জন্ডিস-ম্যালেরিয়া-ডেঙ্গু নিয়ে স্বাস্থ্য বিভাগের সতর্কতা  ক্ষতিগ্রস্ত ১২ হাজার নলকূপ, সংকট সুপেয় পানির সিলেটে বাড়ছে পানিবাহিত রোগ

চঞ্চল মাহমুদ ফুলর
সত্যবাণী

সিলেট থেকেঃ বন্যায় প্রায় ১২ হাজার নলকূপ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সিলেটের বন্যা কবলিত এলাকায় সুপেয় পানির সংকট চলছে। খাবার পানির পাশাপাশি পয়ঃনিষ্কাশন ও গোসলের পানিরও সংকট দেখা দিয়েছে। অনেক এলাকার পানি এখনো দুর্গন্ধযুক্ত। বন্যার পানিতে গোসল করে অনেকের চুলকানিসহ চর্মরোগের নানা উপসর্গ দেখা দিচ্ছে। ফলে, বন্যার পানি কমলেও বাড়ছে পানিবাহিত রোগ। বন্যাদুর্গত এলাকায় ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব বাড়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন সিলেটের ডেপুটি সিভিল সার্জন ও সিলেট সিটি কর্পোরেশনের (সিসিক) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা। বন্যার্তদের অন্তত আগামী এক সপ্তাহ বিশুদ্ধ পানি পানের পরামর্শ এ দুই চিকিৎসকের। এছাড়া, জন্ডিস-ম্যালেরিয়া নিয়েও উদ্বেগে রয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ।
ভুক্তভোগীরা যা বলেন কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ইছাকলস ইউনিয়নের পুটামারা গ্রামের বাসিন্দা তারা মিয়া জানান, বন্যার সময় তার ঘরে ছিল হাঁটুসমান পানি। এ কারণে বাড়ির নলকূপে পানি ঢুকে যায়। নলকূপটি ভেসে উঠলেও সেই নলকূপের পানিই তার বাড়ির লোকজন পান করছে। এ পানি ছাড়া বাড়ির লোকজনের আর বিকল্প কোন উপায় নেই। গ্রামের বেশিরভাগ মানুষও এভাবে ডুবে যাওয়া টিউবওয়েলের পানি পান করছে।সরেজমিনে দেখা গেছে, পুটামারা গ্রামের চারদিকে এখনো বন্যার পানি থৈ থৈ করছে। পুটামারাসহ আশপাশের শিবপুর, বিষ্ণুপুর, কলাপাড়া, বাগজুর, চেঙ্গাখই, দুর্গাপুর, পারকুল গ্রাম এলাকায়ও পানির একই অবস্থা। রাস্তা-ঘাট পানির নিচে। লোকজনের চলাচলের একমাত্র ভরসা নৌকা। গ্রামগুলোর চারপাশে জমে আছে আবদ্ধ পানি। এ পানি থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। পুটামারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সম্মুখে দাঁড়াতেই আঁচ করা গেল পানির দুর্গন্ধ। বিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা জানান, বন্যার আবদ্ধ পানি এখনো গ্রামটির চারপাশ ঘিরে আছে। আর এ পানি চরম দুর্গন্ধযুক্ত। বিদ্যালয়ের জনৈক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, শিক্ষার্থীরা এ পানি মাড়িয়েই বিদ্যালয়ে আসছে। এ কারণে শিক্ষার্থীদের চর্মরোগের আশংকা দেখা দিচ্ছে। ওই শিক্ষক জানান, আর্সেনিকের কারণে বন্যার আগ থেকেই তাদের স্কুলের টিউবওয়েল থেকে পানি উত্তোলন বন্ধ করে রাখা হয়েছে। ওই স্কুলে একটি ডিপ টিউবওয়েল বসানোর উদ্যোগ নেয়া হলেও এর নির্মাণকাজ এখনো শেষ হয়নি।শিবপুর গ্রামের ষাটোর্ধ্ব যতি বিশ্বাস জানান, বন্যায় তার বাড়ি-ঘর একেবারে ভেঙ্গে ফেলেছে। তিনি আশ্রয় নিয়েছেন পার্শ্ববর্তী একটি বাড়িতে। শুকনো খাবার দিয়ে কিছুদিন পার করেছেন। বর্তমানে কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের ত্রাণে তার সংসার চলছে। বাড়ি-ঘর ভেঙ্গে যাওয়ায় পরিবারের ৫ সদস্যকে নিয়ে খুব বিপদে আছেন বলে জানান তিনি।
জন্ডিস-ম্যালেরিয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন স্বাস্থ্য বিভাগ

বন্যার পর সিলেটে ডায়রিয়ার পাশাপাশি জন্ডিস-ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন সিলেট স্বাস্থ্য বিভাগ। এরই মধ্যে ডায়রিয়ায় সিলেটে প্রায় ৬২০জন লোক আক্রান্ত হয়েছেন। গত শুক্রবার একদিনে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন ৫৭জন। এখন পর্যন্ত জন্ডিস কিংবা ম্যালেরিয়ায় কেউ এখনো আক্রান্ত না হলেও এ বিষয়ে সার্ভিলেন্স শুরু করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ।সিলেটের ডেপুটি সিভিল সার্জন (ডিসিএস) ডা. জন্মেজয় দত্ত জানান, জন্ডিস পানিবাহিত রোগ। এছাড়া, আবদ্ধ পানি থেকে ম্যালেরিয়া কিংবা ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দিতে পারে। বন্যার সময় নলকূপ ডুবে যাওয়ায় বন্যার্ত অনেকেই পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ব্যবহার করে পানি পানি করেছেন। কিন্তু, এখন পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় অনেকেই প্লাবিত নলকূপ কিংবা ডিপ টিউবওয়েলের পানি পান করছেন। তিনি বলেন, অনেক সময় জীবানু মানুষের শরীরে ঢোকার পর ৫/৬দিন পর এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এ কারণে জন্ডিস, ক্রনিক ডিসেন্ট্রি দেখা দিতে পারে। তিনি বলেন, সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট ও জৈন্তাপুর এমনিতেই ম্যালেরিয়াপ্রবণ এলাকা। বন্যায় এ ৪ টি উপজেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ কারণে তারা এ ৪ উপজেলা নিয়ে সতর্কতাবস্থায় রয়েছেন। তিনি আরো বলেন, বন্যার পর চর্মরোগ তেমন দেখা না দিলেও বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আউটডোরে খোস-পাচড়ায় আক্রান্ত শিশুরা চিকিৎসা নিচ্ছে।

সব মিলিয়ে বন্যার্ত লোকজনকে পানি পানের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বনের তাগিদ ডিসিএস-এর। লোকজনকে বিশুদ্ধ পানি কিংবা ফুটিয়ে পানি পান করার পরামর্শ তার। পাশাপাশি স্বাভাবিক স্বাস্থ্যবিধি ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ওপরও জোর দেন তিনি।
সিসিকের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. জাহিদুল ইসলামও স্বীকার করেন সিসিক এলাকায়ও ডায়রিয়া বাড়ছে। সিসিকের প্রতিটি হেলথ ক্যাম্পে প্রতিদিন ৬/৭ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগী পাওয়া যাচ্ছে। পাতলা পায়খানা ও বমি বমি ভাব নিয়ে তারা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসছেন। আক্রান্তদের খাবার স্যালাইনসহ অন্যান্য পথ্য দেয়া হচ্ছে। তিনি জানান, নগরীতে এরই মধ্যে বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহের বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে। বন্যায় নগরীর অনেক গৃহস্থালি টিউবওয়েল ও ডিপ টিউবওয়েল পানির নিচে তলিয়ে যায়। এগুলো নিয়ে কিছু ঝুঁকি আছে জানিয়ে অন্তত ১সপ্তাহ এসব টিউবওয়েলের পানি পানের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ তার।ডিপিএইচই’র ক্ষতি ২০ কোটি টাকা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের (ডিপিএইচই), সিলেট-এর নির্বাহী প্রকৌশলী আলমগীর হোসেন জানান, বন্যায় সিলেট জেলা ১২ হাজার নলকূপের পাশাপাশি প্রায় ৭৮ হাজার শৌচাগার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর বাইরে জকিগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট উপজেলায় ৬ হাজার ৫০০ মিটার পানি সরবরাহের পাইপলাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সব মিলিয়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২০ কোটি টাকা।তিনি বলেন, বন্যার পানি অনেক এলাকা থেকে নেমে গেলেও বেশির ভাগ এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত নলকূপ ও শৌচাগার সংস্কার হয়নি। ফলে সুপেয় পানির পাশাপাশি মানুষজন স্যানিটেশনের সমস্যায় ভুগছেন। যেসব এলাকায় এখনো পানি রয়ে গেছে, সেখানেও একই সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে।

প্রসঙ্গক্রমে তিনি বলেন, সুপেয় পানির সংকট মেটাতে ডিপিএইচই মোবাইল ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের মাধ্যমে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করছে। জেলার কানাইঘাট, কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট উপজেলায় এ কার্যক্রম চলছে। এ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট প্রতি ঘণ্টায় ৬০০ লিটার পানি পরিশোধন করতে পারে। প্রতিদিন গড়ে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা এসব প্ল্যান্ট থেকে পানি বিতরণ করা হচ্ছে। এছাড়া, একটি ট্রিটম্যান্ট প্ল্যান্ট স্ট্যান্ডবাই রাখা হয়েছে। জেলা কার্যালয়ে সংরক্ষিত এ মোবাইল ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের মাধ্যমে নগরেও পানি সরবরাহ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।ডিপিএইচই সূত্র জানায়, কানাইঘাটে ১০ দিন এবং গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জে ৭ দিন ধরে এ কার্যক্রম চলছে।সূত্রমতে, জেলার গোয়াইনঘাট কানাইঘাট, জকিগঞ্জ, কোম্পানীগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ ও বিশ্বনাথ উপজেলার লোকজন বিশুদ্ধ পানির সংকটে রয়েছে। এছাড়া, সিলেট নগরীর কিছু এলাকায় বিশুদ্ধ পানির সংকট বিরাজ করছে।প্রসঙ্গত, গত ১১ মে থেকে সিলেটে বন্যা দেখা দেয়। বর্তমানে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। বর্তমানে সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর পানি বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

You might also like