জলমহাল ব্যবস্থাপনা নীতিমালা না মানায় হ্রাস পাচ্ছে দেশীয় মাছের উৎপাদন
সত্যবাণী
সিলেট অফিসঃ সুনামগঞ্জের হাওর-জলাশয় ও বিলে মানা হচ্ছে না জলমহাল ব্যবস্থাপনা নীতিমালা। সেচপাম্প দিয়ে অবাধে মাছ ধরায় সংকটাপন্ন অবস্থায় দেশীয় প্রজাতির মাছ। মা মাছ রক্ষায় অভয়াশ্রম তৈরি না করা, ভরাট হওয়া বিল-জলাশয় খনন না করাসহ মাছের প্রাকৃতিক উৎসের যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ না করায় বিপন্ন মৎস্য প্রজণন ব্যবস্থা। ফলে জেলায় দিন দিন কমে আসছে দেশীয় মাছের উৎপাদন। দেশী মাছের উৎপাদন বাড়ানো ও প্রজাতি রক্ষায় জলমহাল ব্যবস্থাপনা নীতিমালার যথাযথ বাস্তবায়নের দাবি হাওরের মৎস্যজীবীসহ সচেতন মহলের।
জেলা প্রশাসনের দেয়া তথ্য অনুযায়ী সুনামগঞ্জ থেকে সংবাদদাতা জানান, সুনামগঞ্জে ২০ একরের উর্ধ্বে ৪০৫টি এবং ২০ একরের নিচে ৬২৩টিসহ জেলায় ১০২৮টি জলমহাল রয়েছে। ২০ একরের উর্ধ্বের জলমহাল বিভিন্ন মেয়াদে উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ভূমি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ইজারা দেয়া হয়ে থাকে। ২০ একরের নিচের জলমহাল স্থানীয়ভাবে ইজারা দেয়ার বিধান রয়েছে। এরমধ্যে চলতি ১৪৩০ বাংলায় ৬৩টি জলমহাল ৬ বছর মেয়াদী ইজারা প্রদান করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। বছরে জলমহাল থেকে ৩০ কোটিরও বেশি টাকা রাজস্ব আদায় হয়ে থাকে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট দপ্তর।
জলমহাল নীতিমালা অনুযায়ী উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় যেসব জলমহাল রয়েছে-সেগুলো টেন্ডারের মাধ্যমে ৬ বছর মেয়াদে জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে ইজারা নিয়ে থাকেন সংশ্লিষ্ট মৎস্যজীবী সমিতি। ইজারা নীতিমালায় জলমহালে ৫ ফুট পানি রেখে মৎস্য আহরণের কথা বলা হলেও এটি মানা হচ্ছে না। বেশিরভাগ জলমহাল সেচ দিয়ে প্রতি বছর মৎস্য আহরণ করেন সংশ্লিষ্টরা। জলমহালে মা মাছ সংরক্ষণে অভয়াশ্রম তৈরির বাধ্যবাধকতা থাকলেও এটি কেবল কাগজে-কলমে লিপিবদ্ধ। বাস্তবে জলমহালের প্রতিটা বিল, জলাশয়, ডোবা নির্বিচারে শুকিয়ে ভোগ করা হচ্ছে। ভরাট হওয়া বিল পুনঃখনন করার বিধান থাকলেও সেটিও মানা হচ্ছে না। নীতিমালায় জলমহালের আওতাধীন কৃষি জমিতে কৃষকদের সেচের সুবিধা দেয়ার কথা থাকলেও অসময়ে বিল শুকিয়ে ফেলায় এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ কৃষকরা। তাছাড়া ইজারা নির্ধারিত জলাশয়ের কয়েকগুণ ভোগদখল করায় মৎস্য আহরণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ জেলে সম্প্রদায়।
অভিযোগ রয়েছে, জলমহাল ইজারা নেয়া মৎস্যজীবী সমিতির নেপথ্যে থাকে প্রভাবশালী চক্রের অদৃশ্য হাত। যারা মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের নাম ভাঙ্গিয়ে জলমহাল ইজারা বাগিয়ে নিয়ে অবৈধভাবে জলমহাল শাসন ও শোষণ করায় ঘটছে এমন বিপত্তি।
সম্প্রতি সরেজমিনে সুনামগঞ্জের দিরাই, জামালগঞ্জ ও শান্তিগঞ্জ উপজেলার মধ্যবর্তী চাতল বিল ও শান্তিগঞ্জ উপজেলার পাগলা বিলসহ কয়েকটি জলমহাল পরিদর্শন করে দেখা যায়, ইঞ্জিনচালিত পাম্পের সাহায্যে বিল শুকানো হচ্ছে। প্রকাশ্য দিবালোকে একাধিক সেচের পাম্প বসিয়ে জলমহাল শুকানো হলেও বাঁধা দিচ্ছেন না কেউ। স্থানীয় কৃষকরা জানিয়েছেন, উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ইজারা নেয়া এসব বিল প্রতি বছর শুকিয়ে মাছ ধরেন ইজারাদার। এতে জমিতে সেচের পানি সংকট দেখা দেয়ার পাশাপাশি বিল শুকিয়ে মাছ ধরায় দেশী মাছের আকাল দেখা দেয় বলে জানিয়েছেন স্থানীয় একাধিক কৃষক ও জেলে।
জামালগঞ্জ উপজেলার ভীমখালি ইউনিয়নের হারারকান্দি গ্রামের আব্দুল আখের বলেন, আমাদের এলাকার সবচেয়ে বড় বিল চাতল বিল। বিলটি সম্পূর্ণ অবৈধভাবে সেচ দিয়ে শুকিয়ে ফেলা হচ্ছে। বিলের আশেপাশে ৫০০ একর জমি রয়েছে। বিল শুকিয়ে ফেলায় পানি সংকটে রয়েছেন কৃষকরা। তিনি বলেন, এ ব্যাপারে আমরা জেলা প্রশাসককে অবহিত করেছি, কোনো কাজ হয়নি।
শান্তিগঞ্জ উপজেলার শরীফুল ইসলাম বলেন, গত কয়েকদিন ধরে পাগলা বিলে পাম্প দিয়ে বিল শুকানো হচ্ছে। এটি প্রতি বছরই হয়ে থাকে। অথচ শুনে আসছি, বিল নাকি শুকানো যায় না। বিল শুকিয়ে মাছ ধরায় এখন দিন দিন দেশীয় মাছ কমে যাচ্ছে বলে জানান তিনি।
জলমহাল নীতিমালা প্রতিপালনের ব্যাপারে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) বিজন কুমার সিংহ বলেন, চলতি অর্থবছরে যে সকল জলমহাল ইজারা দেয়া হয়েছে; সে সকল সমিতির লোকদের নিয়ে জলমহাল ব্যবস্থাপনার উপরে একটি সভা করে গাইডলাইন দেয়া হবে। যাতে তারা নীতিমালার বিষয়গুলো অবহিত হতে পারেন।
জলমহাল ইজারার নীতিমালা না মানলে মোবাইল কোর্ট করে ইজারা বাতিলের কথা জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরী। কোনো জলমহালের বিষয়ে অভিযোগ পেলে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানান তিনি।