পরিবানু
‘পরিবানু’ উপন্যাস। লিখেছেন হামিদ মোহাম্মদ। সাম্প্রতিক লেখা গ্রন্থখানা বাংলাদেশের সমাজপ্রেক্ষিত, অপ্রাকৃতিক শক্তি, জাদুটোনায় বিশ্বাস ও শঠতায় আচ্ছন্ন সমাজচিত্র এবং দাম্ভিকতার জাল ছিন্ন করার নারীর লড়াই। চলচ্চিত্রশিল্পী সাহসিকা ‘পরিমনি’র জীবনের আংশিক উপাদান রয়েছে কাহিনির নানা পর্বে। উপন্যাসটি ধারাবাহিক প্রকাশ করছে ‘সত্যবাণী’। আমাদের ভরসা পাঠকদের ভাল লাগবে। –সম্পাদক, সত্যবাণী।
হামিদ মোহাম্মদ
॥৪॥
পিতা-মাতার সংসারের ছায়া আমার নিজের সংসারে। অগোচরে ঘটে অনেক কিছু। সবাই মনে করেন নানা ঘটনার মূল বা জড় পিতা আলম চৌধুরীর চলাফেরা। আলম চৌধুরী হলেন সেই ব্যতিক্রমী ব্যক্তি, যার জুড়ি নেই এই তল্লাটে। যিনি ছিলেন এক মজলুম জমিদার এবং একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধাও। গোঁফের মাপও জেনারেল ওসমানির কাছাকাছি। দেখতে সিংহের মত। আচারে-ব্যবহারেও দাপট কম নয়। বিচিত্র চরিত্রের লোক।শুনেছি–সেই আলম চৌধুরী যেখানে যান, সেখানে গলে যান কোন নারীর পানরাঙা ঠোঁটের হাসির ঝিলিকে, বাকা চোখের ইশারায়। মাসে কমপক্ষে পাঁচ বা দশদিন কাটে নানা গ্রামে আথিয়েতায়, মেহমানদারিতে। নতুন নতুন এক জগতে বিভোর থাকেন আলম চৌধুরী। কোন এলাকার কোন গ্রামে কার বাড়িতে কখন উঠবেন কে জানে না। হাতে থাকবে বড় মাছ একটি, পাশের যে কোন বাজার থেকে মাত্র কিনে আনা। হাঁটবার ছাড়া মাছ মেলার কথা নয়। বুঝতে হবে রসুলগঞ্জ, দোলারবাজার কিংবা বৈরাগীবাজার বা গোবিন্দগঞ্জ থেকেও কেনা হতে পারে বড় রুই মাছ বা বোয়াল বা আইড় মাছটি। যেদিন যে এলাকার হাটবার, সেদিন সে এলাকার কোন এক গ্রামে উঠবেনই, বড় মাছ হাতে আলম চৌধুরী। মাইমলরাও চৌধুরীসাবকে দেখলেই তিনশ টাকার মাছ হাঁকবে পাঁচশ টাকা। এরপরও গুণে টাকা দেন না। হাতে যা উঠে তা দেবেন। দরকার পড়লে অতি উৎসাহী কোন মাইমল মাছ বহন করার জন্য লোকও দিয়ে থাকে। মজুরী হাতে যা উঠে, সব নোট চোখবুজে একইভাবে হাতে দিয়ে দেন। পোকার মত চৌধুরীর লগে অমুক তমুক তাই লেগে থাকেন, বেকামা কোন মানুষ হলে তো কথাই নেই। সেই হাট থেকে কেনা মাছ নিয়ে উঠবেন চৌধুরী কোন গ্রামে কার বাড়ি, সে হদিস কারো জানা নেই। যার বাড়িতে উঠবেনই, সেই বাড়িতে চলবে রান্না-বান্না এবং জমজমাট আড্ডা। তবে নির্দেশ মত রান্না করার পর সবগুলো তরকারি সামনে এনে হাজির করতে হবে। পুরো মাছটিতে কত টুকরা হবে, তাও জানা। গুনেগুনে দেখবেন। আলম চৌধুরীর খাওয়ার পর খাবেন সকলেই। সেই সঙ্গে–জমবে গপ, গপে কাটবে রাত–চাঁদনি বা ঝড়ো বৃষ্টির হউক। খামিরা তামাকের সুগন্ধে মৌ মৌ করা ধুনলাগা পরিবেশ, অপার্থিব এক জগত, তখন কিভাবে যেন রক্তে-মাংশে মিশে একাকার। এই অবস্থায় আমাদের বাবা আলম চৌধুরী সকলের ‘চৌধুরীসাব’। আবেশে গলে যান একের পর এক রমণী সুধায়। বিয়ে করেন ক্রমন্বয়ে দুইবোনকে। একজনকে ছেড়ে ধরেন আরেকজন। কোন কোন জায়গায় রমণী সংক্রান্ত বিষয়ে ছোটখাটো কাড়াকাড়িও হয়েছে–আলম চৌধুরী সম্পর্কে এমন গল্পও চালু আছে। আরও কত গল্প আছে চৌধুরীসাবকে ঘিরে। গ্রাম থেকে গ্রামে ছড়িয়ে আছে নানান রসাত্মক কিসসা-কাহিনি।
পিতা সম্পর্কে এই সব কাহিনি আমি রেণুর মুখস্ত। নিজের দেখা এবং মানুষের নিকট থেকে শোনা কাহিনিগুলো আরো রঙচঙ করা হতে পারে, না-ও হতে পারে। তবে মা আফিয়া বেগম এসব বলেন আরেক রকম। তিনি বলেন, মানুষেরা তাবিজ করে, তারা পাল্লাত পালায় বা বশ করে কিংবা পুংগা লাগায়। পুংগা লাগানোর ফঁন্দিই আলাদা। হয় তাবিজ বা পানিপড়া দিয়ে কাবু করেই ঘোর লাগায়। ঘোরে পড়েই আমাদের পিতা উদাসী মানুষ হন। ‘যেখানে রাইত, সেখানে কাইত’। না হলে মানুষটি মন্দ নয়। এটাই বিশ্বাস মা আফিয়া বেগমের।
আফিয়া বেগম বিয়ের পরেই শুনেছেন গ্রামেরই এক রূপবতী তরুণীর জন্য পাগল ছিলেন আলম চৌধুরী। সেই তরুণী এই বিষয়ে কতটুকু জানতো সেটা আফিয়া বেগম জানতে পারেননি। শুধু জেনেছেন, রাতভর বসে থাকতেন আলম চৌধুরী ঔই বাড়ির লাগোয়া মুরতাবনে। কোন অঘটন ঘটিয়ে না-বসানোর সতর্কতা থেকে আলম চৌধুরীকে বিয়ে করানো হয় সিলেট শহরের নিকটবর্তী মেদিনীপুর। আফিয়ার প্রপিতামহ মানে আমাদের নানার বাপ বজ্রপাতে মরে গেলে দাদা হারানো মেয়ের এক ধরণের অভিভাকশূন্যতা থেকে বাড়ন্ত আফিয়া বেগমকে একটি হাওলা লাগানোর তাগদা ছিল বাড়ির সকলের। সেই সময় আলাপটা যায় আলম চৌধুরীর বাবা-মা অর্থাৎ আমাদের দাদা-দাদীর তরফ থেকেই। সময় বেশি নেয়া হয়নি, বিয়ে হয়ে যায় মাঘ মাসের এক কুয়াশাঘন সন্ধে। (চলবে)