জামালগঞ্জে অবাধে চলছে জলমহাল সেচঃ ধ্বংস হচ্ছে মৎস্য ও পরিবেশ
সিলেট অফিস
সত্যবাণীঃ সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলার জলমহাল, বিল, ডোবা ও নদীর তলদেশ শুকিয়ে অবাধে মাছ ধরার মহোৎসব চলছে। বিশেষ করে মৎস্যজীবী সমিতির নাম ভাঙিয়ে অসাধু জলমহাল-বিল ব্যবসায়ী চক্রের নেতৃত্বে প্রতি বছরই চলে এমন উৎসব।
এসবের নেপথ্যে উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার যোগসাজশ রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয় কৃষকরা। ওই কর্মকর্তা দীর্ঘ সময় থেকে জামালগঞ্জে চাকরির সুবাদে জলমহাল, বিল ব্যবহারকারী ও জেলেদের সাথে গড়ে তুলেছেন নিবিড় সখ্যতা। মধ্যখানে কিছুদিন অন্য উপজেলায় বদলি হয়ে গেলেও আবারও তিনি ফিরে আসেন জামালগঞ্জে। মৎস্য বিভাগের নাকের ডগায় অবাধে জলমহালের তলদেশ শুকিয়ে মৎস্য নিধন করলেও অজ্ঞাত কারণে এসব অপকর্মের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না।
জামালগঞ্জ থেকে সংবাদদাতা জানান, জলমহাল সেচের কারণে কৃষি জমিতে সেচ সংকটসহ মাছের বংশ বিস্তার রোধ ও হাওরের পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কাকে আরও প্রবল করে তোলা হচ্ছে। মৎস্য বিভাগের লোকজনের সাথে গোপনে রফাদফা করে চক্রটি হাওর এলাকায় প্রতিবছরই এই অশুভ তৎপরতা চালিয়ে মাছের বংশ ধ্বংশ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে এলাকাবাসীর।
এ ব্যাপারে স্থানীয় মৎস্য বিভাগসহ দায়িত্বশীলদের কোন তৎপরতা না থাকায় অসাধু চক্রটি দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। চক্রটির এসব ‘অনৈতিক কর্মকান্ডের সহযোগী হিসেবে নাম রয়েছে হাতেগোনা কয়েক অসৎ দালাল সংবাদকর্মীর। তারা অবৈধ এমন কর্মকান্ডের প্রতিবাদ বা পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ না করে অসাধু চক্রকে মদদ দিয়ে যাচ্ছেন। সংবাদকর্মী নামধারী দালালরা জলমহাল সেচের খবর পেয়ে বিলের পাড়ে গিয়ে মাছের সাথে সাথে ‘রাস্তা খরচ’ পকেটে ভরে নিয়ে আসার ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক। এসব অপকর্মের কথা অস্বীকার করে বক্তব্য দিতে সময়ক্ষেপন ও টালবাহানা করে পর পর কয়েকদিন মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়ে গিয়েও উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা বক্তব্য দিতে অপারগতা জানান।
গত ফেব্রুয়ারি’র মাঝামাঝি থেকে এখন পর্যন্ত অবাধে চলছে জলমহাল-খাল-বিল ও ডোবার তলদেশ সেচের কাজ। এসব জলমহাল বা নদীর তলদেশ শুকিয়ে মাছ শিকারের আইনগত কোন বৈধতা না থাকলেও জামালগঞ্জ উপজেলার পুরো হাওর এলাকায় ইজারাকৃত অধিকাংশ জলমহাল শুকিয়ে মাছের প্রজনন ও বংশবিস্তার রোধের পাশাপাশি জলমহালগুলোকে পরিবেশ বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। এতে কারও কোন নজরদারি না থাকায় দিন দিন বিপর্যয়ের মাত্রা প্রকট আকার ধারণ করছে। জলমহাল শুকিয়ে মাছ ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানের আড়তে মাছ পাঠানোর ফলে স্থানীয় ভোক্তারা বাজারে গিয়ে দেশী মাছ কিনতে পাচ্ছেন না। এ কারণে আর কিছুদিনের মধ্যেই মাছের দেশ নামে খ্যাত সুনামগঞ্জে মাছের আকাল দেখা দেবে বলে আশংকা প্রকাশ করেছেন স্থানীয় বিশেষজ্ঞ মহল।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সদর ইউনিয়নের চানপুর মৌজার নয়াখাল নাইন্দা বিলের তলা শুকিয়ে প্রথম জলমহাল সেচের শুরু হয় চলতি বছর। এ খবর পেয়ে সংবাদকর্মী নামধারী স্থানীয় ক’জন দালাল গাড়ি ভাড়া ও মাছ নিয়েই নিশ্চিন্তে ফিরে যান বলে জানিয়েছেন স্থানীয় এলাকাবাসী। স্থানীয়রা মৎস্য কর্মকর্তাকে জলাশয় সেচের বিষয়ে বার বার জানালেও রহস্যজনক কারণে তিনি কোন পদক্ষেপ নিচ্ছেন না।
হাওর ঘুরে দেখা গেছে, সোনাপুর গ্রাম সংলগ্ন নয়াখাল নাইমদা, বেহেলী ও বদরপুরের মাঝ অংশে কসমার বিল, তেরানগরের পাশে দৌলতা নদী, ছিছড়াবনি, লকড়ি, ঘনিয়ার বিলসহ অনেক জলমহালের তলদেশ সেচা হলেও এ প্রতিবেদক মৎস্য কর্মকর্তাকে জানালে তিনি কোন পদক্ষেপ নেননি। ফেনারবাঁক ইউনিয়নের বিনাজুরা ও উদয়পুর গ্রামের মধ্যবর্তী লড়কি বিল, দিরাই চাতল বিল, ফেনারবাঁক ও রাজাপুর গ্রামের মাঝে ছিছড়াউলী বিল ও মুসলিম রাজাপুর গ্রামের পশ্চিম পাশে ধলাপাকনা বিল, খোঁজারগাঁও গ্রামের পার্শ্ববর্তী চন্দ্রঘোনা বিল, হটামারা গ্রামসংলগ্ন হকিয়াডুকি বিল, ভীমখালী ইউনিয়নের তেরানগর গ্রামের পাশে দৌলতা নদী, দেউতান বিল, লম্বা বিল-গোল বিল ও বেহেলী ইউনিয়নের বদরপুর সংলগ্ন ঘনিয়ার বিল, বেহেলী বাজারের দক্ষিণ-পশ্চিম কোনে কসমার বিল, সদর ইউনিয়নের সোনাপুর গ্রামের সামনে নয়াখাল নাইন্দা বিলসহ এমন অনেক বিল আছে যে ২/৩ টি ছাড়া বাকি সবগুলো বিলের তলা শুকিয়ে মাছ ধরা শেষ হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
আবার কোন কোনটিতে মেশিন লাগানোর প্রস্তুতি চলছে। সংঘবদ্ধ মাছ শিকারী চক্র প্রায় সব বিলে অবৈধ পন্থায় জলমহালের তলা শুকিয়ে মাছ ধরা অব্যাহত রেখে মাছের বংশ ধ্বংস করছে বলে জানান কৃষকরা। তবে এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কতৃর্পক্ষের নিরব ভুমিকায় চলছে নানা সমালোচনা।
হাওরের মৎস্য সম্পদ বিনষ্টকারী ও পরিবেশ ধ্বংসকারীরা জোট বেঁধে প্রতি বছরই এই কাজ করে। তারা পাম্প মেশিন লাগিয়ে বিলের পানি সেচ করছে। এতে করে অনেক কৃষক তাদের বোরো জমিতে পানি দিতে না পারায় ধানের ক্ষেত নষ্ট হওয়ার উপক্রম। ছিছড়াউলীসহ বিলের পানি শুকিয়ে মাছ ধরার কারণে অনেক কৃষকের কৃষি জমি পানির নীচে চলে যাওয়ায় জমির ফসল নষ্ট হতে চলেছে। কর্তৃপক্ষের নাকের ডগায় এভাবেই হাওর, প্রকৃতি ও পরিবেশ ধ্বংস হচ্ছে।
জলমহালের খোঁজ নিতে বিলের পারে গেলে এ প্রতিবেদককে দেখে সেচ কাজে থাকা ব্যক্তিরা তাড়াতাড়ি পানি সেচের পাওয়ার পাম্প বন্ধ করে হন হন চলে যান। কোন প্রশ্ন করলে তিনি উত্তর দেননি।
জানা যায়, নয়াখাড়া নাইন্দা বিল ইজারা পেয়েছে সদর ইউনিয়নের লক্ষীপুর মৎস্যজীবি সমবায় সমিতি, ছিছড়াউলী বিল ইজারা পেয়েছে নতুন চাটনীপাড়া মৎস্যজীবি সমবায় সমিতি, লম্বা বিল ও গোলবিল পেয়েছে উজান দৌলতপুর মৎস্যজীবি সমবায় সমিতি, কসমার বিলের ইজারা পেয়েছে গোপালপুর-চিলমারা সমবায় সমিতি। অন্যদিকে ঘনিয়ার বিলের ইজারাদার সাচনা মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি। তবে মৎস্যজীবী সমিতি নামকাওয়াস্তে ইজারায় মালিক হলেও প্রকৃত মালিক হচ্ছে অন্যরা। জলাশয়ের ইজারায় আইনে মৎস্যজীবীদের পূর্ণ অধিকার দেয়া থাকলেও বাস্তবে তা মানা হচ্ছে না। সমিতির আওতাভুক্ত হাওর এলাকার গরীব মানুষদের আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে প্রায় সব জলমহাল থেকেই চেটে-পুঁচে মাছ শিকার করে খাচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগী চক্র।
বিল শুকিয়ে মাছ ধরার বিষয়টি স্বীকার করে এক সমিতির সভাপতি বলেন, কাগজেপত্রে ইজারাকৃত বিলের মালিক মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি। তবে আমরা নামে আছি কামে নাই। আমরা এর সাথে জড়িত নয়। যারা ‘সাবলিজ’ নেয় তারা প্রতি বছরই এমন আকাম করে যা নিয়ম বহির্ভূত।
সদর ইউনিয়নের সোনাপুর-লালপুর এলাকার কৃষক সুবেন্দু দে বলেন, ‘নাইমদা বিল সেচের কারণে আমরার বোরো জমিতে পানি দিতে পারি নাই। ধান কম হইবো। আমরার হাওরে প্রায় ৩ হাজার গরু আছে, এই গরুর পানি খাওয়ার জায়গা আছিন নাইমদা বিল। সেচ করায় আমরার গরুগুলো পানি খাইতে পারেনা। কঠিন অবস্থায় আমরা আছি। ’
সোনাপুর গ্রামের সমাজকর্মী মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘নাইমদা খাড়া বিলসহ হাওরের অনেক বিল সেচ করে মাছ ধরে মাছের বংশ ধ্বংস করে দিচ্ছে। মা মাছ, ডিমওয়ালা মাছ শেষ। এই মাছগুলো থাকলে আমাদের হাওরে মাছের অভাব থাকতো না। উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তাকে জানালেও কোন কাজ হয়নি। দু’জন সাংবাদিক আসছিল তারা টিভির লগো ধরে নানান জাতের প্রশ্ন করছে, কৃষকরা উত্তরও দিছে। কিন্তু এরা কোন সংবাদ প্রচার না করে জলমহালের ইজারাদারের সাথে অর্থের বিনিময়ে মিশে গেছে। তারা এমন অন্যায় দেখেও কোন পদক্ষেপ নেয়না। ভবিষ্যতে যেন হাওরে আর বিল জলাশয় সেচ না করা হয় সেজন্য প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি কামনা করেন তিনি।
কৃষক মন্তাজ উদ্দীন বলেন, মৎস্য কর্মকর্তা ঠিক থাকলে বিল সেচ বন্ধ থাকতো। তাইনের সাথে যোগাযোগ কইরাই এসব আকাম করতাছে। আজিমুল, সতীষ চন্দ্র কর, সোলেমান মিয়ারা মৎস্য বিভাগ ও দালাল সংবাদকর্মীদের উপর ক্ষোভ ঝাড়েন।
জামালগঞ্জ প্রেসক্লাব সেক্রেটারি সিনিয়র সংবাদকর্মী বাদল কৃষ্ণ দাস বলেন, আমাদের চোখের সামনেই এমন অনেক জলমহাল, খাল-বিল শুকিয়ে মাছ ধরছে। বরাবরই এ রকম বিলের তলা শুকিয়ে মাছ ধরা হয়, এবারও হচ্ছে। কৃষকরা আমাদেরকে জানানোর পর আমরা কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও ব্যবস্থা নিচ্ছি বলে টালবাহানা করেন। এরই মধ্যে বিল সেচে মাছ ধরার কাজ শেষ করেছে তারা।
এ ব্যাপারে জামালগঞ্জ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা (অ: দা:) কামরুল হাসানের কার্যালয়ে পর পর কয়েকদিন ব্ক্তব্য নিতে গেলে তিনি একটু পরে, বিকেলে, সন্ধ্যায় বক্তব্য দেবো বলে সময় পার করেন। কোন কোন দিন তার কার্যালয় বন্ধ থাকে। আবার খোলা অবস্থায়ও তাকে পাওয়া যায়নি। মোবাইল ফোনে তিনি জানান তার উপর আনিত অভিযোগ মিথ্যা। তবে জলমহাল সেচ বন্ধ হচ্ছেনা কেন জানতে চাইলে তিনি এড়িয়ে গিয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছি বলে জানান।
সুনামগঞ্জ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. শামসুল করিমকে মুঠোফোনে বিষয়টি জানালে তিনি বলেন, হাওরের বিল-ডোবা অথবা জলাশয় শুকিয়ে মাছ ধরা আইনে নেই। জেলার সকল উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তাকে বলা আছে; স্ব-স্ব উপজেলা প্রশাসন, থানা পুলিশ এবং মৎস্য কর্মকর্তা বিষয়টি তদারকি করবেন। তারাই এসব বন্ধে পদক্ষেপ নেবেন।