পরিবানু

‘পরিবানু’ উপন্যাস। লিখেছেন হামিদ মোহাম্মদ। সাম্প্রতিক লেখা গ্রন্থখানা বাংলাদেশের সমাজপ্রেক্ষিত, অপ্রাকৃতিক শক্তি, জাদুটোনায় বিশ্বাস ও শঠতায় আচ্ছন্ন সমাজচিত্র এবং দাম্ভিকতার জাল ছিন্ন করার নারীর লড়াই। চলচ্চিত্রশিল্পী সাহসিকা ‘পরিমনি’র জীবনের আংশিক উপাদান রয়েছে কাহিনির নানা পর্বে। উপন্যাসটি ধারাবাহিক প্রকাশ করছে ‘সত্যবাণী’। আমাদের ভরসা পাঠকদের ভাল লাগবে।  –সম্পাদক, সত্যবাণী

 হামিদ মোহাম্মদ

 ॥এক॥ 

কারাগার থেকে বেরিয়ে আমি হতবাক। অগণিত মানুষ কারাগারের বাইরে, এরা আমার ভক্ত। সকলেই আমার অপেক্ষায়, কখন আমি বেরুবো, লোকজন উকিঁঝুঁকি দিচ্ছে। একটা সাদা গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছেন আমার স্বজন, মানে আমার নানা  সোলেমান গাজি। সঙ্গে আরো  কে কে জানি। আমি বেরিয়ে এতো মানুষ দেখে ভড়কে না-গিয়ে হেসে ওঠি। হাসি আমার স্বভাব সিদ্ধ। দাঁত  খেলিয়ে অনেকটা অট্টহাসির মত রাঙিয়ে দাঁড়াই গাড়ির ভেতর। হোড খুলে মাথা বের করি উপর দিকে। এক অভাবনীয় দৃশ্য। কেউ হাত বাড়াচ্ছে আমাকে ছুঁতে, কেউ উড়ন্ত চুম্বন দিচ্ছে। প্রচ- ভীড়, ঠেলাঠেলিও কম নয়।

আমি হাত তুলে অভিবাদন জানাতে থাকি। হাতে মেহেদী দিয়ে লিখেছিলাম, ‘ডোন্ট লাভ মি, ফাকাপ’ ইংরেজিতে লাভচিহ্নের মাঝখানে তর্জনী তোলা। সকালেই ক্যান্টিনে গিয়ে পাই মেহেদীর প্যাকেট। মহিলা কারাগারের ক্যান্টিনে চকলেটসহ নানা জাতের প্রসাধনীর কৌটা আর মেহেদীর ওয়ানটাইম প্যাকেট। চটজলদি এক প্যাকেট মেহেদী কিনে রুমে যাই। তৎক্ষণাৎ লিখে ফেলি লাইনটি। মাথায় কিভাবে যেন এলো এই দুষ্টু বুদ্ধিটা। মনে হল আমার শত্রুদের বেলায় প্রযোজ্য হবে মোক্ষম এই অস্ত্রটি। কাজও দিলো। সাংবাদিকরা ঘিরে ধরল। অসংখ্য প্রশ্নের উত্তরও দিলাম। আধ ঘণ্টার মত গেল আমাকে বহন করা গাড়ি কারাগারের বিশাল গেইট ও তার অভিমুখী রাস্তা অতিক্রম করতে। তারপর বড় রাস্তা।

কারাগারের বড় ফটকের পর নিজস্ব রাস্তা অতিক্রম করার সাথে সাথে বড় রাস্তায় ড্রাইভার গাড়ির গতি বাড়িয়ে দেয়। দুঘন্টা সময় গেল বানানীর ফ্লাটে পৌঁছতে। সিটে বসে পড়লাম। আমার প্রিয়জন, মানে নানা আমার পাশে বসা, আমার একমাত্র বন্ধু। অনেক কিছু জিজ্ঞেস করলেন। আমি কেমন আছি, এখন কেমন লাগছে ইত্যাদি। বললেন ভয় নেইরে রেণু, আমি আছি, তোর জানের টুকরা আমি সোলেমান গাজি। দেখিস না এই আমি তোর পাশে।

আমি ছোটবেলা নানার কোলেপিঠে মানুষ হয়েছি। তিনি আমার নাম রেখেছিলেন ‘রেণু’। জেলগেটে বেইলের কাগজ জমা দিয়ে বলেছিলেন, আমার রেণুকে  নিতে এসেছি। জেলের লোক অর্থাৎ ডিউটি অফিসার মহিলাটি  নানার মুখের দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে  বলেছিলেন, রেণু আবার কে? নানা হেসে বলেছিলেন, ও, আমি ওকে ‘রেণু’ ডাকি, সে এখন পরীবানু, নামটা না আমি রেখেছিলাম। তাই বলে ফেলেছিলাম। পরীবানুকে নিতে এসেছি। এ নামে সকলে চিনে তাকে, নামটা তার, সে নিজে বদলেছে। একটু থেমে বলেছিলেন, সে তো বদলে যেতে চায়। জীবন বদলাতে চায়। বদলেছেও।

আমার ফোন, ল্যাপটপ জব্দ করে নিয়েছে র‌্যাব। যার জন্য বাইরের দুনিয়া থেকে আমি বিচ্ছিন্ন। ফেইসবুক, পত্রিকা, অনলাইন মিডিয়া জগতে কি ঘটছে, তার কিছুই আমি জানি না।

ঘরে এসে জিনিসপত্তর এলোমেলো করা  পরিবেশে আমি দম বদ্ধ হব এমন অবস্থা। নানা এসবে হাত দেননি, বিজ্ঞলোক তিনি মনে করছেন, হয়ত এলোমেলো দৃশ্যটা কোন কাজে আসতে পারে, এই মনে করে যে অবস্থায় আমি গ্রেফতার হই, নানা সেই অবস্থায় রেখেছেন পুরো ফ্লাট। সব তচনচ, চোর বা ডাকাত যা করে, তাই অবস্থা। আমি তো মনে  করেছিলাম ডাকাত পড়ছে আমার ফ্লাটে। এই রকম চিন্তা থেকে  আমি মোবাইলে লাইভও করেছি,পুলিশকে ৯৯৯ নাম্বারে খোঁজও করেছি। আমার বাসায় ডাকাত পড়েছে, সেটাও বলেছি। কিন্তু কই? কোন সাড়া নেই। শেষ ফল দাঁড়ায়Ñর‌্যাব বাসার গেইট, দরজার লক ভেঙে ফ্লাটে ঢুকে। দু’ঘন্টার অভিযান। কী আশ্চর্য, আমি হতবাক হয়ে কেঁদে ফেলতে গিয়ে কাঁদি না, ঘাড় শক্ত করেই কথা বলি। কী জন্য এই অভিযান? এই প্রশ্নের সদোত্তর নেই।

এক সময় মনে হয়েছিল এসব আমি স্বপ্নে দেখছি কিনা। আসলে স্বপ্ন নয়, বাস্তব ঘটনা ঘটছে। এক সময় আনন্দও পাই। মানুষ এরকম ঘটনা স্বপ্নে দেখে, আমি বাস্তবে দেখছি, আমি ভাগ্যবান। আমি অভিনেত্রী, সিনেমায় অভিনয় করি। আজকের ঘটনায় অভিনয় করতে আমার কষ্ঠ হচ্ছে না। আমি অভ্যস্তই আছি।

নানা সোলেমান গাজি হতভম্ব। কী যে ঘটছে, তিনি বুঝতেই পারেননি। আমার জীবনে প্রিয় নানা সোলেমান গাজি এখন একমাত্র ভরসা, যাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে পারি বা আমাকে বাঁচাও বলতে পারি, চিৎকার দিতে পারি। কিন্তু না আমি এমন ভড়কে যাওয়ার মত মেয়ে নই। নানাও বললেন, দেখি, কী ঘটছে, অপেক্ষা করা ছাড়া বুঝা যাচ্ছে না, সামনে কী ঘটছে বা ঘটবে। বুঝতে দাও। নানার হন্তদন্ত চেহারা দেখবো মনে করেছিলাম, কিন্তু অত্যন্ত দৃঢ়চিত্ত নানা সোলেমান গাজির চেহারা আমাকে আরো মনোবল বাড়িয়ে দেয়, শক্তি পাই। সাদা পোষাকের একদল লোক দরজা ভেঙে প্রবেশ করে ফ্লাটে। বাঁধ ভাঙলে যেভাবে জল ঢুকে হুড়মুড় করে, সেভাবে ঝমাৎ করে লোকগুলো ঢুকে। ঢুকেই ছিতরে যায়, এদিক ওদিক। কী উদ্দেশ্য, কী খুঁজছে, কী তাদের মতলব।

ফ্লাটে পৌঁছে দেখি বাড়ির গলিতে, নীচতলায়, সিঁড়িতে বসে আছে ক্যামেরা নিয়ে মিডিয়ার অনেক লোকজন। কেউ রাত থেকেই নাকি আছে এখানে। আমি ছাড়া পাচ্ছি, এই সংবাদে তাদের এমন উপস্থিতি। আমি বেইল পেয়েছি, মুহূর্তে এ সংবাদটি ছড়িয়ে পড়ে ঢাকার মত শহরে শুধু নয়, ডিজিটাল যুগের এই দিনে মুহূর্তে দেশের গ্রামে-গঞ্জে এমনকি বিশ্বময়। গতকাল যখন বেইল হয় তখন লোকে দেখেছে, অনেকে লাইভ প্রচার করছে আদালত প্রাঙ্গন থেকে। লাখখানেক লোক অস্থির হয়ে ওঠেছে আমাকে এক নজর দেখতে বা এমন কিছু জানতে যা অধীর আগ্রহকে আরো উচকে দেয়।

বাড়ি বা ফ্লাটের ধারে কাছে অপেক্ষারত মিডিয়াকর্মীর খাওয়া-দাওয়া ঘুম হারাম করার পেছনে একমাত্র কাজ, আমার সামান্য বক্তব্য তাদের দরকার। নিদেনপক্ষে, আমার একটা ছবি তোলা তাদের দায়িত্ব। আমি বিষ্মিত হই না, বরং আনন্দ পাই। মিডিয়াকর্মীরাই আমার প্রকৃত বন্ধু, তবে কিছু দালাল মিডিয়াকর্মী যে নেই, এমন নয়। এই দালাল মিডিয়াকর্মীরা আমার বিরুদ্ধে রংচং লাগিয়ে ফুলিয়ে ফাফিয়ে নানা কথা লিখেছেও। তাদের অপপ্রচার নিয়ে আমি তেমন ভাবি না। পরের কথায় এরা চলে, খায়-দায় ঘুমায়। এদের নিয়ে আমার অত মাথা বিষও নেই। আমি অভিনেত্রী, অভিনয় শিল্পী আমি, অভিনয় জগতে আমার বাস, শত্রুমিত্র থাকবেই, এটা শুধু স্বাভাবিক নয়, থাকতেই পারে, না থাকাটাই অস্বাভাবিক।

দুএকজন ছবি তুললো, অনেকে পারলো না। হাত তুলে তাদের অভিবাদন জানিয়ে ফ্লাটে ঢুকলাম। হাতমুখ ধুইয়ে যাকে প্রথম পেলাম সে হল আমার পাশের ফ্লাটের মহিলা সুরাইয়া  চৌধুরী। তিনি কী যে উত্তেজনা নিয়ে ঘরে ঢুকলেন, অনেকটা চিলের মত হামলে পড়লেন আমার ওপর, ছোঁ মেরে জড়িয়ে ধরলেন আমাকে। আমিও জড়িয়ে ধরলাম মধ্য বয়সী এই মহিলাকে। তার ওপর আমি খসে পড়লাম যেন, আকাশ থেকে তারা খসার মত। ওর জন্য আমি তারা-ই। সেই সঙ্গে চিৎকার বেরিয়ে আসে মুখ থেকে ‘খালাম্মা’। আমি জেলে থাকাকালিন তিনিই আমার নানাকে দেখাশোনা করেছেন, ভাত খাইয়েছেন। খোঁজখবর নিয়েছেন তার শরীরের। বৃদ্ধ মানুষ কোন সময় কী হয়ে যায় কি না। এই  খালাম্মাকে আমি আম্মা ডাকি। তিনিও বাচবিচার না করেই মন থেকে সন্তান মনে করেন। পরিচয় হওয়ার পর থেকেই আমি তার প্রাণভোমরা। আদর সোহাগে ভরিয়ে রাখেন আমাকে। তিনি টিভি নাটক, সিনেমার পরিচালনা করেন। আমি তার শেষ সিনেমা ‘কমলা সুন্দরী’তে প্রধান কমলা সুন্দরী চরিত্রে অভিনয় করেছি। এখনও মুক্তি পায়নি।

তিনি মোবাইল ফোনে দেখালেন ভিডিও, একটু আগে আমি জেল থেকে বেরুচ্ছি, লোকজনদেরকে অভিবাদন জানাচ্ছি। হাত উঁচিয়ে তোলা হাস্যোজ্জ্বল আমি। নীচে কিছু ছবিও। একজন মুদির দোকানি ধন্য মনে করছে আমার হাত ছূঁতে পেরে। ইন্টারভিউ দিচ্ছে, তার আবেগঘন বক্তব্য, পরিতৃপ্ত মুখ, আমাকে মুগ্ধ করে। খালাম্মাকে বললাম, এদের ভালবাসার জন্য তো মুক্তি পেয়েছি খালাম্মা, আমি বেঁেচ আছি। তিনি দেখালেন, গত এক মাসে কত লোক,কত লেখক সাংবাদিক, এক্টিভিস্ট, সমাজকর্মী সাংস্কৃতিকজন বিবৃতি, লেখালেখি, মানব বন্ধন করেছেন আমার নি:শর্ত মুক্তি চেয়ে। প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে পত্রিকায় কলাম লিখেছেন বিলেতবাসী লেখকরাও। আমার ভাগ্য ভাল, তাই মুক্তি পেয়েছি। মানুষের ভালাবাসা আমাকে মুক্ত করে এনেছে। আমার জীবনটাই চ্যালেঞ্জিং। যাদের সাথে আমি চ্যালেঞ্জ নিয়েছি, তারা যে কত শক্তিশালি, তা আমি জানি, এমন নয় যে, আমি জানি না। কিন্তু আমার অস্তিত্বের প্রশ্নে আমি আপস করিনি। চ্যালেঞ্জ নিয়েছি। চ্যালেঞ্জটাই জাদু। যে জাদু আমাকে নিয়ে এসেছে সিনেমায়, শেষ পর্যন্ত  ‘জেল জয়’। জয়-ই করেছি। ইংরেজী ‘ভি’ অক্ষরের চিহ্ন দেখিয়েছি। (চলবে)

You might also like