নগরির যত্রতত্র বেলুন বিক্রির আড়ালে চলছে রকমারী ‘ক্রাইম’
চঞ্চল মাহমুদ ফুলর
সত্যবাণী
সিলেট থেকেঃ সুলতানা। সঙ্গীরা তাই বলে ডাকলো। বয়স আর কতোই হবে, ১০ বা ১১ বছর।হাতে ফুলানো নানা রঙের একগুচ্ছ বেলুন। হাতের বেলুনগুলো রঙিন হলেও সুলতানার চেহারা মলিন। পরণের সালোয়ার-কামিজ লাল রঙ্গের হলেও অপরিচ্ছন্ন হওয়ায় ধারণ করেছে কালচে বর্ণ।প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস বা সিএনজিচালিত অটোরিকশা দেখলেই দৌঁড়ে কাছে যাচ্ছে। একটি বেলুন কেনার জন্য জানাচ্ছে আকুতি। সুলতানার টার্গেট গাড়িতে থাকা ছোট্ট শিশুরা। ওদের কোনোভাবে বেলুনের প্রতি প্রলুব্ধ করতে পারলেই মা-বাবাকে জোর বায়না করবে কিনে দেয়ার জন্য। আর একটি বেলুন কিনে দিলেই সুলতানার মলিন মুখে ফুটবে তৃপ্তির হাসি। দৃশ্যটি ১০ জানুয়ারি মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সিলেট নগরির জিন্দাবাজার পয়েন্টের। শুধু এই সুলতানাই নয়, জিন্দাবাজার, চৌহাট্টা, আম্বরখানা ও বারুতখানা এলাকায় এমন শতাধিক শিশু-কিশোর সকাল থেকে মধ্যরাত অবধি বেলুন বিক্রি করে। বেলুন বিক্রি করতে গিয়ে অনেক সময় তারা পড়ে প্রচন্ড ঝুঁকিতে। চলমান গাড়ির পাশাপাশি দৌঁড়াতে গিয়ে ঘটে যায় বড় দুর্ঘটনা। যে বয়সে সুলতানাদের পড়ালেখা করার কথা, সে বয়সেই তাদের পড়তে হয়েছে কঠিন এ পরিস্থিতিতে।
তবে এই বেলুন বিক্রির আড়ালে রয়েছে ভয়ংকর এক ‘ক্রাইম’র গল্প। সিলেটে কয়েকটি চক্র বা গ্রুপ সুলতানাদের বাধ্য করে বেলুন বিক্রি করতে। বেলুন বিক্রির টাকার বড় অংশ চলে যায় এসব গ্রুপের লিডারের হাতে। এমন একটি গ্রুপের ‘লেডি লিডার’ চুমকি নামের এক তরুণী। চৌহাট্টা এলাকায় তার অবাধ বিচরণ। তার অধীনস্থরা বলছে, চুমকির সঙ্গে ধারালো ব্লেড ও চিকন ছুরি থাকে। বেলুন বিক্রির পাশাপাশি শিশু-কিশোরদের চুরি ও ছিনতাই কাজেও ব্যবহার করে সে। ব্যবহার করে মাদক বিক্রির কাজেও। মাদক বিক্রির ফাঁদে পড়ে একসময় এসব শিশু-কিশোরও হয়ে পড়ে মাদকসেবী। তারা প্রায় সবাই-ই ড্যান্ডি নামক মাদক সেবন করে। এসব তারা করে প্রকাশ্যেই, বিভিন্ন মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশের সামনেও।অপরদিকে, কিছু শিশু-কিশোরের মা-বাবা নিজেরা কোনো কাজকর্ম না করে সন্তানদের এভাবে বেলুন বিক্রিতে জড়িয়ে পরিবারের আয়ের উৎস বানিয়েছে। সিলেটের রাস্তায় এসব কোমলমতিদের বেলুন বিক্রি বা অপরাধে জড়ানোর বিষয়ে কেউ দায় এড়াতে পারবে না বলে সচেতন মহলের মন্তব্য।আর প্রশাসন বলছে, শিশু-কিশোরদের ক্ষেত্রে প্রাপ্তবয়স্কদের মতো করে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায় না। তাদের মূলত কাউন্সেলিং করে বিপথ থেকে ফেরাতে হয়। সে ক্ষেত্রে পুলিশের চাইতে শিশু-কিশোরদের নিয়ে কাজ করা সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোর ভূমিকা বেশি দরকার। কাউন্সিলিং করে তাদের সুপথে ফেরাতে হবে।
জানা গেছে, নগরির জিন্দাবাজার, চৌহাট্টা, আম্বরখানা ও বারুতখানা এলাকায় শতাধিক শিশু-কিশোর বেলুন বিক্রি করে। তাদের এলাকা ভাগ করা থাকে। এক এলাকার দল আরেক এলাকায় বেলুন বিক্রি করতে পারে না। অন্যের এলাকায় ঢুকে পড়লে তাদের মধ্যে মারামারির ঘটনাও ঘটে। এলাকাভিত্তিক একেকটি গ্রুপের নেতৃত্ব দেয় একেকজন। এরকমই একজনের নাম চুমকি। তার অধীনে ৪০ টি শিশু-কিশোর বেলুন বিক্রি করে। এদের দিয়ে চুমকি চুরি-ছিনতাই কাজও করায়। ১৫-১৬ বছর বয়েসি কিশোরীদের দিয়ে সে অনৈতিক কাজও করায় বলে অভিযোগ রয়েছে। চুমকি সবসময় নিজের সঙ্গে ধারালো ব্লেড ও চিকন ছুরিও রাখে। চৌহাট্টা এলাকা তার দখলে।চুমকির মতো আরও অন্তত ৮-১০ জন গ্রুপ লিডার রয়েছে, যারা এসব শিশু-কিশোরকে দিয়ে বেলুন বিক্রির পাশাপাশি ‘ক্রাইম’ করায়। এসব শিশু-কিশোরের সবাই আবার ছিন্নমূল নয়, অনেকেরই বাবা-মা আছেন। তারা নগরির বিভিন্ন এলাকার কলোনিতে বাস করেন। বিষয়টি নিয়ে কথা হয় সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের (এসএমপি) সঙ্গে। এসএমপি’র অতিরিক্ত উপ-কমিশনার সুদ্বীপ দাস গণমাধ্যমকে বলেন, শিশু-কিশোরদের ক্ষেত্রে প্রাপ্তবয়স্কদের মতো করে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায় না। তাদের মূলত কাউন্সেলিং করে বিপথ থেকে ফেরাতে হয়। সে ক্ষেত্রে পুলিশের চাইতে শিশু-কিশোরদের নিয়ে কাজ করা সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোর ভূমিকা বেশি দরকার। কাউন্সেলিং করে তাদের সুপথে ফেরাতে হবে। তিনি বলেন, তারপরেও রাস্তাঘাটে যাতে তারা বিশৃঙ্খলা করতে বা অপরাধমূলক কর্মকা- না ঘটাতে পারে সেজন্য সংশ্লিষ্ট থানাকে নির্দেশ দেয়া হবে।এ বিষয়ে সমাজসেবা অধিদফতরের সিলেট বিভাগীয় পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্বে) মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, সিলেটের এমন শিশু-কিশোরদের বিষয়ে সঠিক তথ্য আমাদের কাছে নেই। তবু বিষয়টি যেহেতু অবগত হলাম, সেহেতু তাদের নিয়ে কাজ করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।তিনি বলেন, চাইল্ড সেনসিটিভ সোস্যাল প্রটেকশন ইন বাংলাদেশ (সিএসপিবি) প্রকল্পের আওতায় আমাদের কিছু সমাজকর্মী রয়েছেন, তাদের মাধ্যমে এসব শিশু-কিশোরকে কাউন্সেলিং করে সুপথে ফেরানোর চেষ্টা করা হবে। এক প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম বলেন, সিলেট শহরে থাকা পথশিশু, ছিন্নমূল শিশু বা বর্ণিত শিশু-কিশোরদের সঠিক পরিসংখ্যান আমাদের কাছে নেই।