দুর্বল পানি নিষ্কাশন ও পলি ব্যবস্থাপনার অভাবে দফায় দফায় ডুবছে সিলেট
সিলেট অফিস
সত্যবাণী
দুর্বল পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা, ভারতের সাথে পলি ব্যবস্থাপনা না থাকা ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সিলেট অঞ্চল দফায় দফায় বন্যার কবলে পড়ছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক পরিচালিত যৌথ গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।
গবেষণার সাথে সম্পৃক্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মাহবুব মোর্শেদ গণমাধ্যমকে জানান, সিলেটের লো-ল্যানড (প্লাবন ভূমিতে) আবাসন বেড়ে চলেছে। নগরির উপশহরসহ শহরের সাথে সম্পৃক্ত হাওরগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে। সিলেট সিটি কর্পোরেশনের অভ্যন্তরের ড্রেনগুলোর অবস্থাও ভালো নয়। ড্রেনগুলোকে ফাংশনিং করার তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, সুরমা নদী খনন করতে হবে এবং হাওরগুলোকে পানি ধারণের জন্য প্রস্তুত করতে হবে। তা না হলে সিলেট আগামীতে আরো ভয়াবহ অবস্থার দিকে যাবে। এ কারণে মানবিক এবং জলবায়ু পরিবর্তনগত বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। তাদের গবেষণাটি শিগগিরই বুকলেট আকারে প্রকাশিত হবে বলে জানান তিনি।
গবেষণায় যা উঠেছেঃ-
গবেষণায় বলা হয়, পৃথিবীর সর্বাধিক বৃষ্টিবহুল স্থান ভারতের মেঘালয় রাজ্যের চেরাপুঞ্জি সিলেট মহানগরি থেকে মাত্র প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দূরত্বে সুউচ্চ উজানভূমিতে অবস্থিত। মেঘালয় রাজ্যের পাদদেশে সিলেট মহানগরির এই ভৌগোলিক অবস্থান নগরিটিকে বন্যা ঝুঁকিতেও ফেলে দিয়েছে। চেরাপুঞ্জির প্রবল বর্ষণের জলধারা সিলেট অঞ্চল তথা সিলেট নগরির জলনিষ্কাশন ব্যবস্থা যেমন, সুরমা-কুশিয়ারা নদীব্যবস্থার মধ্য দিয়ে মেঘনা নদী হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়। সুরমা নদীর উত্তর তীরে বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে সিলেট নগরির বিকাশ। অসংখ্য জলাভূমি ও খাল-ছড়া এই মহানগরি জুড়ে একসময় বিস্তৃত ছিল। এসব খাল-ছড়া নগরির উত্তরের উঁচুভূমি থেকে উৎপন্ন হয়ে দক্ষিণমুখী ঢাল অনুসরণ করে সুরমা নদীতে পড়েছে। এসব খাল ও ছড়া দিয়ে চলাচল করতো অসংখ্য ছোট ও মাঝারি নৌকা। নগরির খাল ও ছড়ার মধ্যে গাভীয়ার খাল, মালনীছড়া, কাজীরবাজার খাল, কালিবাড়ি ছড়া, চালিবন্দর খাল, কুশিখাল, ধোপাছড়া উল্লেখযোগ্য।
গবেষণায় বলা হয়, বন্যা বাংলাদেশের জন্য মৌসুমী প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলেও সিলেট অঞ্চলের জন্য একটি প্রধান প্রাকৃতিক দুর্যোগ। প্রতি শতাব্দীতে বঙ্গীয় বদ্বীপ যখন প্লাবিত হতো তখন সিলেটের বিভিন্ন অংশে বন্যা দেখা দিত । তাই সিলেট অঞ্চলের বন্যার কালক্রম পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে, ১৭৮১ সালে সিলেটের পশ্চিমাঞ্চলে ব্যাপকভাবে বন্যা হয়। তাছাড়া ১৮৫৩ সালে ভারি বর্ষণের কারণে সিলেটের পশ্চিমাংশে বন্যা দেখা দেয়। এছাড়াও ১৯০২, ১৯৬৬, ১৯৬৮ ও ১৯৮৮ সালে সিলেটে বড় ধরণের বন্যা হয়েছিল। এছাড়াও পরবর্তীতে ১৯৯৮, ২০০০, ২০০৪, ২০০৭, ২০১০, ২০১২, ২০১৫, ২০১৬, ২০১৭, ২০১৯ এবং ২০২২-এ সিলেট ব্যাপকভাবে বন্যা কবলিত হয়।
গবেষণায় আরো বলা হয়, সিলেট মহানগরি দুই প্রকার বন্যার দুর্যোগের মুখোমুখি হয়ে থাকে, যথা-সুরমা নদীতে সৃষ্ট আকস্মিক বন্যা এবং স্থানীয় বৃষ্টিপাতের ফলে সৃষ্ট বন্যা। সিলেটের উত্তরে অবস্থিত খাসিয়া জৈন্তিয়া পর্বতমালায় এবং মেঘালয় রাজ্যের চেরাপুঞ্জি পর্বতমালায় সংঘটিত ভারি বৃষ্টির পানি দ্রুত উজান থেকে সিলেটের প্লাবনভূমিতে নেমে এসে আকস্মিক বন্যার সৃষ্টি করে। এই বন্যার পানি সুরমা-কুশিয়ারা নদী ব্যবস্থা অনুসরণ করে মেঘনা নদী ব্যবস্থায় পতিত হওয়ার সময় সিলেট নগরিকেও আকস্মিকভাবে প্লাবিত করে থাকে। অপরদিকে, বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত সংঘটিত হয় সিলেট জেলায় এবং গড় বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ প্রায় ৪০০০ মি.মি.। এই প্রবল বৃষ্টিপাত স্থানীয়ভাবে দুর্বল পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার দরুণ বন্যা সংঘটিত করে থাকে।
টিলাবেষ্টিত প্লাবন সমভূমি প্রভাবিত এই সিলেট অঞ্চলে যে বন্যা দেখা যায়, সেটি হচ্ছে আকস্মিক বন্যা। গবেষকদের মতে, সিলেট হাওরাঞ্চলের একটি সাধারণ প্রাকৃতিক দুর্যোগ হচ্ছে এই আকস্মিক বন্যা। সিলেটের এই আকস্মিক বন্যাটি ভারতের আসাম ও মেঘালয় রাজ্যের সাথে অনেকটা সম্পৃক্ত।
গবেষণায় সিলেট হাওর অঞ্চলের বিগত ২৭ বছরের (১৯৯৫ থেকে ২০২২) বৃষ্টিপাতের তথ্য বিশ্লেষণ করে বলা হয়, মেঘালয় ও আসামে যদি ২০০ মিলিমিটার এবং সিলেটে ৪০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয় তবে সিলেট অঞ্চলে গুরুতর আকস্মিক বন্যা দেখা দেয়। গবেষণায় আরো বলা হয়, সিলেট অঞ্চলে ২০০ থেকে ৯৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত মোট বৃষ্টিপাতকে জোরালোভাবে প্রভাবিত করে।
গবেষণায় আরো বলা হয়, মেঘালয়ের অতিবৃষ্টি সিলেটে বন্যার একটি অন্যতম কারণ। এটি জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সম্পর্কিত।
ভারতের আওতায় বাংলাদেশের অনেক নদীর অবস্থান; এরমধ্যে ১৬টি আন্তঃদেশীয় নদীর তথ্য আছে। এ তথ্য উল্লেখ করে গবেষণায় বলা হয়, দু’দেশের মধ্যে পানি-পলি ব্যবস্থাপনার যৌথভাবে কোন চুক্তি নেই। যার ফলে ভারত পানিপ্রবাহকে অনেক ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ করছে। উল্লেখিত কারণ ছাড়াও আরো যে বিষয়গুলোকে সিলেট এলাকায় বন্যার জন্য দায়ী করা হয়ে থাকে- সেগুলো হচ্ছে অপরিকল্পিত বাঁধ, রাস্তা, অবকাঠামো নির্মাণ, নদীর তলদেশ ভরাট, বিভিন্ন হাওর ভরাট ইত্যাদি ।
সম্প্রতি সিলেটে বন্যাদুর্গত এলাকা পরিদর্শনকালে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক জানান, ভারত থেকে প্রতিবছর বাংলাদেশের নদ-নদীতে ১.২ মিলিয়ন টন পলি আসে। তবে, সিলেটে কি পরিমাণ পলি আসে-এ ব্যাপারে নিশ্চিত কোন তথ্য পাওয়া যায়নি।
বিশেষজ্ঞরা যা বলেনঃ-
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) পরিবেশ ও পুর প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. জহির বিন আলম বলেন, ১৯৭১ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত সুরমা নদী একবারও পুরোপুরি খনন করা হয়নি। বন্যার সাথে উজান থেকে পলি এসে এরই মধ্যে সুরমা নদী ভরাট হয়ে গেছে। আবার অনেকে নদী দখল করে বাসা-বাড়িও বানাচ্ছে। এ কারণে মাটি লোজ হয়ে নদীর তলদেশ ভরাট হচ্ছে। নদী ভাঙনের চেয়ে নদীতে জমাট হওয়া পলির পরিমাণ বেশি বলে তার মন্তব্য।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. আব্দুর রব বলেন, সিলেট অঞ্চলে বন্যার জন্য নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়া, প্রাকৃতিক রিজার্ভার নষ্ট হয়ে যাওয়াই মূলত দায়ী। তিনি বলেন, নদীর পাশে এবং পার্শ্বদেশে মানুষের কার্যক্রম, কৃষিকাজ, ব্রিজ কালভার্ট তথা স্ট্রাকচারাল ইন্টারভেনশন বাড়ছে। এ থেকে ইরোশন (ভাঙন) হয়। ইরোডেড মেটেরিয়ালস (ক্ষয়প্রাপ্ত বস্তু) গিয়ে তলদেশে জমা হয়। তলদেশ ভরাট হয়ে উচু হয়ে যায়। ক্যারিং ক্যাপাসিটি (ধারণ ক্ষমতা), ওয়াটার রিমুভাল ক্যাপাসিটি (অপসারণ ক্ষমতা) কমে যায়। তার ফলে এটা সাবমার্জ (প্লাবিত) করে। এজন্য নদীতে সায়েন্টেফিক ড্রেজিং করতে হবে। এজন্য সাইডে লম্বা বাঁধ দিয়ে রাস্তা তৈরি করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় স্থানে স্লোপ দিতে পারি। পাশাপাশি হাওরগুলোতে ন্যাচারাল রিজার্ভার হিসেবে রাখতে হবে। হাওরগুলোর ক্যাপাসিটি ডেভেলপ করতে হবে। এজন্য হাইড্রোলজিস্ট (পানি বিশারদদের) পরামর্শ নিতে হবে।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা কেবল একদেশের সমস্যা না। এটা আন্তঃদেশীয় সমস্যা। মেঘালয়ে বৃষ্টি হলে সেখানকার পানি সারী-পিয়াইন হয়ে সুরমায় এসে পড়ে। এজন্য যৌথ নদী কমিশনের সভায় এর পরিণতি নিয়ে আলোচনা করতে হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশের মানুষকে বন্যার সাথে অ্যাডজাস্ট করে বাড়ি-ঘর এবং রাস্তা-ঘাট নির্মাণ করতে হবে।
পরিবেশ রক্ষায় আমরা (ধরা)-এর সাধারণ সম্পাদক ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)-এর সাবেক সাধারণ সম্পাদক শরিফ জামিল বলেন, সিলেট অঞ্চলের নদ-নদীসমূহ ভরাট হবার পেছনে প্লাস্টিক, মানুষের সাথে কথা না বলে বড় বড় প্রকল্প গ্রহণ এবং সমস্যা নিয়ে কর্তৃপক্ষের অবজ্ঞাকে দায়ী করেন। বন্যা-জলাবদ্ধতা থেকে সিলেট অঞ্চলকে মুক্ত করতে সরকারের সদিচ্ছা প্রয়োজন-এই মন্তব্য করে তিনি বলেন, এজন্য ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এর সাথে বিজ্ঞান, মানুষের সম্পৃক্ততা ও জবাবদিহিতার বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে।