পরিবানু
হামিদ মোহাম্মদ
‘পরিবানু’ উপন্যাস। লিখেছেন হামিদ মোহাম্মদ। সাম্প্রতিক লেখা গ্রন্থখানা বাংলাদেশের সমাজপ্রেক্ষিত, অপ্রাকৃতিক শক্তি, জাদুটোনায় বিশ্বাস ও শঠতায় আচ্ছন্ন সমাজচিত্র এবং দাম্ভিকতার জাল ছিন্ন করার নারীর লড়াই। চলচ্চিত্রশিল্পী সাহসিকা ‘পরিমনি’র জীবনের আংশিক উপাদান রয়েছে কাহিনির নানা পর্বে। উপন্যাসটি ধারাবাহিক প্রকাশ করছে ‘সত্যবাণী’। আমাদের ভরসা পাঠকদের ভাল লাগবে। –সম্পাদক, সত্যবাণী।
॥৮॥
আমার বাবা আলম চৌধুরী বিশ বছর হয় আর কোথাও যান না। যান না মাছ নিয়ে কারো বাড়ি। অথবা জমে ওঠে-না আর মাছ নিয়ে কারোর বাড়িতে রাঁন্নার ধুম। তবে কাকে যেন খোঁজাটা থামেনি, বুঝা যেত তিনি কি খোঁজ করছেন বা কাকে খুঁজছেন। ধরণ এখন পাল্টেছে মাত্র। খোঁজেন ঠিকই, তবে একেবারে ঘরে বসে থাকার মাঝে খোঁজা সীমাবদ্ধ। এখন সময় কাটে আরেক মাজেজায়। সেটি বই পড়ে, লেখালেখি করে। এতো দিনে, অর্থাৎ গত বিশ বছরে এলাকায় রটেছে তিনি লেখক। ঘুটিয়ে থাকা আলম চৌধুরীর জীবন বদলেছে, থেমেছে, হয়েছে স্থির। তবে অনেক জানা-অজানা ঘটে যাওয়া কাহিনির পর, বয়ে যাওয়া ঝড়ের পর। উথাল পাতাল দিনের কোলাহল দমে যাওয়ার শেষে। হয়ত বয়সই ঘাড়ে ধরেছে কিংবা তিনিই বয়সের ঘাড়ে চড়েছেন। গ্রামের লোক বা বাড়ির লোক অভ্যস্ত হয়ে গেছে এখন, আলম চৌধুরীর একাল দেখছে যারা, তারা ভাবতেই পারবে না বেপরোওয়া আলম চৌধুরীকে বা আলম চৌধুরী কোন মানুষ, কি রকম মানুষ!
আলম চৌধুরী কী করেননি। ঘেটুগান, হালতি গান, আউলিতে মারফতি গান। গানের দল বাঁধা, বাউলদের আনা, বাউল গানের আসরে মানুষদের জমিয়ে রাখা, খাবার দাবারের ব্যবস্থা করা, রূপবানের পালা, গাজীর গীতের আসর বসানো, ফুটবল টিম গঠন, প্রতিযোগিতার আয়োজন, বর্ষার দিনে নৌকাবাইচের হুলস্থুল। গ্রামের, আশপাশ তিন তল্লাটের মানুষের আলম ভাই হওয়ার কত গা ছম ছম করা মুহূর্ত, মানুষের ভিড়ে সময় কাটানো, রাত্রিভর তাসখেলা, ক্ষীর পাকানো, শীতের দিনে অগ্রহায়ন মাসে রুট পোড়া, গরম গরম খাওয়া, মুখপুড়ে যাওয়া। সেই আলম চৌধুরী কোথাও শান্তি পাননি। অগোচরে, আসলে–সব কিছুতে যেন কী খুঁজে বেড়াতেন। কী এক অন্ধকার জগতের বাসিন্দা ছিলেন তিনি। সব বাদ দিয়ে মেতে ওঠেছিলেন মাছ নিয়ে কোথাও কোন ভীন গায়ের বধুর হাতের রাঁন্না খাওয়ার মজায় মজে ছিলেন। সেটাও, সে জোঁস গত বিশ বছর হতে চলেছে, আর নেই।
আজও মনে হয়, ঘেটুগানে যখন ছিলেন মত্ত তখন হতে চেয়েছেন সর্দার, হয়েছেনও। আউলিতে গান গাইতে গিয়ে হয়েছেন প্রধান পদকর্তা। কোন আয়োজনে খাবার দাবার ব্যবস্থায় হয়েছেন প্রধান আয়োজক। গাজীর গীতের আসরের জন্য তিনি ছিলেন মূল ব্যক্তি। ফুটবল টিমের হয়েছেন ক্যাপ্টেন। নৌকাবাইচের প্রতিযোগিতায় হয়েছেন বড় ‘পাঠা’ দানকারি। রূপবানের পালা সংগ্রহ করে নিয়ে আসা একমাত্র লোক সবার আলম ভাই। সব চেয়ে বড় বিষয় ছিল–তিনি ছাড়া ছিল সব কিছু অচল। তিনি ছাড়া কিছুই জমতো না, ভীষণ ভীষণ দিন গেছে। এসময় তিনি ছিলেন কারো আলমভাই, কারো আলম চাচা, যেনবা সকলের মাথার মণি। এই সময়টা ছিল আলম চৌধুরী অর্থাৎ বাবার ভর-যৌবনকাল।
পরের জীবন সম্পূর্ণ আলাদা। এর মাঝে কিছুদিন ভিড়েছিলেন স্থানীয় ‘ভাসানপানি’ আন্দোলনে।(চলবে)