জামায়াতের কমান্ড সেন্টার লন্ডনে: ডিবি হেফাজতে ৯ নেতাকে জিজ্ঞাসাবাদে তথ্য

নিউজ ডেস্ক
সত্যবাণী

ঢাকাঃ জামায়াতে ইসলামের অনেক গোপন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আসে লন্ডন থেকে।পূর্বপরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন সময় ৯০০-র বেশি সদস্যকে সংগঠনটির ফান্ডের অর্থ ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে সেখানে পাঠানো হয়েছে। সেখানে বসেই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সারাদেশের নেতাকর্মী ও গুরুত্বপূর্ণ শুভানুধ্যায়ীদের তালিকা করে তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করা হয়। আর্থিকসহ যে কোনো প্রয়োজনে বিভিন্ন পর্যায়ের সদস্যকে সহযোগিতা করা হচ্ছে। নিবন্ধন হারালেও একটি মাস্টারপ্ল্যান নিয়ে এগোচ্ছে জামায়াত। এই পরিকল্পনার আলোকে ২০৪৮ সালে এককভাবে ক্ষমতায় যেতে চায় তারা। বিরুদ্ধ পরিস্থিতিতে টিকে থাকা ও গোপন এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ছাড়াও বিএনপি, হেফাজতে ইসলামসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে সংগঠনের নানা পর্যায়ের সদস্যকে ছদ্মবেশে ঢোকানো হচ্ছে। আন্দোলনের সময় ভূমিকা রাখতে বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়নে ঢুকেছে তাদের কর্মীরা। পুলিশ হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদে জামায়াতের ৯ নেতাকর্মী এসব তথ্য দিয়েছেন বলে দাবি করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
ডিবির ভাষ্য, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ, রফিকুল ইসলাম খান, নির্বাহী পরিষদের সদস্য ইজ্জত উল্লাহ, মোবারক হোসেন, আব্দুর রব, ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি ইয়াসিন আরাফাত ও জামায়াত কর্মী মনিরুল ইসলাম ও আবুল কালামকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর তাদের দুই দফা রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে আগামী নির্বাচনে জামায়াতের কৌশলসহ দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার কথা জানা যায়।
ডিবির যুগ্ম কমিশনার (উত্তর) হারুন অর রশিদ সমকালকে বলেন, জামায়াতের নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন, লন্ডনে সংগঠনটির অনেক নেতাকর্মী ও শুভানুধ্যায়ী রয়েছে। নানা সময় ৯০০-র বেশি বিভিন্ন পর্যায়ের সদস্যকে জামায়াত লন্ডন পাঠিয়েছে। সেখানে বসে তারা সংগঠনটির অ্যাসাইনমেন্ট পালন করছে। দেশে কোণঠাসা জামায়াতের প্রভাববলয় এখন লন্ডনকেন্দ্রিক। এ ছাড়া ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডকে বিতর্কিত করতে আলাদা একাধিক টিম তাদের রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, রিমান্ডে জামায়াতের নেতাকর্মীরা বলেছেন, নিবন্ধন হারালেও তারা মনে করছেন, ধর্মভিত্তিক দলগুলোর মধ্যে তাদের একটি ‘ফিক্সড ভোট’ রয়েছে। ২০৪৮ সালে তারা এককভাবে ক্ষমতায় যেতে সক্ষম বলে বিশ্বাসও করেন। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, হেফাজত ছাড়াও শ্রমিক সংগঠনে শত শত জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীকে ঢোকানো হচ্ছে। অনেকে এরই মধ্যে নানা সংগঠনে ঢুকে জামায়াতের এজেন্ট হিসেবে কাজ করতে শুরু করেছে। জামায়াত পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও বাড়ানোর পরিকল্পনা তাদের। আবার দীর্ঘ দিন ধরে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে তরুণ প্রজন্মকে সংগঠনে ভেড়াচ্ছেন তারা।
ডিবির যুগ্ম কমিশনারের ভাষ্য, জামায়াতের ফান্ডের একটি বড় অংশ বিদেশি বিভিন্ন সূত্র থেকে আসে। এ ছাড়া দেশেও তাদের অনেক ব্যবসা রয়েছে। জামায়াতের নেতাকর্মীদের কাছ থেকে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে, সে আলোকে কিছু ব্যক্তির ওপর গোয়েন্দা নজর রাখা হচ্ছে।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির জামায়াতের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে বিস্তর গবেষণা করেছেন। জামায়াতের এসব পরিকল্পনার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি সমকালকে বলেন, জামায়াতের লন্ডন কানেকশন নিয়ে আশির দশক থেকেই লেখালেখি হচ্ছে। এ নিয়ে বিচিত্রায় একাধিক প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছিল। মেধাবী ছাত্রদের টার্গেট করে লন্ডন নিয়ে ব্যারিস্টার ও ডাক্তার বানাচ্ছে জামায়াত। জামায়াতের পরিকল্পনা নিয়ে এখন পুলিশ যা বলছে, তা খুব বেশি নতুন নয়। যেটা বের করা দরকার তা হলো, জামায়াতের সঙ্গে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার কী ধরনের কানেকশন এখন রয়েছে। তালেবান ও আইএসের সঙ্গে তাদের যোগসূত্র। অনেক আগেই জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা আবুল আলা মওদুদীর ছেলে হায়দার ফারুক মওদুদী বাংলাদেশে এসে প্রকাশ্যে বলেছিলেন, বাংলাদেশে জামায়াত হলো পাকিস্তানি জামায়াতের একটি শাখা মাত্র। আর বিভিন্ন সময় আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা বলছেন, তাদের দলে জামায়াত-শিবিরের অনেক অনুপ্রবেশকারী রয়েছে।
জামায়াতের নির্বাহী পরিষদ সদস্য অ্যাভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ সমকালকে বলেন, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসেবে জনসমর্থন তৈরির মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়ার একটা পরিকল্পনা তো রয়েছেই। ক্ষমতায় গেলে কীভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করা হবে, সে রূপরেখা থাকাটাও স্বাভাবিক। সে জন্য বিভিন্নভাবে কাজ চলছে। আমাদের ছাত্র ও শ্রমিক সংগঠন কাজ করছে। তবে সংগঠন পরিচালনার জন্য বিদেশ থেকে টাকা আসার বিষয়টি সঠিক নয়। আমাদের লাখ লাখ নেতাকর্মী প্রতি মাসে চাঁদা দিচ্ছেন। সেটাই আমাদের ভরসা। মানুষের আস্থাই আমাদের তহবিল।
ডিবির তদন্ত সংশ্নিষ্ট আরও একাধিক কর্মকর্তার ভাষ্য, ২০৪৮ সালে ক্ষমতায় যেতে সরকারি-বেসরকারি ২০-২৫টি সেক্টরে অন্তত দুই লাখ দলীয় মনোভাবাপন্ন সদস্য ঢোকানোর পরিকল্পনা রয়েছে জামায়াতের। ট্রেড ইউনিয়নে নিজদের লোক গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বসিয়ে বড় কোনো আন্দোলনের সময় তাদের কাজে লাগানোর পরিকল্পনাও রয়েছে। সংগঠনের কাজে যে অর্থ ব্যয় হয়, তার একটি বড় অংশ আসছে বিদেশে থাকা সংগঠনের নেতাকর্মীদের কাছ থেকে। আবার অনেক এনজিও থেকেও ফান্ড আনা হচ্ছে। ডিবির সূত্র বলছে, গত কয়েক বছর ধরে প্রকাশ্যে জামায়াতের তেমন কোনো রাজনৈতিক তৎপরতা না থাকলেও দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের সাংগঠনিক ইউনিট চাঙ্গা রাখতে গোপন তৎপরতা দলটির রয়েছে। ছাত্রলীগের মধ্যে নিজস্ব নেতাকর্মীদের প্রবেশ করানোর কথা হাইকমান্ড থেকে বলা হয়। ছাত্রলীগ কর্মীর পরিচয়ে পরে সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে প্রবেশ করে যাতে গোপনে নিজেদের আদর্শ বাস্তবায়ন করা যায়, সে ছকও রয়েছে তাদের। এ ছাড়া হেফাজতের মধ্যে নিজস্ব সদস্য ঢুকিয়ে দেশব্যাপী সেখানে প্রভাব বলয় তৈরি করারও চেষ্টা করছে জামায়াত। সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন ও পরিকল্পনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে দেশি-বিদেশি মিডিয়ার মাধ্যমে অপপ্রচার চালানোর কৌশলও নিয়েছে তারা। এ ছাড়া স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে গুজব ছড়ানোর জন্য তাদের ‘সাইবার টিম’ আছে।
ডিবি বলছে, জামায়াতের ৯ নেতাকর্মীর দেওয়া তথ্যের পর দেশে গোপন ষড়যন্ত্রমূলক তৎপরতায় সংশ্নিষ্ট ব্যক্তিদের তালিকা জেলার পুলিশ সুপারদের কাছে পাঠানো হয়েছে। এরই মধ্যে ওই তালিকা ধরে গোয়েন্দা নজর ও অভিযান চালানো হচ্ছে। এই অভিযানের অংশ হিসেবে এরই মধ্যে দেশের কয়েকটি জেলায় অভিযান চালানো হয়। জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরের সাত নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করে চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানা পুলিশ। তারা হলেন- নগর জামায়াতের বায়তুল মালবিষয়ক সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম, নগর জামায়াতের সহ-প্রচার সম্পাদক মোহাম্মদ আলী, নগর শিবিরের শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক মিফতাহুল আলম, নগর শিবিরের সাথী ইরফান ইউনুস, জামায়াত কর্মী ইমরান আলী, মো. দেলোয়ার ও মো. আবু বক্কর সিদ্দিক। নোয়াখালীতে অভিযান চালিয়ে জামায়াতের জেলা আমিরসহ তিন নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা সদস্য, নোয়াখালী জেলা আমির মাওলানা আলাউদ্দিনকে তার চৌমুহনীর বাসা থেকে এবং একইভাবে জেলা জামায়াতের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক নাসিমুল গনি মহল চৌধুরী ও চৌমুহনী ৯ নম্বর ওয়ার্ড জামায়াত কর্মী মো. ফখরুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়। রাজশাহীতে অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছে জামায়াতে ইসলামীর রুকন হুমায়ুন কবিরকে। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার শান্তিরাম ইউনিয়ন জামায়াতের সভাপতি সুজা মিয়া, বেলকা ইউনিয়ন সভাপতি আব্দুল ওয়াহেদ মিয়া, জামায়াত কর্মী মিজানুর রহমান ও মনোয়ারুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

You might also like