জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানের বর্ণাঢ্য জীবন
নিউজ ডেস্ক
সত্যবাণী
ঢাকাঃ চেতনার এক অপরিমেয় বাতিঘর জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামন। আজ তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে। যিনি নিজেই ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান। শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নিলেও সাহিত্য- গবেষণা, লেখালেখি ও সাংগঠনিক কার্যক্রমের জন্য তার ভূমিকা বিভিন্ন সময়ে উল্লেখ করা হয়েছে। আনিসুজ্জামানের রচিত ও সম্পাদিত বহু বাংলা ও ইংরেজি বই, শিল্প-সংস্কৃতি ও ইতিহাসের বিবেচনায় খুবই গুরুত্ব বহন করে।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ ফেব্রুয়ারি কলকাতার পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগনা জেলার বসিরহাটে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা এটিএম মোয়াজ্জেম ছিলেন বিখ্যাত হোমিও চিকিৎসক। মা সৈয়দা খাতুন গৃহিনী হলেও অভ্যাস ছিল লেখালেখির। পিতামহ শেখ আবদুর রহিম ছিলেন লেখক ও সাংবাদিক। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে বড় তিন বোনের ছোট আনিসুজ্জামান, তারপর আরেকটি ভাই। বড় বোনও নিয়মিত কবিতা লিখতেন। বলা যায়, শিল্প সাহিত্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যসমৃদ্ধ ছিল তাঁদের পরিবার।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে অবদান রেখেছেন ড. আনিসুজ্জামান। ১৯৭১ সালে মুজিব নগর সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ছিলেন তিনি। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান বাংলা ভাষায় অনুবাদের যে কমিটি গঠিত হয়, তার নেতৃত্বে ছিলেন তিনি।
আনিসুজ্জামান শিক্ষাজীবন শুরু করেন কলকাতার পার্ক সার্কাস হাইস্কুলে। এখানে তৃতীয় শ্রেণি থেকে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর বাংলাদেশের খুলনা চলে আসেন এবং খুলনা জিলা স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হন। এক বছর পর পরিবারের সাথে ঢাকায় চলে আসেন এবং প্রিয়নাথ হাইস্কুলে (বর্তমান নবাবপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়) ভর্তি হন। ১৯৫১ সালে এ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ও ১৯৫৩ সালে জগন্নাথ কলেজ (২০০৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে রুপান্তর) থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৫৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও ১৯৫৭ সালে একই বিষয়ে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। সে সময় বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও শিক্ষক ছিলেন মুনীর চৌধুরী।
১৯৫৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি বাংলা একাডেমির গবেষণা বৃত্তি লাভ করেন। একই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজ আমলে ‘বাংলা সাহিত্যে বাঙালি মুসলমানের চিন্তাধারা: ১৭৫৭-১৯১৮’ বিষয়ে পিএইচডি শুরু করেন। ১৯৫৯ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তিনি পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের গবেষণা বৃত্তি লাভ করেন। ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উনিশ শতকের বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাস: ইয়ং বেঙ্গল ও সমকাল বিষয়ে পোস্ট ডক্টরাল ডিগ্রি অর্জন করেন।
ড. আনিসুজ্জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার মাধ্যমে তার কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৬৯ সালের জুনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের রিডার হিসেবে যোগদান করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে তিনি ১৯৭১ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান করেন এবং পরবর্তীতে ভারত গমন করে শরণার্থী শিক্ষকদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি’র সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। যুদ্ধকালীন গঠিত অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭৪-৭৫ সালে কমনওয়েলথ অ্যাকাডেমি স্টাফ ফেলো হিসেবে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজে গবেষণা করেন। ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত তিনি জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা প্রকল্পে অংশ নেন।
১৯৮৫ সালে তিনি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসেন। ২০০৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেন। পরে সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক হিসেবে আবারও যুক্ত হন। তিনি মওলানা আবুল কালাম আজাদ ইনস্টিটিউট অফ এশিয়ান স্টাডিজ (কলকাতা), প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় এবং নর্থ ক্যারোলাইনা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ভিজিটিং ফেলো ছিলেন। এছাড়াও তিনি নজরুল ইনস্টিটিউট ও বাংলা একাডেমির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। মহান ভাষা আন্দোলন, রবীন্দ্র উচ্ছেদবিরোধী আন্দোলন, রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী আন্দোলন এবং ঐতিহাসিক অসহযোগ আন্দোলনে তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থাবলির মধ্যে রয়েছে- মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য, মুসলিম বাংলার সাময়িকপত্র, মুনীর চৌধুরী, স্বরূপের সন্ধানে, Social Aspects of Endogenous Intellectual Creativity, Factory Correspondence and other Bengali Documents in the India Official Library and Records, আঠারো শতকের বাংলা চিঠি, মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্, পুরোনো বাংলা গদ্য, মোতাহার হোসেন চৌধুরী, Creativity, Reality and Identity, Cultural Pluralism, Identity, Religion and Recent History, আমার একাত্তর, মুক্তিযুদ্ধ এবং তারপর, আমার চোখে, সাহিত্যে ও সমাজে, পূর্বগামী, কাল নিরবধি, অস্কার ওয়াইল্ডের An Ideal Husband-এর বাংলা নাট্যরূপ ‘আদর্শ স্বামী’, আলেক্সেই আরবুঝুভের An Old World Comedy-র বাংলা নাট্যরূপ ‘পুরনো পালা’, রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগর রচনা সংগ্রহ, Culture and Thought, মুনীর চৌধুরী রচনাবলী ১-৪ খণ্ড, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস-প্রথম খণ্ড, অজিত গুহ স্মারকগ্রন্থ, স্মৃতিপটে সিরাজুদ্দীন হোসেন, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মারকগ্রন্থ, নজরুল রচনাবলী ১-৪ খণ্ড, SAARC : A People’s Perspective, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের আত্মকথা, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ রচনাবলী- ১ ও ৩ খণ্ড, নারীর কথা, ফতোয়া, মধুদা, আবু হেনা মোস্তফা কামাল রচনাবলী- ১ম খণ্ড, যৌথ, ওগুস্তে ওসাঁর বাংলা-ফরাসি শব্দসংগ্রহ, আইন-শব্দকোষ, মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য, মুনীর চৌধুরী, স্বরূপের সন্ধানে, পুরোনো বাংলা গদ্য, আমার একাত্তর, মুক্তিযুদ্ধ এবং তারপর, আমার চোখে, কাল নিরবধি, Factory correspondence and other Bengali Documents in the India o ffice Library and Records, Creativity, Identity and Reality, Cultural Pluralism, Identity, Religion and Recent history প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
তাঁর কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ পেয়েছেন অসংখ্য পুরষ্কার। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য- নীলকান্ত সরকার স্বর্ণপদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্মাননা, দাউদ পুরস্কার, বাংলা একাডেমী পুরষ্কার, একুশে পদক, আনন্দ পুরষ্কার, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডি. লিট, এশিয়াটিক সোসাইটিতে কলকাতা ইন্দিরাগান্ধী স্মারক বক্তৃতা, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে শরত্চন্দ্র স্মারক বক্তৃতা, নেতাজী ইনস্টিটিউট অফ এশিয়ান অ্যাফেয়ার্সে নেতাজী স্মারক বক্তৃতা, অণুষ্টুপের উদ্যোগে সমর সেন স্মারক বক্তৃতা প্রদান এবং পদ্মভূষণ পদক।