নানকার কৃষক বিদ্রোহের ঐতিহাসিক দিবস আজ

 

চঞ্চল মাহমুদ ফুলর
সত্যবাণী

সিলেট থেকেঃ আজ ১৮ আগস্ট। নানকার কৃষক বিদ্রোহের ঐতিহাসিক দিবস আজ। ১৯৪৯ সালে এই দিনে সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার সানেশ্বর ও উলুঊরী গ্রামে সংঘটিত হয়েছিল ঐতিহাসিক কৃষক বিদ্রোহ। যাকে নানকার কৃষক বিদ্রোহ নামে ইতিহাসের পাতায় স্থান দেয়া হয়েছিল।বাংলার মানুষের কাছে আগস্ট মাসটি ঐতিহাসিক নানা কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নানকার কৃষক বিদ্রোহের এই রক্ত¯œাত দিন ছাড়াও ’৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারকে পৈশাচিক কায়দায় হত্যা, ২০০৪ সালে ৭ আগস্ট সিলেটের গুলশান সেন্টারে গ্রেনেড হামলা, একই সালের ১৭ আগস্ট দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলা, ২০০৫ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীতে তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের উপর গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। এ সমস্ত কারণে আগস্ট মাস বাংলা ভাষাভাষি মানুষের কাছে আলাদা একটি আবহ নিয়ে আসে।

ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ আমলে সামন্তবাদী ব্যবস্থার সবচেয়ে নিকৃষ্ট শোষণ পদ্ধতি ছিল নানকার প্রথা। নানকার প্রজারা জমিদারের দেয়া বাড়ি ও সামান্য কৃষি জমি ভোগ করতেন। তাদের খাজনা দিতে হতো না। কিন্তু ওই জমি বা বাড়ির উপর তাদের মালিকানা ছিল না। তারা বিনা মজুরিতে জমিদার বাড়িতে বেগার খাটতো। চুন থেকে পান খসলেই তাদের উপর চলতো অমানুষিক নির্যাতন।ব্রিটিশদের সেই অমানিবক প্রথা এবং নির্যাতনের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছিল সিলেট অঞ্চলের মানুষ। ১৯৪৯ সালের ১৮ আগষ্ট এই দিনে দুঃসহ নানকার প্রথার বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ শুরু হয় সিলেটের বিয়ানীবাজার থানায়। বিপ্লবের সূচনালগ্নে ওইদিন উপজেলার সানেশ্বর ও উলুউরী গ্রামের মধ্যবর্তী সুনাই নদীর তীরে তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস্ তথা ইপিআর’র গুলিতে নিহত হন কৃষক ব্রজনাথ দাস (৫০), কটুমনি দাস (৪৭), প্রসন্ন কুমার দাস (৫০), পবিত্র কুমার দাস (৪৫) ও অমূল্য কুমার দাস (১৭)। ঠিক এর ১৫দিন আগে সুনাই নদীর খেয়াঘাটে জমিদারের লাঠিয়ালদের হাতে রজনী দাস নামের আরও এক কৃষক প্রাণ হারান। এই আত্মদানে রক্তাক্ত পরিসমাপ্তি ঘটে নানকার আন্দোলনে। তবে এর ফলশ্রুতিতে ১৯৫০ সালে তৎকালীন সরকার জমিদারী প্রথা বাতিল ও নানকার প্রথা রদ করে কৃষকদের জমির মালিকানার স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়।

বাঙালি জাতির সংগ্রামের ইতিহাসে বিশেষ করে অধিকারহীন মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যে সকল গৌরবমন্ডিত আন্দোলন-বিদ্রোহ সংগঠিত হয়েছিল তার মধ্যে নানকার বিদ্রোহ অন্যতম। নানকার বিদ্রোহ ছিল পাকিস্তান আমলে বাঙালিদের অধিকার আদায়ের প্রথম সফল সংগ্রাম। উর্দু বা ফার্সি শব্দ ‘নান’ এর বাংলা প্রতিশব্দ রুটি। তাই রুটির বিনিময়ে যারা কাজ করতেন তাদেরকে বলা হতো ‘নানকার’। সোজা বাংলা প্রতিশব্দ ‘পেটে-ভাতে’ কাজ করতে হতো। আর রুটির বিনিময়ে কাজের যে প্রথা তাকেই ‘নানকার প্রথা’ বলা হয়। ব্রিটিশ আমলে সামন্তবাদী সমাজ ব্যবস্থার এটি ছিল সবচেয়ে নিকৃষ্টতম প্রথা। নানকার প্রজার জীবন ও শ্রমের উপর ছিল জমিদারের সীমাহীন অধিকার। নানকার আন্দোলনের সংগঠক কমরেড অজয় ভট্টাচার্যের দেয়া তথ্য মতে, সে সময় বৃহত্তর সিলেটের ৩০ লাখ জনসংখ্যার ১০ ভাগ ছিল নানকার এবং নানকার প্রথা মূলত: বাংলাদেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলে অর্থাৎ বৃহত্তর সিলেটে চালু ছিল।১৯২২ সাল থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত কমিউনিস্ট পার্টি ও কৃষক সমিতির সহযোগিতায় বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ, বড়লেখা, কুলাউড়া, বালাগঞ্জ ও ধর্মপাশা থানায় নানকার আন্দোলন গড়ে উঠে। ঐতিহাসিক নানকার বিদ্রোহের সূতিকাগার ছিল বিয়ানীবাজার থানা। সামন্তবাদী শোষণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিয়ানীবাজার অঞ্চলের নানকার ও কৃষকরা সর্বপ্রথম বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাই অধিকার আদায়ের চেতনাদীপ্ত প্রতীক হিসেবে প্রতি বছর ১৮ আগস্ট বিয়ানীবাজারে নানকার দিবস পালন হয়। দু:খজনক হলেও সত্য যাদের আত্মত্যাগ আর প্রাণের বিনিময়ে ঘৃণ্য এই প্রথা বিলুপ্ত হয়েছে, তাদের সকলেই ছিলেন নিম্নবর্ণের এবং নির্যাতিত শ্রেণীর।

ফলে প্রথমদিকে তাদের স্মৃতি সংরেক্ষণ করা হলেও পরবর্তীতে সেইসব প্রাণত্যাগী পরিবারের সদস্যরা সেই স্মৃতিটুকু পর্যন্ত ফেলে দেন নদীতে। ক্ষোভ প্রকাশ করে স্থানীয় একজন রাজনৈতিক নেতা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, ‘যারা এই প্রথার বিরুদ্ধে প্রাণ দিয়েছিল, তাদের উত্তরাধীকারীরা এখন দেশে-বিদেশে সু-প্রতিষ্ঠিত। ফলে প্রতিষ্ঠিত উত্তরাধিকারীরা চায়নি, তাদের পূর্বসূরীরা জমিদারের দেয়া বাড়িতে কাজ করতেন বিনা পারিশ্রমিকে এবং এরই প্রতিবাদে তাদের প্রাণ দিতে হয়েছিল।’ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) সিলেট জেলা সভাপতি লোকমান আহমদ বলেন, সেদিনের সেই নানকার আন্দোলনের ফসল আজকের সমাজ ব্যবস্থা।ব্রিটিশদের ঘৃণ্য এই প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কিছু মানুষের রক্তের সিঁড়ি বেয়ে করা হয় প্রজাস্বত্ব আইন। এরই ধারাবাহিকতায় আজকের উন্নয়ন সমাজ ব্যবস্থা। দু:খ প্রকাশ করে এই প্রবীণ রাজনীতিবিদ বলেন, আজকে তাদের নিয়ে যদি বেশি করে চর্চা ও আলোচনার সুযোগ সৃষ্টি করা হতো, তাহলে শোষণ-বৈষম্যের বিপরীতে কাঙ্খিত মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ খুব সহজেই বিনির্মাণ সম্ভব হতো।৭৩তম নানকার কৃষক বিদ্রোহ দিবস উপলক্ষে বিয়ানীবাজার সাংস্কৃতিক কমান্ড, উলুউরি উন্নয়নমুখী যুব সংঘ ও সানেশ্বর নানকার স্মৃতি সংসদের উদ্যোগে নানকার স্মৃতিসৌধে পুস্পার্ঘ অর্পণ ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে।

You might also like