নতুন মাতৃভাষা দিবসের ডাক

দিলীপ মজুমদার

গেরুয়া শিবিরের কর্মধারা দেখে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের একটি গানের কথা মনে পড়ে : ‘নতুন কিছু করো একটা নতুন কিছু করো ।বাস্তবিক,গত ছয় বছর ধরে তাঁরা একটার পর একটা নতুন কিছু করে যাচ্ছেন।রাম জন্মভূমি উদ্ধার থেকে ভারতের প্রাচীন শাস্ত্র ও সাহিত্যে আধুনিক বিজ্ঞানের সন্ধান,নোটবন্দি, জিএসটি, কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা রদ,অচ্ছে দিন আনার তোড়জোড়, সবকা সাথ বিকাশ. গোমুত্র পানে করোনা থেকে পরিত্রাণ ইত্যাদি ইত্যাদি । সেই ধারাতে সংযোজিত হতে যাচ্ছে নতুন মাতৃভাষা দিবস ।

রাষ্ট্র সঙ্ঘ ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি দিয়েছেন । কিন্তু বঙ্গের গেরুয়া শিবিরের নেতারা ২১ ফেব্রুয়ারির পরিবর্তে ২০ সেপ্টেম্বরকে মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করার ডাক দিয়েছেন । এ নিয়ে ফেসবুকে ও সমাজ মাধ্যমে বেশ কয়েক দিন তাঁরা লাগাতার প্রচার চালিয়েছেন । ২০১৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বর উত্তর দিনাজপুর জেলার একটি স্কুলে উর্দু শিক্ষক নিয়োগের প্রতিবাদ করেছিলেন তাঁদের কর্মীরা । ‘উর্দুপ্রেমিক’ রাজ্য সরকারের পুলিশের গুলিতে তাঁদের দুজন কর্মী- তাপস বর্মণ ও রাজেশ সরকার নিহত হন । গেরুয়া শিবিরের মতে এঁরাই এপার বাংলার ভাষা শহিদ । যে উর্দু বা আরবির প্রভাবে বাংলা ভাষা বিপন্ন, তার প্রতিবাদ এঁরা করেছিলেন, তাই তাঁরা ভাষা শহিদ ।
বঙ্গের গেরুয়া সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসু বলেন, ‘ এ রাজ্যে ২১শে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা দিবস পালন করেছে বামপন্থী ও কংগ্রেসীরা । ওটা বাংলাদেশের ঘটনা, তার সঙ্গে এ রাজ্যের কোন সম্পর্ক ছিল না ।’ ভাগ্য ভালো, বামপন্থী ও কংগ্রেসিদের এক হাত নিলেও শ্রীবসু বা তাঁর অনুগামীরা রাষ্ট্রসঙ্ঘকে অভিযুক্ত করেন নি । এই প্রসঙ্গে তিনি এ রাজ্যে উর্দু আগ্রাসনের দিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, ‘ এই যে আজকে পশ্চিমবঙ্গে জলের পরিবর্তে পানি, রামধনুর পরিবর্তে রংধনু, আকাশের পরিবর্তে আসমান বা পিসির পরিবর্তে ফুপি চাপিয়ে দেওয়ার মতো ব্যাপার-স্যাপার চলছে তাতেই বোঝা যায় বাংলা ভাষা আক্রান্ত ।’
উর্দু আগ্রাসনের জন্য বাংলা ভাষা আক্রান্ত কি না, এ বিষয়ে ভাষাবিদদের মতামত গ্রহণের দায় সায়ন্তনবাবুদের নেই । তাঁরা বরাবর নতুন কিছু ভাবতে ও করতে উৎসাহী । উর্দু আগ্রাসন যদি কোথাও থাকে, সেটা ছিল পূর্ববাংলায় । পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসকরা পূর্ববাংলার মানুষদের উপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলেন উর্দু । কিন্তু মাতৃভাষা বাংলার বদলে তাঁরা উর্দু গ্রহণ করতে চান

নি । তাই অসম লড়াইতেও জীবন বাজি রেখেছিলেন । সায়ন্তনবাবু ‘ওটা বাংলাদেশের ঘটনা’ বলে পাশ কাটাতে চেয়েছেন । কিন্তু লড়াইটা তো ছিল বাংলাভাষার জন্য, যেটা এপার বাংলারও মাতৃভাষা । আর সে লড়াইটা ছিল ব্যাপক, দীর্ঘস্থায়ী, আত্মদানের সংখ্যাও বিশাল । বাংলাভাষার জন্য এই লড়াই ও আত্মদানের গৌরবকে গেরুয়া শিবির স্বীকার করতে চান না ।
সায়ন্তনবাবুরা বলেছেন তৃণমূল শাসকদের আনুকূল্যে এ রাজ্যে উর্দু আর আরবির বাড়বাড়ন্ত । উর্দু বা আরবি ভাষা নয়, এঁদের মূল লক্ষ্য ‘মুসলমান’ ; হিন্দু ভোটের জন্য মুসলমান বিদ্বেষ প্রচার । উর্দুর কথা যখন উঠল, তখন বলা যায় সেভাষা ভারতেরই । বিশেষজ্ঞদের মতে পঞ্জাবের লাহোর প্রদেশে উর্দুর ( অন্য নাম : হিন্দাই, দেহলভি, রেখতা) উৎপত্তি হলেও তার বিকাশ দিল্লি, হরিয়ানার একাংশ ও দক্ষিণ ভারতে । এ ভাষা ছড়িয়ে পড়ে মহারাষ্ট্র, কর্নাটক, তেলেঙ্গানায় । উর্দুকে দখনি বা দক্ষিণি বলেও বলা হত । ভারতের সংবিধানে এটি অন্যতম সরকারি ভাষা । দেশের কারেন্সি নোটে যে ১৫ টি ভাষার মুদ্রার মান থাকে, উর্দু তার একটি । শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, কাশ্মীর, তেলেঙ্গানা, উত্তরপ্রদেশ, বিহারের সরকারি ভাষাও উর্দু । ভারতের প্রায় ৫০টি শহরে উর্দুভাষী মানুষ থাকেন ।
সায়ন্তনবাবুরা পানি, আসমান, রংধনু- এসব শব্দের বিরুদ্ধে জেহাদ করছেন. কিন্তু বাংলার শব্দভাণ্ডারে যে অজস্র মুসলমানি শব্দ ঢুকে আছে তাকে বাদ দেবেন কিভাবে ? ভাষাতাত্ত্বিক সুকুমার সেন বলেছেন, ‘ বাঙ্গালায় প্রায় আড়াই হাজার শব্দ ফারসী অথবা ফারসীর মারফৎ আরবী ও তুর্কী হইতে আসিয়াছে । ষোড়শ শতাব্দের শেষভাগ হইতে, বিশেষ করিয়া মোগল শাসনের সূত্রপাতের পর, এ-জাতের শব্দের প্রবেশ অসম্ভব রকম বাড়িয়া যায় ।’ সায়ন্তনবাবুরা পানির বদলে জল, আসমানের বদলে আকাশ, রংধনুর বদলে রামধনু বলুন, কিন্তু ‘আন্দাজ’, ‘খরচ’, ‘শহর’, ‘জাহাজ’, ‘নগদ’, ‘কম’, ‘বস্তা’, ‘খুব’,’আইন’, ‘হুঁকা’, ‘আক্কেল’, ‘জোর’, ‘রেশম’, ‘আতর’, ‘কাবু’,’’বোঁচকা’—এসব শব্দের বদলে কি বলবেন ভেবে রাখুন । মুসলমানি শব্দে তাঁদের আপত্তি, কিন্তু পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, ফরাসি, এবং বিশেষ করে ইংরেজি শব্দের বেলায় কি বলবেন তাঁরা ? তাহলে তো ‘আলপিন’, ‘গামলা’, ‘বাসন’, ‘জানালা’, ‘চাবি’, ‘মিস্ত্রি’, ‘পেয়ারা’, ‘তামাক’, ‘অফিস’, ‘পুলিশ’, ‘লণ্ঠন’, ‘চেয়ার’, ‘টেবিল’, ‘ফোন’, ‘থিয়েটার’, ‘সিনেমা’ সবকেই বাতিল করতে হয় ।
এ রাজ্যের গেরুয়া শিবিরের নেতারা ভাষার আগ্রাসনের কথা বলছেন । আগ্রাসন আছে, তবে সেটা উর্দুর নয়, হিন্দির । গেরুয়া শিবিরের ঘোষিত নীতি ‘হিন্দু হিন্দি হিন্দুস্তান’ এবং ‘এক রাষ্ট্র এক

ভাষা’ । গত বছর ‘হিন্দি দিবসে’ অমিত সাহ সেই ‘এক ভাষা’ বলতে হিন্দিকে বুঝিয়েছিলেন । সম্প্রতি সংস্কৃতি মন্ত্রক হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা বলে ফেসবুকে উল্লেখ করে বলেন, ‘বিশ্বের ৭৭০ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ভারতীয়দের আলাদা পরিচিতি দিয়েছে রাষ্ট্রভাষা হিন্দি ।’ প্রতিবাদের বহর দেখে পরে পোস্টটি মুছে ফেলা হয় । রাষ্ট্রসঙ্ঘে হিন্দিকে সরকারি ভাষা করার চেষ্টা চলে । বিমান বন্দরে হিন্দি বলতে না চাওয়ায় নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলেন সিকিউরিটি অফিসার । মেঘালয়ের রাজ্যপাল তথাগত রায় বলেন, ‘বাঙালি মেয়েরা মুম্বাইতে বার-ড্যান্স করতে পারলে হিন্দি শিখতে আপত্তি কোথায় ?’ হিন্দি চাপিয়ে দেবার জন্য জাতীয় শিক্ষানীতিতে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত হিন্দিভাষা শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে । হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেবার আগে গেরু্য়া শিবির জল মাপতে চাইছেন, দেখে নিতে চাইছেন কোথায় বিতর্ক উঠছে । তারপরেই তাঁরা প্রয়োগ করবেন কাশ্মীর মডেল ।

(লেখক: কলকাতার অধিবাসী, সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক ও লেখক, সত্যবাণীর কন্ট্রিবিউটিং কলামিষ্ট)

You might also like