পরিবানু
হামিদ মোহাম্মদ
‘পরিবানু’ উপন্যাস। লিখেছেন হামিদ মোহাম্মদ। সাম্প্রতিক লেখা গ্রন্থখানা বাংলাদেশের সমাজপ্রেক্ষিত, অপ্রাকৃতিক শক্তি, জাদুটোনায় বিশ্বাস ও শঠতায় আচ্ছন্ন সমাজচিত্র এবং দাম্ভিকতার জাল ছিন্ন করার নারীর লড়াই। চলচ্চিত্রশিল্পী সাহসিকা ‘পরিমনি’র জীবনের আংশিক উপাদান রয়েছে কাহিনির নানা পর্বে। উপন্যাসটি ধারাবাহিক প্রকাশ করছে ‘সত্যবাণী’। আমাদের ভরসা পাঠকদের ভাল লাগবে। –সম্পাদক, সত্যবাণী।
॥ছয়॥
আমার বাবা আলম চৌধুরীকে ছোটবেলার সহপাঠীরা ডাকতো শুধু আলম নামেই। বয়স হলে মানুষ সমীহ করে পুরো নামটা উচ্চারণ করে। মানুষের কাছ থেকে শোনা বাবা সম্পর্কে অনেক গল্প মনে পড়ে।শুনেছি—সেই খেলার সাথী এবং মক্তবে আরবী পাঠের সতীর্থ খানম ছিল হলুদরঙ ঝকমকে এক কিশোরী। গা-গেরামের মেয়েলোক মানেই কাজকামে রঙ চটচটে চেহারার একহারা গড়নের অযত্নে বেড়ে ওঠা কেউ। সামান্য বুক টোনপড়ে উচু হলেই বিয়ে দিয়ে শশুড়বাড়ি পাঠিয়ে দেয়ার তোড়জোড় লাগা বংশ পরম্পরা সংস্কৃতি। খানম ছিল সেই পরিবেশে বাড়ন্ত কিশোরী, একটু ব্যতিক্রমী মধ্যবিত্ত পরিবারের কন্যা।
আলমের চোখে ঝিলিক দিয়ে ওঠে সেই খানম। খানম ঠোঁট ফাঁক করে হাসলে গড়িয়ে পড়ে চাঁদ– হালটে উঠোনে এমনকি মক্তবে।
কেন এমন হয়! বুক চিন চিন করে আলমের বুকের বাম পাশে। নাক, ঠোঁট ঘেমে নোনতা হয়ে ওঠে। জিহবা দিয়ে ঠোঁট চেপে স্বাদ নেন। কিসের স্বাদ? কোনসে অনুভুতি! এমনি এমনি পিছ নিতে শুরু করেনআলম। খানম টের পায় কে যেন স্বপ্ন দেখে রাতে না-ঘুমিয়েও।
একদিন মক্তব থেকে বাড়ি ফেরার সময় লুকিয়ে আনা গেন্ডাফুল ছুঁড়ে মারেন আলম। হাত কেঁপে গিয়ে খানমের গায়ে না-পড়ে, পড়ে পায়ের কাছে। খানম বুঝতে পারে, ফিক করে হেসে মারে দৌঁড়।
এছাড়া অনেকদিন পর, আলম চৌধুরী একবার বাড়িমুখো হেঁটে যাচ্ছেন, দেখেন তার সামনে এক মহিলা বোরকা পরা হাঁটছেন আর পেছন পেছন বার বার থেমে থেমে তাকাচ্ছেন। তিনি পায়ের গতি বাড়িয়ে সে মহিলার কাছাকাছি যেতেই মহিলাটি মুখের কাপড় সরিয়ে, হাত দিয়ে একটু উপরে তুলে ফিক করে হেসে বললো, কী আলম ভাই না?
আলম চৌধুরীকে তখন কেউ আলম ভাই বা আলম মিয়া এসব সম্বোধনে ডাকে। তিনি মুখটি দেখে চমকে উঠলেন। এ যে ময়না! সেই স্কুলেপড়াকালিন ক্লাশ নাইনে পড়ুয়া মেয়ে– যার রূপ গুণের কারণে আগাম বিয়ে হয়ে যাওয়া সুন্দরী ময়নার। ময়নার আকুতি ভরা চেহারা বলে দেয়, বুক তির তির করছে সেই শৈশবকাল। কত ভাললাগা মুহূর্ত ছিল, ঘনিষ্ট হয়ে থাকার নানা ঝিলিকমারা দিন। ক্যাচ করে ওঠা বুকে, আলম টের পান ভীষণ রকম এক বেদনার প্রবাহ, বিদ্যুতের গতি কি এমনই হয়? এটা কি প্রেম!
আরেকবার, আলম ছিলেন এক জায়গীরবাড়ি। বর্ষা এলেই তিনি যেতেন জায়গীরে। কেননা, তিন নদী অতিক্রম করেই যেতে হত স্কুলে। নদীপাড়ি দিয়ে স্কুলে ঠিকমত স্কুলে পৌঁছা ছিল কষ্টকর। এই কষ্টলাগবের জন্য জায়গীর। জায়গীর বাড়িতে থাকতেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, তিনি ছাত্র পড়াতেন। বেতন-টেতন নিতেন না। ছাত্রদের লেখাপড়ায় মজবুত করাই তার চেষ্টা। সেই থেকে যারা পড়তে আসতো, তিনি তাদের পড়াতেন। তিনচার জন ছাত্র সকাল বিকাল এসে পড়তো। এর মধ্যে ছিল বাহার নামে এক মেয়ে। লম্বা হালকা গড়ন। মুখটাও নিতান্ত সিনেমার নায়িকার মত ধারালো নাকের। ক্লাশ ফাইভের ছাত্র এই মেয়েটিও বৃত্তি পরীক্ষা দেবে। আলমও বৃত্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। মেয়েটি প্রথম প্রথম আসতো শুধু সকাল বেলা। পরে শুরু করলো বিকেলেও আসা। বিকেলে মানে সন্ধ্যাবেলা। সন্ধাবেলা এলে আর বাড়ি যেতো না, ঐ বাড়িতে রাতে থাকার ব্যবস্থাও জুটিয়ে নিয়েছে সে। তাদের গোষ্ঠীর লোক এরা। গ্রামটা লম্বা পূবপশ্চিমে। তাদের বাড়ি একেবারে পশ্চিমে। আর যে বাড়িতে পড়তে আসা, সে বাড়িটি গ্রামের মধ্যখানে, মাঝপাড় বলা হয়। ধীরে ধীরে মেয়েটি মানে বাহার তার ছোটখাটো কাজে ভিড়তে শুরু করে আলমের। পড়া নেয়া, খাতা লেনদেন, পরে আউট বই নিয়ে টানাটানি। কোন কোন দিন বাড়ি এগিয়ে দেয়া।বাহারেএ বাড়িতেথেকে যেতো সাধারণত বন্ধের দিন, শুক্রবারে।
আলম প্রতি শুক্রবারে পাশের গ্রামেই নিজ বাড়িতে যেতেন। ফিরে আসতেন পরের দিন সকালে। কিছুদিনের মধ্যে কমে যায় বাড়ি যাওয়া। বাহারকে বাড়ি এগিয়ে দেয়ার অপেক্ষাই হয়ে যায় এখন যেন তার কাজ, বাড়ি যাওয়া বন্ধ। বাড়ির টান উবে গেল। যে কোন কাজে বাহার ফিক করে হেসে যখন ওঠে তখন ঝমঝম করে কোথায় কী একটা শব্দ বাজতে থাকে মনে-বিষ্টির না জলপড়ার, কী এক হৃদয় ছেঁদো-করা তীব্র ঘ্রাণধরা তোলপাড় তুফান বয়ে যায়। কোন এক কুহক হাতছানিতে আলম ছিন্নভিন্ন হন দিন দিন।
সেই বাহারের প্রেম করে বিয়ে, বর স্কুলের টিচার। হাইস্কলে পড়াকালে তাদের বাড়িতে নিয়মিত টিচার লজিং থাকতেন। একজনের পর আরেকজন আসতেন লজিংয়ে। আর তার প্রেমও বদলে যেত একজন থেকে আরেকজনে। যার সাথে বিয়ে হয়েছিল, তিনিও টিচার, সবশেষে ছিল তার সাথে প্রেম। শোনা গেছে, সে কত জনের সাথে প্রেম করেছে। সেই বাহারের কিন্তু প্রথম প্রেম ছিল আলমের সাথে, এটা নিজেরবিশ্বাসও, আলম সেটাই আজও মনে করেন। এর পক্ষে যুক্তিও দেখিয়েছেন বন্ধুবান্ধবদের আড্ডায় অনেক দিন। বাহার কোন সূত্রে নানা ডাকতো আলমকে। আলমও নাতিন শব্দটিতে মজা পেতেন। কথাবার্তাও বলা যেত মজা করে, রসের আলাপও জমতো এভাবে। আলমের মনে আছে একদিন, মানে অনেকদিন পরে, বাহার হয়তো দুতিন সন্তানের জননী, তখন সিলেট শহরে দেখা মেলে, সঙ্গে স্বামী। বাহারের স্বামী আবার আলমেরও টিচার। বাহার রিকশা থেকে চিৎকার দিয়ে ওঠে নানাভাই বলে। কী জ্বলজ্বল করা মুখ বাহারের। রিকশা থামিয়ে কথা বলে এক নাগাড়ের অনেকক্ষণ। কথার ধরণএমনই, আলম টের পান এই এখন যেন রিকশা থেকে নেমে চলে আসবে বাহার। বলবে, ‘চলো আমরা পালিয়ে যাই।’ বাহার সেদিন যেন কাঁপছিল তর তর করে। কী বলবে, কি বলবে না। কিছুই বুঝা যাচ্ছিল না। অথবা আলমের মনে হয়েছে তখন হয়তো মেয়ে মানুষেরা এমনই করে।
আলমের মাথায় ঘুরে আরো অনেক কাহিনি। যখন হাইস্কুলে ক্লাস নাইন টেন-এর ছাত্র তখন ক্লাসমেট আবুল কাসেম চিঠি দিয়ে বসে আরেক ক্লাসমেট বান্ধবী নাসরীন নামের একটি মেয়েকে। মেয়েটি এমনিতেই দেমাগি ছিল। উপরন্তু প্রেমের চিঠি পেয়ে সরাসরি বিচার দিয়ে বসে হেড টিচারের নিকট। যেই বিচার, তেমনি কথা নেই আবুল কাসেমকে স্কুল থেকে টিসি দিয়ে বিদায় দিলেন হেড টিচার। সেই মেয়ে ভেবে ছিল সে ডাক্তারি পড়ে ডাক্তার হবে। পড়ালেখায় মন্দ ছিল না। সে মোতাবেক তার দেমাগ গিয়ে দাঁড়ায় অসহিষ্ণু পর্যায়ে–যার পরিণতি আবুল কাসেমের রাসটিকেট। পরে এই মেয়ে ইন্টারমিডিয়েটে পায় থার্ড ডিভিশন। ডাক্তার হতে পারেনি, হয় নার্সিং পড়ে স্টাফ নার্স। অহংবোধের এই মেয়ে যখন নিতান্ত ধসে পড়ে লেখাপড়ায়, স্কুলের আরেক ক্লাশমেট তখন তার পিছু লাগে। এই মেয়ে তখন মনে করে এ ছেলেই তার উপযুক্ত বর। তারপর যা হয়, হল, বিয়ে করে সংসারপাতে। দেমাগের মুণ্ডপাত।
আলমের মাথায় ঘুরে তাদের পড়াকালিন আরো যতসব ঘোরলাগা বিষয়। স্কুলে ছিলেন দশজন শিক্ষকের মধ্যে আটজনই অবিবাহিত। প্রত্যেকেই নাইন টেন-এর ছাত্রীদের সাথে প্রেম জুড়ে দেন। যেখানে আলমরা তাদের ক্লাসমেট মেয়েদের সাথে প্রেম করার কথা, সেখানে প্রেম করছে টিচাররা। যাদের কাছে সৎভাবে শিক্ষা নেয়ার জন্য মেয়েদের দেয়া হল, যারা রক্ষক, তারা ভক্ষক। এই অদ্ভুত ব্যাপারটা যখনই মনে হত, বহুদিন আলমের মাথায় শুধু ভন ভন করতো। তখনকার অভিভাবকরাও এসব জেনেও কোন রা করতো না। তারা বিষয়টি জানলেও, না- জানার ভান করতেন। হয়তো মনে মনে ভাবতেন বা কামনা করতেন মেয়ের তো উপযুক্ত বর পেয়েই গেলেন। অথবা তারা হয়তো কোন কিছুই ভাবতেনই না। আলমের রাগ হতো, এ সময়টিতে তারা বা অভিভাবকরা কেন এসব লোচ্চা টিচারদের পিটিয়ে তক্তা না-বানিয়ে পাত্তা দিতেন। আলম বহুদিন এসব যন্ত্রনা মাথায় বহন করেছেন। এও মনে করেছেন, এখনকার যুবকরা এমন টিচারদের পেটাত না-জানি কেমন। কি মানিয়ে নিত? আলম চৌধুরী এর উত্তর বহুদিন পাননি। শুধু মনে হয়েছে, তখনকার সমাজ ব্যবস্থা বোধ হয় এমনিই ছিল।
আরেকটি ঘটনা বা কাহিনি আলম চৌধুরী বহুদিন মনে রেখেছেন। তারই ক্লাসমেট প্রেম করেন স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর এক কিশোরীর সাথে। মেয়েটির ভাই বিদেশ যাওয়ার সময় সমজে দিয়ে বলেছিল, তুই আমার বোনকে দেখে রাখিস। এই অভিভাবকত্ব পেয়ে প্রেমের চিঠি চালাচালি শুরু। বাড়ির লোকজন টের পেয়ে মেয়ের পড়া বন্ধ। কিছুদিন হা-হুতাশ। মেয়ের বিয়ে হয়ে গেল। তিন দশক পর দুজনের দেখাদেখি নিউইয়র্ক, একটি অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানটি ছিল ঐ মেয়েরই কন্যাসন্তানের বিয়ের চিনিপানের। দেখে দুজনই অবাক, নিউইয়র্ক। কিছুদিন চললো ফোনে স্মৃতিচারণ। এক সময় কী কারণে ঐ মেয়ের ফোনের নাম্বার বদল হয়ে গেল, ফোন করলে রিংই হয় না, কোন রেসপন্সই নেই। এরপর থেকেই কোন যোগাযোগ নেই। হয়তো মেয়েটির ইচ্ছা নেই যোগাযোগ রক্ষা করার বা ফোনটি হারিয়ে গেছে, সেই সঙ্গে নাম্বারও গেছে হারিয়ে। কিংবা হাজবেন্ট বারণ করেছে, হয়ত সন্দেহও করেছে, তার না-চেনা মানুষের সাথে এতো যোগযোগ, কোন লুকোচুরি কিনা, তাও বলতে পারে।
এতোসব গল্পেভরা আলম চৌধুরীর ঝুলি বা মনের কোটর। কিন্তু জীবনভর হাতছানি দিয়ে যে মেয়েটি জুড়ে আছে, যার হাতছানি থামে না, টের পান অবিরাম, সে হল মক্তবের হলুদরঙের ছলছল সমুদ্র-এক, সে যে ‘খানম’। (চলবে)