘লাইনম্যান’ হিসেবে চিনির বস্তাপ্রতি টাকা তুলে দিতেন। ৬ মাস ধরে একটি রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনের কয়েকটি পক্ষ এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়। গোয়াইনঘাটের জাফলং-তামাবিল- জৈন্তাপুর-হরিপুর সড়ক দিয়ে ট্রাকযোগে চিনি যখন সিলেট বাইপাস এলাকায় আসে, তখন ওই সংগঠনের কিছু কর্মী মোটরসাইকেল পাহারায় এসব ট্রাক কালীঘাটে পৌঁছে দেন। একইভাবে কোম্পানীগঞ্জ-সিলেট সড়ক দিয়ে আসা চোরাই চিনির ট্রাকগুলোকে সালুটিকর ও ধোপাগুল এলাকা থেকে পাহারা দিয়ে কালীঘাটে নিয়ে আসা হয়। এ জন্য ট্রাকপ্রতি ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা দিতে হয়।
সীমান্ত এলাকার বাসিন্দা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৬টি উপজেলার শতাধিক পয়েন্ট দিয়ে চোরাইপণ্য ঢুকছে। সবচেয়ে বেশি চিনি আসে গোয়াইনঘাটের সোনাটিলা, তামাবিল, বিছনাকান্দি, নলজুড়ি, পাদুয়া, পান্তুমাই ও সোনারহাট; জৈন্তাপুর উপজেলার মোকামপুঞ্জি, আলুবাগান, কেন্দ্রী, ডিবির হাওর, ফুলবাড়ী, ঘিলাতৈল, টিপরাখলা, কমলাবাড়ী, গোয়াবাড়ী, হর্নি, বাইরাখেল, কালিঞ্জিবাড়ী, লালাখাল গ্রান্ট, বালিদাড়া, তুমইর ও ইয়াং রাজা; কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বরমসিদ্ধিপুর, উৎমা ও তুরং এবং কানাইঘাট উপজেলার ডনা সীমান্ত দিয়ে।ভারতের কিছু ব্যবসায়ী ও বাসিন্দার সঙ্গে যোগসাজশ করে বাংলাদেশের চোরাকারবারিরা চিনি আনছেন। এ জন্য শ্রমিক নিয়োগ দেয়া হয়। শ্রমিকরা দিনরাতে সুযোগ বুঝে ৫০ কেজির চিনির বস্তাগুলো মাথায় করে সীমান্ত পার করেন। পরে নৌকা, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, ট্রাক কিংবা সিএনজিচালিত অটোরিকশা দিয়ে বিভিন্ন স্থানে নিয়ে মজুত করেন।

কালীঘাটের কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিদিন ২৫/৩০ ট্রাক আসে। একেকটি ট্রাকে গড়ে ৬৫ থেকে ৭০ বস্তা চিনি থাকে। সে হিসেবে কমবেশি ২ হাজার ১০০ বস্তা চোরাই চিনি এখানে বেচাকেনা হয়। এর বাইরে কালীঘাট ঘেঁষে থাকা সুরমা নদী দিয়েও প্রতিদিন অন্তত ৪০০ থেকে ৫০০ বস্তা চোরাই চিনি এখানে আনা হয়। পাইকারি ব্যবসায়ীরা প্রতি বস্তা ভারতীয় চিনি ৫ হাজার ৯০০ টাকায় কেনেন। সে হিসেবে প্রতিদিন এক থেকে দেড় কোটি টাকা চোরাচালানের চিনি কেনাবেচা হয়। পরে তা বাজারদরে খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন, যা আবার চলে যায় সিলেটের বিভিন্ন উপজেলা ও আশপাশের জেলায়।কালীঘাট এলাকার ৩জন চিনি ব্যবসায়ী জানান, দেশীয় ও আমদানির চিনি প্রতি ৫০ কেজির বস্তা তারা ৬ হাজার ২৪০ টাকায় কেনেন এবং তা পাইকারি দরে বিক্রি করেন ৬ হাজার ২৫০ টাকায়। অন্যদিকে চোরাচালানে আসা চিনির ৫০ কেজির বস্তা কিছু ব্যবসায়ী বর্তমানে ৫ হাজার ৮৫০ টাকায় কেনেন। চোরাচালান হয়ে আসা চিনির কারণে কালীঘাটে বৈধ চিনি বেচাকেনা অনেকটাই কমেছে। এতে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে।পাইকারি দরে তাঁরা এসব চিনি বিক্রি করেন ৫ হাজার ৯০০ টাকা থেকে ৬ হাজার টাকায়। সে হিসেবে বৈধ চিনিতে প্রতি বস্তায় লাভ হচ্ছে ১০ টাকা, চোরাচালানের চিনিতে প্রতি বস্তায় লাভ হচ্ছে ৫০ থেকে ১৫০ টাকা।এসএমপি কমিশনার মো. ইলিয়াছ শরীফ বলেন, চোরাচালানের চিনি আসে, এটা অস্বীকার করা যাবে না। তবে তা নির্মূল করতে বিজিবি, জেলা ও মহানগর পুলিশ মিলেই ব্যবস্থা নিচ্ছে। পুলিশের কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সিলেটের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, অভিযান সব সময় অব্যাহত আছে।বিজিবি সিলেটের অতিরিক্ত পরিচালক (অপারেশন) মেজর রাশেদ মাহমুদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সীমান্তে আমাদের নজরদারি অত্যন্ত কঠোর। এরপরও ২/১ টা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটছে। বিজিবির কোনো সদস্যের এমন অনৈতিক কর্মকা-ে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে অবশ্যই তাৎক্ষণিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

You might also like