নবম মৃত্যুবার্ষিকীতে লন্ডনে স্মরণ সভা: নোরা শরীফ ছিলেন খাটি বাঙালীয়ানায় পরিশুদ্ধ একজন বিশ্ব নাগরিক

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
সত্যবাণী 

লন্ডন: বাংলাদেশের রাষ্ট্রিয় খেতাব ‘ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ’ প্রাপ্ত ব্রিটিশ-আইরিশ নাগরিক ব্যারিষ্টার নোরা শরিফের নবম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক স্মরণ সভায় বক্তারা বলেছেন, নোরা ছিলেন খাটি বাঙালিয়ানার চেতনায় পরিশুদ্ধ একজন বিশ্ব নাগরিক। বাঙালির স্বাধীকার আন্দোলনের একজন সাহসি কর্মী হিসেবে মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ের প্রতিটি স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলনে তিনি ভূমিকা রেখেছেন একজন বঙ্গসন্তানের মত, বাংলাদেশকে হৃদয়ে ধারণ করে। বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়ার মাধ্যমে তাঁর যে নতুন জীবন প্রণালী শুরু হয়েছিলো মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চলাফেরা, আচার আচরণে সেটিই তিনি ধারণ করে গেছেন।

প্রয়াত স্ত্রী নোরা শরীফকে স্মরণ করছেন মুক্তিযুদ্ধের প্রবীন সংগঠক সুলতান শরীফ

বাংলাদেশের প্রয়াত এই  ‘বিদেশী বন্ধু’র স্মরণে সদ্য গঠিত সংগঠন ‘নোরা শরীফ ফাউন্ডেশন’ এর উদ্যোগে মঙ্গলবার, ২৯শে নভেম্বর পূর্ব লন্ডনের ব্রান্সলি ষ্ট্রিটের কলিংউড হলে অনুষ্ঠিত ঐ স্মরণসভায় সভাপতিত্ব করেন ব্রিটেনে বাংলাদেশের হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনিম। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ ফারুকের পরিচালনায়  অনুষ্ঠিত স্মরণসভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেছা ইন্দিরা। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের সচিব মো: হাসানুজ্জামান কল্লোল, সিলেট-২ আসনের সাবেক সাংসদ ও সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শফিকুর রহমান চৌধুরী ও সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি, সাবেক ছাত্রনেতা আসাদ উদ্দিন আহমদ।

লন্ডন মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা আলতাফুর রহমান মেজাহিদের কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে শুরু হওয়া স্মরণ অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন ব্যারিষ্টার নোরা শরীফের স্বামী, ব্রিটেনে মুক্তিযুদ্ধের প্রবীন সংগঠক, যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সভাপতি সুলতান মাহমুদ শরীফ, যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নঈমুদ্দিন রিয়াজ,  শাহ আজিজুর রহমান, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় নেতা আনসার আহমেদ উল্লাহ, যুক্তরাজ্য শাখার সভাপতি, সাংবাদিক সৈয়দ আনাস পাশা, যুক্তরাজ্য মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী হোসনে আরা মতিন, ন্যাপের যুক্তরাজ্য সভাপতি আব্দুল আজিজ ময়না, জাসদ নেতা মুজিবুল হক মনি, যুক্তরাজ্য আওয়ামীলীগ সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য তারিফ আহমেদ, স্মরণ অনুষ্ঠানের চার উদ্যোক্তা যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল আহাদ চৌধুরী, সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য শাহ শামীম আহমেদ, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সহসভাপতি, যুক্তরাজ্য যুবলীগ নেতা জামাল খান ও যুক্তরাজ্য ছাত্রলীগ নেতা সরোয়ার কবির, যুক্তরাজ্য যুবলীগ সাধারণ সম্পাদক সেলিম খান,  আওয়ামী লীগ নেতা জোবায়ের আহমেদ, কৃষকলীগ নেতা সৈয়দ তারেক ও সৈয়দ কামরুল প্রমূখ। স্মরণসভা চলাকালীন পুরো সময় মঞ্চের সামনে দর্শক সারিতে উপস্থিত ছিলেন নোরা শরীফের স্বামী, ব্রিটেনে মুক্তিযুদ্ধের প্রবীন সংগঠক  সুলতান শরিফ। 

বক্তব্য রাখছেন সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শফিকুর রহমান চৌধুরী

বক্তারা প্রয়াত নোরা শরিফকে বাংলাদেশের একজন অকৃত্তিম বন্ধু আখ্যায়িত করে বলেন, একজন আইরিশ নাগরিক হলেও তিনি মূলত বাংলাদেশকেই হৃদয়ে ধারণ করতেন। তারা বলেন, মাতৃভাষা রক্ষার আন্দোলনে বাঙালির জীবন বিসর্জনের ইতাহাস চর্চা করে জন্মসূত্রে আইরিস নাগরিক নোরা এমনই অভিভূত হয়েছিলেন যে, বাংলা, বাঙালী ও বাংলা নামের ভূখন্ডটি তাঁর কাছে হয়ে উঠেছিলো নমস্য।

নোরাকে একজন অসাধারণ মানুষ আখ্যায়িত করে বক্তারা বলেন, মানুষ মানুষের জন্যে, একাত্তরে বাঙালিদের পক্ষে অবস্থান নিয়ে নোরা সেটিই প্রমান করেছেন। মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসায় দেশের সীমানা প্রাচীর যে কোন বাধা নয়, প্রয়াত নোরা শরীফ মত্যুর আগ পর্যন্ত তার প্রমান দিয়ে গেছেন। বাঙালীর প্রতিটি সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ বিরোধী আন্দোলনে নোরার সরব উপস্থিতি বাঙালির ইতিহাসকেই সমৃদ্ধ করে গিয়েছে।

নোরা শরীফকে বাংলাদেশের আজীবন সুহৃদ আখ্যায়িত করে বক্তারা বলেন, বাংলাদেশ তাঁকে ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ খেতাবে ভূষিত করে বাঙালির ইতিহাসের অংশ করে নিয়েছে, এই ইতিহাস আরো সমৃদ্ধ করতে এখন প্রয়োজন তাঁকে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রিয় স্বীকৃতি দেয়া। বক্তারা স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার দায়িত্বপালনকারী ব্যারিষ্টার নোরা শরিফের নামে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়টির কোন একটি স্থাপনার নামকরণ দাবী করে বলেন, একজন বিদেশী হয়েও যিনি বাঙালীর অস্থিত্বের সাথে মিশে গিয়েছিলেন, ঋণ স্বীকারের দায় থেকে হলেও বাংলাদেশের উচিত তাঁকে এই স্বীকৃতি দেয়া।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্যে ‘ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ’ পদক প্রাপ্ত ব্রিটিশ-আইরিশ নাগরিক ব্যারিষ্টার নোরা শরীফ ২০১৩ সালের ২৯ নভেম্বর লন্ডনে ইন্তেকাল করেন। ব্রিটেনে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্যে ব্যারিষ্টার নোরা শরীফকে ২০১২ সালে ‘ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ’ পদকে ভূষিত করে বাংলাদেশ সরকার। ১৯৪৩ সালের ২৩ শে মার্চ জন্মগ্রহনকারী এই মহিয়সী নারী জন্ম গ্রহন করেছিলেন আয়ারল্যান্ডের ডাবলিন শহরে।  মায়ের মৃত্যুর পরে প্রথম ও ২য় পক্ষের মোট ৯ ভাই বোনের সংসারে নোরা ভাই-বোনদের দেখাশোনা করতেন। পরবর্তীতে গ্রাজুয়েশন শেষে লন্ডনে ব্যবস্থাপনার উপরে কোর্স করতে আসেন ১৯৬৪ সালে, এরই এক পর্যায়ে পুর্ব পাকিস্তান ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত হয়ে পড়েন এবং সুলতান শরীফের সাথে পরিচয় ঘটে। জন্মসূত্রে আইরিশ নাগরিক ব্যারিষ্টার নোরা শরীফ শুধু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধই নয়, এর আগ থেকেই বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের বিভিন্ন পর্বে পালন করেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ১৯৬৭ সালে সুলতান শরীফের সাথে পরিচয় হওয়ার পর থেকেই এই সংগ্রামী নারীর ঘনিষ্টতা শুরু হয় ব্রিটেনের বাঙালীদের প্রতি। সুলতান শরীফের কাছ থেকে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ভারত ভাগের পর পাকিস্তানের অংশ হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্তি, বাঙালিদের প্রতি পশ্চিমাদের বৈষম্যনীতি ইত্যাদি বিষয় ব্যাপক ভাবে জেনে নেন বাঙালিদের বিষয়ে আগ্রহী এই আইরিশ নাগরিক।  ৬দফা আন্দোলনের শুরু থেকেই নোরা সরাসরি যুক্ত হন এই আন্দোলনে। ইতোমধ্যে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ব্রিটেনে ছয়দফা আন্দোলনের তৎকালীন তরুণ নেতা সুলতান শরীফের সাথে। ছয়দফা আন্দোলনের পক্ষে জনমত গড়তে নোরা শরীফ লিফলেট হাতে ছুটে বেড়িয়েছেন ব্রিটেনের বিভিন্ন শহরে। ৬দফা আন্দোলন, ৬৯ এর গণ অভুত্থান, ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধসহ স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের প্রতিটি সামরিক স্বৈরশাসন বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নোরা শরীফ ছিলেন রাজপথের স্বক্রিয় কর্মী। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হলে এর বিরোদ্ধে দেশের ন্যায় ব্রিটেনেও গড়ে উঠে তুমুল আন্দোলন। ব্যারিষ্টার নোরা শরীফ এই আন্দোলনেও পালন করেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বিশিষ্ট ব্রিটিশ আইনজীবি থমাস উইলিয়ামকে বঙ্গবন্ধুর হয়ে লড়তে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানোর চেষ্টায় নোরার রয়েছে বিশেষ অবদান। ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বজনমত গঠনে অন্যান্য বিদেশী নাগরিকদের সাথে নোরা পালন করেন ঐতিহাসিক ভূমিকা। ব্রিটিশ এমপিদের সাথে বাংলাদেশের পক্ষে অব্যাহত লবিং এ নোরার তখন নাওয়া খাওয়া সব কিছু বাদ। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ব্রিটিশ জনগনের সহানুভূতি আদায়ে স্বামী সুলতান শরীফ ও অন্যান্য সহকর্মীদের নিয়ে দিনের পর দিন ব্রিটেনের বিভিন্ন শহর চষে বেড়িয়েছেন নোরা শরীফ। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রয়াত ব্রিটিশ এমপি ও মন্ত্রী লর্ড পিটার শোসহ অন্যান্য ব্রিটিশ এমপিদের সমর্থন আদায়ে নোরা শরীফের ভূমিকা বাঙালির ইতিহাসের অংশ। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় লাভের পর ১৯৭২ সালে নোরা প্রথম সফর করেন বাংলাদেশ। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের পর ক্ষমতা দখলকারী বিভিন্ন স্বৈরাচারী শাসকদের বিরোদ্ধেও রাজপথে ছিলেন নোরা শরীফ। বাংলাদেশে বর্তমান সরকারের ক্ষমতা গ্রহনের পর ৭১ এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবোনালের পক্ষেও জনমত সংগ্রহে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বিশেষ ভূমিকা রেখে গেছেন ব্যারিষ্টার নোরা শরীফ। যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদন্ডের রায় ঘোষণার পর বাংলাদেশে তরুণ প্রজন্মের যে ‘শাহবাগ গনজাগরণ’ গড়ে উঠে, এর সমর্থনেও ব্রিটেনের তরুণ বাংলাদেশীদের সাথে নোরা ছিলেন রাজপথে। গনজাগরণ মঞ্চ, আইসিটি সাপোর্ট ফোরাম, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিসহ যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি আদায়ের আন্দোলনে স্বক্রিয় সংগঠনগুলোর উদ্যোগে ট্রাফালগাল স্কোয়ার, হাইডপার্ক কর্ণার, লন্ডনের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারসহ ব্রিটেনের বিভিন্ন শহরে আয়োজিত কর্মসূচীগুলোতেও নোরা শরীফের ছিল সরব উপস্থিতি।

You might also like