পর্দা নামলো রেইনবো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের

 

*শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র ‘জেকে ১৯৭১’

*বিভিন্ন দেশের ৪৫টি সিনেমা প্রদর্শিত 

*মহিলাদের জন্য ছিল চলচ্চিত্র নির্মাণ কর্মশালা

নিলুফা ইয়াসমীন হাসান
বার্তা সম্পাদক, সত্যবাণী

লন্ডন: সার্বিকভাবে সফল ও সুন্দর একটি চলচ্চিত্র উৎসব শেষ হলো। ৪ঠা জুন রবিবার ইলফোর্ডের কেনেথ মোর থিয়েটারে বিপুল সংখ্যক দর্শকের সমাগমে পর্দা নামলো ২৪ তম রেইনবো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের। পূর্ণ দৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ক্যাটাগরিতে ‘জেকে ১৯৭১’ নির্বাচিত হয়েছে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে।

রেডব্রিজ বারার কাউন্সিলর সায়মা আহমেদ এবং নাদিয়া লোদীর যৌথ সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন রেডব্রিজ কাউন্সিলের লেজার এন্ড কালচার লিড মেম্বার কাউন্সিলর নামরিন চৌধুরী, ভারত থেকে আগত চলচ্চিত্র নির্মাতা দেবানিক কুণ্ড, রেইনবো সোসাইটির কর্ণধার মোস্তফা কামাল ও সামির কামাল।
টাওয়ার হ্যামলেটস বারার বাইরে রেডব্রিজ বারায়ও এবার চলচ্চিত্র প্রদর্শনের জন্য কাউন্সিলর নামরীন চৌধুরী রেইনবো সোসাইটিকে ধন্যবাদ জানান।
রেইনবো সোসাইটির কর্ণধার মোস্তফা কামাল প্রতিবারের মত এবারও দর্শকদের বিপুল সাড়া পেয়েছেন উল্লেখ করে আগামী বছর রেইনবো ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল এর ২৫তম আসর বৃহত্তর পরিবেশে আরো জাঁকজমক হবে বলে আশা প্রকাশ করেন।

প্রদর্শিত চলচ্চিত্রকে মূল্যায়ন করার জন্য গঠিত হয়েছিল জুরী বোর্ড। তাঁদের মূল্যায়নে এবারের চলচ্চিত্র উৎসবে যেসকল ছায়াছবি এওয়ার্ড পেয়েছে সেগুলো হলো-

পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র হিসেবে
শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র : জেকে ১৯৭১ (বাংলাদেশ)
শ্রেষ্ঠ পরিচালক: সাঈদ মর্তুজা ফাতেমি (বাই মাদার) (ইরান)
শ্রেষ্ঠ গল্প : গারগি (ভারত)
শ্রেষ্ঠ মানবতার চলচ্চিত্র: মাম আই এম এলাইভ (কাজাকিস্তান)

স্পেশাল জুরি মেনশন: দ্য কফিন পেইন্টার (চীন)
রেইনবো ফিল্ম সোসাইটি স্পেশাল মেনশন: সাঁতাও (বাংলাদেশ)

শর্ট এবং ডকুমেন্টারি –
শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র: তুলিকা (বাংলাদেশ)
শ্রেষ্ঠ পরিচালক: কাটি কালিও (ওয়াক উইথ মি) (ফিনল্যান্ড)
শ্রেষ্ঠ গল্প: এবং চাঁদ (ভারত)
স্পেশাল জুরি ম্যানশন: আরসু আবদ (ইরান)।

রেইনবো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের প্রতিটি সিনেমা দর্শকদের মন জয় করেছে। ৪ঠা জুন রবিবার উৎসবের সমাপনি দিনে কেনেথ মোর থিয়েটারে প্রদর্শিত হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের চলচ্চিত্র উৎসবে প্রশংসিত ও পুরষ্কারপ্রাপ্ত ছায়াছবি পরিচালক ফখরুল আরেফিন খানের ‘জেকে ১৯৭১‘।
মুম্বাই আন্তর্জাতিক উৎসবে সেরা ঐতিহাসিক সিনেমা হিসেবে পুরষ্কৃত এবং সব্যসাচি চক্রবর্তী, শুভ্র সৌরভ দাস, ইন্দ্রজিৎ মজুমদার প্রমুখ অভিনিত ‘জেকে ১৯৭১‘ মুক্তিযুদ্ধের সময়ের ঐতিহাসিক চলচ্চিত্র। মানবিক এবং সত্য ঘটনা অবলম্বনে পিআইএ ফ্লাইট পিকে ৭১২ হাইজ্যাকের উপর ভিত্তি করে এটি নির্মিত। এতে আরো অভিনয় করেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিনেতা ফ্রন্সিসকো রেমন্ড এবং রাশিয়ান অভিনেত্রী ডেরিয়া গভ্রæসেনকো ও অভিনেতা নিকোলাই নভোমিনাস্কি সহ প্রায় ৩৬ জন অভিনয় শিল্পী কাজ করেছেন।
জ্যঁ ইউজিন পলক্যুয়ে নামক একজন ফরাসী নাগরিক মুক্তিযোদ্ধাদের সাহাযার্থে অর্লি বিমানবন্দরে পাকিস্তান এয়ারলাইন্সের বোয়িং ৭২০ হাইজ্যাক করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানি আর্মীদের দ্বারা যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্তদের বিশেষ করে শিশুদের জন্য ওষুধ সরবরাহের দাবী করেন।

৩রা জুন শনিবার পূর্ব লন্ডনের ব্রাডি আর্টস সেন্টারে প্রদর্শিত হয়েছে জয়া আহসান ও ব্রাত্য বসু অভিনিত ভারতীয় বাংলা ছায়াছবি জীবনানন্দ দাশের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরা পালক‘ এর নামে ছবির নাম ‘ঝরা পালক‘ প্রদর্শিত হয়েছে।
এই ছবিতে জীবনানন্দের ভূমিকায় ব্রাত্য বসু ছিলেন অনন্য। পরিচালক জয়া আহসানকে নানা রূপে ব্যবহার করেছেন ছবিতে, প্রতিটি ক্ষেত্রেই জয়া উত্তীর্ণ হয়েছেন।
একই দিন প্রদর্শিত হয়েছে ইমপ্রেস টেলিফিল্মের প্রণয়ধর্মী নাট্য চলচ্চিত্র ‘পাপপূণ্য‘। রচনা এবং পরিচালনা করেছেন গিয়াস উদ্দিন সেলিম। ভালবাসার গল্পে যে পূণ্য থাকে পাপের একটি থাবা হঠাৎ সেখানে জায়গা করে নেয়, তা-ই তুলে ধরা হয়েছে সিনেমাতে। অনেক শিল্পীর সমাবেশ ঘটেছে এই ছবিতে। অভিনয় করেছেন সিয়াম আহমেদ, চঞ্চল চৌধুরী, আফসানা মিমি, শাহনাজ সুমী এবং ফজলুর রহমান বাবু ও আরো অনেকে।

বিভিন্ন দেশের নান্দনিক ও জনপ্রিয় সিনেমা লন্ডনের দর্শকদের দেখার সুযোগ করে দিয়েছিল রেইনবো সোসাইটি। দেশীয় সংস্কৃতিকে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ছড়িয়ে দেয়ার পাশাপাশি অন্যান্য সংস্কৃতির সুউপাদানসমূহ গ্রহণের মাধ্যমে সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধি করার লক্ষ্যে এবারে অনুষ্ঠিত হলো ২৪তম রেইনবো ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল ।

গত ২৮শে মে দুপুর বারটায় পূর্ব লন্ডনের মাইল এন্ড রোডস্থ জেনেসিসি সিনেমা হলে অনুষ্ঠিত হয়েছে চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। এক নাগাড়ে ২৮শে মে থেকে ৪ঠা জুন পর্যন্ত চলেছে এই উৎসব।

আটদিনব্যাপী চলা এই চলচ্চিত্র উৎসবে বিভিন্ন দেশের মোট ৪৫টি সিনেমা প্রদর্শিত হয়েছে। বাংলাদেশ, ভারত, ইরান, পাকিস্তান, কাজাকিস্তান, চায়না, তাইওয়ান, কোরিয়া, আরমেনিয়া ও ফিনল্যান্ডের সিনেমা দেখেছেন দর্শকেরা। প্রতিটি সিনেমায় ইংরেজী সাব-টাইটেল ছিল। সব সংস্কৃতির সকল কমিউনিটির চলচ্চিত্রপ্রেমীরা উপভোগ করেছেন প্রতিটি সিনেমা।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রদর্শিত হয়েছে অভিজিত গুহ এবং সুদেষণা রায় এর পরিচালনায় নির্মিত কোলকাতার বাংলা ছায়াছবি ‘বেঁচে থাকার গান‘। এতে মূখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন টোটা রায় চৌধুরী, গার্গী রায় চৌধুরী, ইন্দ্রাণী ভট্টাচার্য, পরান ব্যাণার্জী প্রমুখ।
২৯শে মে থেকে ৩রা জুন পর্যন্ত পূর্ব লন্ডনের হ্যানবারী স্ট্রীটে অবস্থিত ব্রাডি আর্টস সেন্টারে প্রতিদিন দুটি করে সিনেমা প্রদর্শিত হয়েছে। চায়নার সিনেমা দ্যা কফিন পেইন্টার, বাংলাদেশের সিনেমা ‘বিউটি সার্কাস‘, ইরানের ছায়াছবি ‘মাদার ল্যাস‘, বাংলাদেশের ছায়াছবি ‘সাঁতাও‘, ইরানের ছবি ‘এ্যাপল ডে‘, বাংলাদেশের ছবি ‘দামাল‘,
কাজাখিস্তানের ছায়াছবি ‘মাম আই এম এলাইভ‘, ভারতের ছায়াছবি ‘লোটাস ব্লুম‘, ভারতের ছায়াছবি ‘ইলহাম‘, পাকিস্তানের ছায়াছবি ‘আই উইল মিট ইউ দেয়ার‘, ভারতীয় বাংলা ছায়াছবি ‘ঝরা পালক‘, বাংলাদেশের ছায়াছবি ‘পাপপূণ্য।

৪ঠা জুন ইলফোর্ডের ক্যানেথ মোর থিয়েটারে চলচ্চিত্র উৎসবের সমাপনি দিনে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে প্রদর্শিত সিনেমার এ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয় এবং প্রদর্শিত হয়েছে ফখরুল আরেফিন খান পরিচালিত ও গড়াই ফিল্মস দ্বারা প্রযোজিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত ছায়াছবি ‘জেকে ১৯৭১‘।

বহু মাত্রিক সাংস্কৃতিক সমাজে পরিবারের সবাই একসঙ্গে উপভোগ করার উপযোগী চলচ্চিত্রগুলো উৎসবে প্রদর্শনীর জন্য বাছাই করা হয়।

ওমেন ইন ফিল্ম কর্মশালা‘:
সিনেমা প্রদর্শন ছাড়াও চলচ্চিত্র উৎসবে শুধুমাত্র নারীদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয়েছে ‘ওমেন ইন ফিল্ম কর্মশালা‘। গত ৩রা জুন শনিবার দিনব্যাপী এই কর্মশালায় অভিনয়, পরিচালনা এবং সম্পাদনাসহ একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে চলচ্চিত্র নির্মাণের অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ পেয়েছেন আগতরা।
চলচ্চিত্র উৎসবের অংশ হিসেবে www.rainbowfilmssociety.com এ যে সকল সিনেমা দর্শকরা দেখেছেন সেগুলো হলো ভারতীয় বাংলা সিনেমা ‘অভিযান‘, ‘অপরাজিতো‘, ‘বাল্লাবপুরের রূপকথা‘, ব্যোমকেশ হত্যামঞ্চ‘, ‘ঘাঘরি‘, ‘কর্ণ সুবর্ণের গুপ্তধন, এবং ‘দ্যা ইকেন‘।

জুরী বোর্ড:
জুরী বোর্ডে ছিলেন রবার্ট ফিলিপস, জয়শ্রী কবীর, পুলক গুপ্ত, সৈয়দ আনাস পাশা, ড. জাকি রেজোয়ানা, সাদেক আহমেদ চৌধুরী, সৈয়দ মুকিব আহমেদ ও নাদিয়া আলী। জুরী বোর্ড বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে যেমন বেস্ট ফিল্ম ফিচার, বেস্ট ফিল্ম ডকুমেন্টারি, বেস্ট ডাইরেক্টর, বেস্ট ফিল্ম ফর হিউমেনিটি, স্পেশাল জুড়ী ম্যানশন, বেস্ট ডাইরেক্টর (স্বল্প দৈর্ঘ্য), বেস্ট স্টোরি (স্বল্প দৈর্ঘ্য) এ্যাওয়ার্ড প্রদানের জন্য নির্ধারণ করেছে।

চলচ্চিত্র উৎসবকে সাফল্য মন্ডিত করতে ফেস্টিভ্যাল কমিটিতে যারা কাজ করছেন তাঁরা হলেন: ডেরেক ম্যালকম, মোস্তফা কামাল, শামিমা ফেরদৌস, খবিরুল ইসলাম খান, আহমেদ মোস্তফা জামাল, দেবানিক কুণ্ড, জোহরী জামানি, জয়শ্রী কবীর, আবু মুসা হাসান, আনোয়ারুল কবীর, বুলবুল হাসান, দিপ্তী অনুপম, ফরিদা কামাল, ফেরদৌস খান, ইমরান খান, মেহের আহমেদ, নাদিয়া লোদি ওয়াহাব, নিলুফা ইয়াসমীন হাসান, সাদেক আহমেদ চৌধুরী, সামির কামাল, সেলিনা খান, শাহনাজ বেগম মণি, স্মৃতি আজাদ, সৈয়দ জুবায়ের আহমেদ, সৈয়দ মকীব আহমেদ, সাঈদা সায়মা আহমেদ, কৃষ্ণা সাহা এবং আহসানুল আম্বিয়া।

উল্লেখ্য, রেইনবো ফিল্ম সোসাইটির কর্ণধার মোস্তফা কামালের উদ্যোগে দু‘হাজার সালে লন্ডনে প্রথম অনুষ্ঠিত হয় চলচ্চিত্র উৎসব। এরপর থেকে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে এই চলচ্চিত্র উৎসব।
রেইনবো ফিল্ম সোসাইটি যুক্তরাজ্যের একটি অলাভজনক চ্যারিটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানটি যুক্তরাজ্যে সাংস্কৃতিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করে যাচ্ছে।

 

You might also like