জমি বুঝিয়ে দিচ্ছে না রেলওয়ে সিলেটের লালমাটিয়া বধ্যভূমি যেন ‘আবাদি ভূমি’
চঞ্চল মাহমুদ ফুলর
সত্যবাণী
সিলেট থেকেঃ মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার লালমাটিয়াতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাম্প ছিল। যেখানে প্রতিদিন বিভিন্ন স্থান থেকে মুক্তিকামী বাঙালিদের ধরে নিয়ে পাক হানাদার বাহিনী নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালাতো। পরে গর্ত খুঁড়ে মৃত ও গুলিবিদ্ধ মানুষদের মাটিচাপা দেয়া হতো।মুক্তিযুদ্ধের সময় এ এলাকা দিয়ে চলে যাওয়া রেললাইনের ঠিক পাশ ঘেঁষেই তৈরি করা হয়েছিল অন্তত ৫০ থেকে ৬০টি গণকবর। একেকটিতে গড়ে ২৫ থেকে ৪০ জনকে মাটিচাপা দেয়া হয়। এর বাইরেও অনেককে জীবন্ত কবর দেয়া হয়েছিল। তবে স্বাধীনতার ৫২ বছরেও সিলেটের লালমাটিয়া বধ্যভূমিটি অরক্ষিত পড়ে আছে, যাকে জেলার সবচেয়ে বড় গণহত্যার স্থান বলছেন মুক্তিযোদ্ধারা। শহীদ হওয়া ব্যক্তিদের স্মরণে এখানে এখন পর্যন্ত কোনো স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়নি।
বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সিলেট জেলা ইউনিট কমান্ডের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার, দক্ষিণ সুরমা উপজেলার বীর মুক্তিযোদ্ধা সুবল চন্দ্র পাল বলেন, স্বাধীনতার ৫১ বছর পেরিয়ে গেলেও লালমাটিয়া এলাকায় কোনো স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়নি। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক ও হতাশার। অথচ এটাই সিলেটের সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি হিসেবে পরিচিত। এখানে কয়েক হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল।বধ্যভূমির স্থানটিতে লাউগাছসহ বিভিন্ন সবজির চারা রোপণ করা আছে। রয়েছে আগাছাজাতীয় কিছু গাছও। স্থানটিতে কোনো ধরনের স্মৃতিফলক কিংবা স্মৃতিসৌধ নেই। সিলেটের সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি সম্পর্কে আশপাশের পথচারিরাও কিছু বলতে পারেননি।মুক্তিযুদ্ধ গবেষক অপূর্ব শর্মা বলেন, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী প্রতিদিন সিলেটের বিভিন্ন স্থান থেকে হাত ও চোখ বেঁধে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজনদের ধরে এনে এখানে গুলি করে কিংবা নির্যাতন করে হত্যা করত। এরপর স্থানীয় লোকদের দিয়ে জোর করে গর্ত করিয়ে লাশগুলো পুঁতে রাখত। গুলিতে প্রাণ হারাননি, এমন জীবন্ত মানুষকেও এখানে পাকিস্তানি সেনারা নির্মমভাবে মাটিচাপা দিয়েছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে এ বধ্যভূমিতে অর্ধশতাধিক গণকবরের সন্ধান পাওয়া গেছে। একেকটি গণকবরে কয়েক ডজন পর্যন্ত মানুষের কঙ্কালের সন্ধান পাওয়া যায়। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পৌঁছে দেয়ার স্বার্থেই এখানে একটি স্মৃতিসৌধ তৈরি করা প্রয়োজন।তিনি বলেন, আমি শহীদ হওয়া ব্যক্তিদের তথ্য ও পরিচয় জানতে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছি।
জানা যায়, বধ্যভূমির পাশে পাকিস্তানি সেনারা ৬টি বাংকার তৈরি করেছিল। সেখানে নারী নির্যাতনের মতো ঘটনাও ঘটেছে। এ ছাড়া প্রতিদিনই সিলেটের বিভিন্ন অঞ্চলের নিরীহ বাঙালিদের ধরে এনে অমানুষিক নির্যাতন চালানো হতো। জীবন্ত কবর দেয়ার পাশাপাশি অনেক মানুষকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে গণকবরও দেয়া হয়। এ ছাড়া পাশের কিছু ডোবাতেও অনেকের লাশ ফেলে দিয়েছিল পাকিস্তানি সেনারা।জেলা গণপূর্ত কার্যালয় সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী রিপন কুমার রায় বলেন, ’৭১ সালের বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও স্মৃতিসৌধ নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় সিলেট জেলার পাঁচটি বধ্যভূমিতে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর একটি দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল। এরপর ঠিকাদারও নিযুক্ত করা হয়। তবে ৪টি বধ্যভূমির কাজ শেষ হলেও জমি-সংক্রান্ত জটিলতায় লালমাটিয়া বধ্যভূমির কাজ ঠিকাদার শুরুই করতে পারেননি।নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, ১১ শতক জায়গার মধ্যে ৬৪ লাখ ৮২ হাজার টাকা ব্যয়ে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করার কথা ছিল। তবে বধ্যভূমির কিছু জায়গা পড়েছে রেলের জায়গায়। এ জায়গা এখনো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ হস্তান্তর করেননি। ফলে ভূমিসংক্রান্ত জটিলতায় স্মৃতিসৌধ নির্মাণের কাজ শুরু হয়নি। এ জটিলতা শেষ হলে দ্রুতই কাজ শেষ করা হবে।