পরিবানু

‘পরিবানু’ উপন্যাস। লিখেছেন হামিদ মোহাম্মদ। সাম্প্রতিক লেখা গ্রন্থখানা বাংলাদেশের সমাজপ্রেক্ষিত, অপ্রাকৃতিক শক্তি, জাদুটোনায় বিশ্বাস ও শঠতায় আচ্ছন্ন সমাজচিত্র এবং দাম্ভিকতার জাল ছিন্ন করার নারীর লড়াই। চলচ্চিত্রশিল্পী সাহসিকা ‘পরিমনি’র জীবনের আংশিক উপাদান রয়েছে কাহিনির নানা পর্বে। উপন্যাসটি ধারাবাহিক প্রকাশ করছে ‘সত্যবাণী’। আমাদের ভরসা পাঠকদের ভাল লাগবে।  –সম্পাদক, সত্যবাণী

 হামিদ মোহাম্মদ

॥ দুই॥

কারাগরের শেষ রাত আজ। রাতে ঘুম এলো না। ল্যাত ল্যাতে বালিশটি একবার মাথার তলে একবার বুকের তলে চেপে উপুড় হয়ে কখনো ঝিমুচ্ছিলাম, কখনো হাসফাঁস করছিলাম গরমে। বাংলাদেশের এ আবহাওয়া বিশ্বের অন্য কোন অঞ্চলের মানুষ বুঝবে না, যদি-না বাংলাদেশের আবহাওয়া সম্পর্কে কোন ধারণা না-থাকে। কারাগারের এসেই ফ্যান বা বৈদ্যুতিক পাখাহীন রুম বরাদ্ধ পাই। দুদিন পর একটি তিনডালের স্ট্যান্ড-পাখা আমার রুমে স্থানান্তরিত করা হয়। হয়ত কোন ভক্তকূলের আবদারে বা জেলওয়াডের্নের দয়ায়। গরমে আমি উহ আহও করছিলাম গত দুদিন। আমি দ্বিতীয় দিন সকালের নাস্তায় চেয়ে বসি ‘বার্গার খাবো’। সার্ভিসের মহিলা হেসে বললো, আফা জেলে বার্গার নেই, আপনাকে গরম রুটি দিছি, এখানে গরম রুটি পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। ডাইলটাও গরম আছে। খেয়ে দেখুন, মজা পাবেন।

আমার ধারণাই ছিল না যে কারাগারের মানুষ বার্গার খেতে পায় না। মন খারাপ হলেও আশ্বস্ত হই এই ভেবে ‘সকলের যা, আমারও তা’। যাহোক, জেলে যে কয়দিন ছিলামÑঅতি অল্প দিনে স্টাফ, অন্য বন্দীসহ সকলের প্রিয় পরী আপা আমি। বুঝতেই পারিনি, জেলের কষ্ট কী জিনিস, কী দশা এখানে। বাঁচার জন্য যুদ্ধ কেমন, শুধু এইটুকু উপলদ্ধি, সামান্য আঁচ করা ছাড়া  জীবনের স্বাদহীন মুহূর্তগুলো আমাকে স্পর্শ করেনি। আমি ছিলাম সকলের প্রিয় পরী আফা। আমাকে ঘিরে, আমাকে দেখা, কথা শোনা, গল্প শোনা, আমার পোশাক-পরিচ্ছদ সবই ছিল এখানের মানুষের কৌতুহলের বিষয়।

আমি যদি জেলে না-আসতাম, তবে কোন দিন হয়ত কোন ধারণাই হতো না জেল কি জিনিস। আবছা ধারণা, আর বাস্তব অভিজ্ঞতা আকাশ-পাতাল তফাৎ। হয়ত সিনেমার কোন দৃশ্য অভিনয়ে আসতাম বা কোন দৃশ্যের জন্য অনুরূপ কোন ডামি জেল বানানো হত, সেখানে আমার আনকোরা অভিনয় ক্যামেরাবন্দী হওয়া নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতাম। জেল সম্পর্কে বাস্তব ধারণা বা জ্ঞান লাভ করা অথবা অভিজ্ঞতা অর্জন ছিল কল্পনাতীত। পরে জেনেছি, আমি ট্যাক্স পেয়ী এবং জাতীয় পর্যায়ে নামকরা অভিনেত্রীর জন্য কিছু ভাল রুম বরাদ্ধ পাই। কিন্তু যাদের কোন পরিচয় নেই,চোর বা ডাকাত কিংবা খুনের আসামী অথবা সন্দেহজনক কোন অপরাধে জেলবাস করছেন, তাদের অবস্থা না-ফ্যান, না রুম আছে। দেখেছি, লম্বা এক রুমে শ-খানেক কয়েদী কাত হয়ে শুয়ে থাকার একটি কম্বল-বালিশ নামধারি বোচকাই সম্বল। এরকম বহু সংখ্যক লম্বা রুম, কত বিশাল এ কারাগার। কত হাজার মানুষ থাকে, সেটা সরকারও কতটা জানে। লাইন ধরিয়ে মাথায় গল্লা দিয়ে বাড়ি দিয়ে ওয়ার্ডেন সকাল বিকাল গুণে খাতা মেলায়। খাবার দেয়া হয় লঙ্গরখানা টাইপের। কল্পনা করতেই গা ছম-ছম রি-রি করে ওঠে। বর্ণনাতীত দু:সহ পরিবেশ, ভাবতেই চিৎকার দিয়ে কাঁদতে ইচ্ছা হয়। গোঙানির মত একটু শব্দ বেরিয়েও আসে মাগো’।

এক সময় ঘুম আসে নেতিয়ে পড়া শরীরে। ছোট্ট একটি মাত্র জানালা, এক পাটি স্টিলের দরজার সাইজও আমার মাপ থেকে বেশি বড় নয়। ছোট জানালা আর দরজার যা অবস্থাÑবাতাস চলাচল কই আর? গুমোট অবস্থা। তবে, গরমে সিদ্ধ আলু হয়ে যাওয়ার পর একবার ঘুম চোখে নামবেই। আমারও নামলো।

ঘুম থেকে যখন উঠলাম তখন সকাল ৬টা। ওয়ার্ডেন একটু পরেই দরজায় টাস করে হাতের লাঠি দিয়ে বাড়ি দেবে। আমি এর আগেই উঠে গেছি, ঘুম ভেঙ্গে গেছে। মূলত অভ্যাস হয়ে গেছে কদিনে। ভোর হলেই মানুষের কিচিরমিচির শুরু হয়। পাখির ডাকের সাথে মানুষের হৈ-চৈ একাকার। এতে আর কেউ ঘুমুতে যাবে কই?

জেলের ভেতরও কাজ। এমন নয় যে, শুধু খাওয়া-দাওয়া আর দিনগোনা। কতদিনে শেষ হবে দুই তিন বা দশ কিংবা বিশ বছর তাও নয় অনেকের জীবনে অবধারিত।

এদের মধ্যে দীর্ঘ মেয়াদী আসামী কেউ হস্তশিল্পের কাজ করে, কেউ বাগান করে, ফুলের বা সবজির। কোদাল খন্তাই প্রধান সরঞ্জাম। আবার রান্নাবান্নার কাজেও কেউ কেউ বাগিয়ে নিয়েছে। জেলের ভেতরে কাজ জেলের মানুষরাই করে। এতে সামান্য হাত খরচাও পায়। আলাদা এক জগত, ভীষণ ঝুমঝামের, হুলস্থুলের দিন এগুলো। কখন সূর্য উঠে, কখন ডুবে অনেক সময় মাথায়-ই আসে না। কেউ আঙ্গুলে দিন গুনে, কেউ গুনেই না।

অন্যদিনের মত আমিও আজ এ সব তুলকালাম কর্মযজ্ঞে ডুবে যাওয়ার কথা। তা-ই হয়েছে। ঘুমও ভেঙ্গেছে সেই নিয়মে। কিন্তু আমি অবাক হয়ে বুঝতে চেষ্টা করলাম, কোন সত্য ঘটনা কিনা, না স্বপ্নে দেখা কোন কাহিনি ঘুমের মধ্যে ভিড় করেছিল, নানা ডালপালা মেলে আমাকে নিয়ে গিয়েছিল কোথাও।

 দেখেছি আমি হাঁটছি, ছুটে চলছি নগর থেকে নগরে। এ কি! ও মা! এ যে আমার অবিকল চেহারার মানুষ এক ভাষ্কর্য’! প্রতিটি নগরের মধ্যখানে, কোন কোনটি নগরের প্রবেশ তোরণের পাশে। কোন এক কালে নাকি এদেশের প্রিয় কেউ ছিল আমার আদলে, প্রথাগত সমাজের বিপরীতে ছিল তার যাত্রা। সে নাকি সোফিয়া লোরেনের মত সহস্র বদনাম ঘাড়ে নিয়ে ঘাড় খাড়া করেই হাঁটতো, নাচতো, অভিনয় করতো, মানুষকে আনন্দ দিতো। অথবা এক সময় মনে হয় না এ  কে?  কখনও মনে হয় এ তো আমি-ই! বিষ্ময় জাগানিয়া এক অপার অনুভুতি আমার গা শির শির করে বেয়ে ওঠে পা থেকে মাথা অবধি।

এই ‘ভাষ্কর্য’ রূপ দেয়া মেয়েটি কী ছিল! আশ্বর্য কোন দেবদূত কি না,  দেবীরূপী কেউ? যে কিনা কাজে অকাজে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতো। সেই বদমাস মেয়েটি, সেই বেপরোয়া মেয়েটি, সেই ঘাড় তেড়া মেয়েটি এখন সমাজে নন্দিত, স্পর্ধিত। স্থান পেয়েছে তরুণদের মগজে, মনে, মননে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ বিশেষ স্থানে রয়েছে সোফিয়া লোরেনের মূর্তি বা ভাষ্কর্য। এখন এই বাংলাদেশে দেখতে আমার মত, না আমি, না অন্য কেউ–বন্দিত। ৬৪টি শহরের প্রধান মোড়ে দশ ফুট উঁচু স্তম্ভে আমি ঘাড় খাড়া করে আছি। উর্ধে তোলা ‘ডোণ্ট লাভ মি,ফাকাপ’। বিষ্ময়ে আমি তাকিয়ে দেখছি, আমাকে মেলাতে মেলাতে ঘুম ভেঙ্গে গেল।

ঘুম থেকে উঠে স্বপ্নদেখা ভাষ্কর্যময় দেশ চোখ থেকে সরে না। আমি উৎফুল্ল হই, নিজেকে জড়িয়ে ধরি নিজে। আসলে জড়িয়ে নয়, কিড়িমিড়ি খাই, হাত উপরে ছুঁড়ি, ঘাড় মুরাই, কটকট শব্দ উঠে। কী যে ভীষণ পরি আমি।

পেছনের কথাও এক সময় হুড়মুড় করে মগজে। আমার পুত্র  ‘উজ্জ্বলহোস্টেলে। সে হয়তো এতো কিছু জানে না, অথবা জানে। নানাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তাকে হোস্টেলে গিয়ে দেখেছেন কিনা। তিনি হেসেছেন। সাত বছরের সন্তান, সে আবার এ সম্পর্কে তেমন জানে না। তাকে জানাইনি আমার জীবনের গতি প্রকৃতি। আমার সিনেমার জগতের মানুষও জানে না। নানা ছাড়া কেউ জানে না আমার সন্তান আছে। তা-ও সাত বছরের। আমি গোপন রাখছি আমার এ জীবনের চড়াই-উৎরাই পথে তার কোন অংশগ্রহণ নেই। সিনেমা জগতে অনেকেই বিয়ে করলেও গোপন রাখে। চুটিয়ে প্রেম করে, বলে বেড়ায় মিথ্যা এসব। একটার পর একটা বয়ফ্রেন্ড, তাও মিথ্যা বলেই চালিয়ে দেয়। বলে বেড়ায় অবিবাহিত বা বয়ফ্রেন্ড-টয়ফ্রেন্ড নেই,  ¯স্রেফ বন্ধু। এতে নাকি গ্লামার বাড়ে, ভক্ত ধরে রাখা যায়। আমিও আমার পুত্র আছে বা আমি পুত্র সন্তানের জননী, তা গোপন রেখেছি। বুক ফেটে, বুকের ভেতর শ্বাসনালী ঠেলে ঢোক গেলার মত একটি শব্দ আসে। শব্দটি কুক করে ওঠে। আমি রেণু, আমি পরী। স্কুলত্যাগী সদ্য বিবাহিত রেণু, স্বামী পরিত্যাগী রেণু বমির মত ঠেলে আসে এক্কেবারে গলায়। কিন্তু আমি আসলেই তো বমি করে দিয়েছি গত জীবন। হিসহিসানি জীবন, রান্নার ধোঁয়ামাখা মুখ, এসব হারিয়ে ফেলেছি। ঘেমে ওঠা ল্যাত-ল্যাতে জীবন ছুঁড়ে দিয়েছি। যা নিয়ে আমি আর ভাবি না।

সেই মা, যে নাকি কোন দু:খে কাপড়ে আগুন দিল বা আগুন লাগল কাপড়ে, নেভাতে নেভাতে পুরো শরীর জলসে গেল। কাতরাতে কাতরাতে শেষে হাসপাতালের মর্গে। আর বাবা দেশ থেকে দেশে, গ্রাম থেকে গ্রামে, শেষ পর্যন্ত ‘ভাসানপানি’ আন্দোলনের কর্মী, নেতা। এক সময় ডাকাতের না ‘হাওর পাহারাদারের’ গুলিতে নলুয়ার হাওরে তলিয়ে গেল। আহারে কেমন রক্ত ঝরে মারা গেল বাবা। মুখ কি নিচের দিকে দিয়ে পড়েছিল। সঙ্গের লোকজন পালালো। মানুষ বিপদে পড়ে নাকি পালায়? পালায় নাকি?

আমার বাবা আমাকে চমকে দিয়েছিল। উপহার দিয়েছিল আমার ষোলতম জন্মদিনে একটি প্যাকেট। প্যাকেট খুলে তো আমি অবাক। দেখেছিলাম প্যাকেটটি খুলে আমার এক অভাবনীয় চিত্রকর্ম। চিত্রকর্মটি আমার ছোটবেলার আঁকা। কী ছিল। হ্যা, বাবা আমাকে নতুন রঙিন পেন্সিল কিনে দিয়েছিল। রঙিন পেন্সিল পেয়ে আমি সারা রাত এঁকে ছিলাম, ছবি নয়, লিখেছিলাম ‘বাবা’ ‘বাবা’ ‘বাবা’. . . কত লক্ষবার! খাতায়! না, বাবার সদ্য কেনা শার্টে। আমার জন্মদিনের পোশাকের সাথে তিনিও একটি শার্ট কিনে এনেছিলেন। সেই সাদা ধবধবে শার্টে যত বাবা লক্ষ বাবা লিখেছিলাম। লিখতে লিখতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সকালে বাবা আমার চিত্রকর্ম দেখে কিছুই বলেননি। আমি ভুলে গিয়েছি। বাবা নতুন প্যাকেটে আবার শার্টটি পুরে যত্ন করে রেখে দিয়েছিলেন আলমারিতে। আমার বয়স যখন ষোল হল,তখন এই শার্ট, না শার্ট নয়, শার্টের প্যাকেট বাবা বের করে আমাকে খুলতে দেন। আমি খুলে কী যে অবাক!  বাবা বাবা. . .। আমি কেঁদে ফেলেছিলাম তখন। লজ্জায়, না আনন্দে! কোনটাই নয়। চোখ বেয়ে জল পড়ছিল, গরম জল। এতো বাজে কাজ করার পরও বাবা রাগ করেননি, মজা পেয়েছিলেন। মজা করে শার্টটি প্যাকেট করেষোল বছর রাখা কি চাট্টিখানি কথা! ষোল হয়েছি, বোঝার ক্ষমতা হয়েছে। এ সময়ে এই উপহারটি হাতে দিলে, চমকে দিলেন।

আজও আবার আমার চোখে জল গড়িয়ে পড়ছে। বাবা মা। পৃথিবী! নিজের যুদ্ধ। বাবা মার যুদ্ধ, লড়াই। বাবা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, সেই যুদ্ধ কেমন ছিল? শুনেছি–কাতারে কাতারে কত মানুষ মরেছে যত। বেঁচেছেও। সব কিছু কি– জাদু আসলে!

(চলবে)

You might also like