পুঁজিবাজারে দুর্নীতি তদন্তে অগ্রগতি নেই, কমিটির প্রধানকে নিয়ে প্রশ্ন
নিউজ ডেস্ক
সত্যবাণী
ঢাকাঃ দেশের অর্থনীতির অন্যান্য খাতের মতো বিগত বছরগুলোতে পুঁজিবাজারেও ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে। নামসর্বস্ব দুর্বল কোম্পানিকে তালিকাভুক্তি করা, বন্ডের অনুমোদন দেওয়া, শেয়ার কারসাজির মাধ্যমে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেওয়াসহ অনিয়মের কোনো কিছুই বাদ যায়নি। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর পরিবর্তন আসে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনেও (বিএসইসি)। শুরু হয় অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য খুঁজে বের করার কাজ। কিন্তু কমিটি গঠিত হলেও চার দফায় সময় বাড়িয়ে ছয় মাস অতিক্রান্ত হলেও জমা পড়েনি প্রতিবেদন। পুঁজিবাজারের প্রতি আস্থার যে সংকট বিনিয়োগকারীদের, তা পৌঁছেছে তলানিতে।এরই ধারাবাহিকতায় পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতা, বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সুরক্ষা এবং তাদের আস্থা ফেরাতে দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ বেক্সিমকোর দুটি কোম্পানিসহ মোট ১২টি কোম্পানির অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বিএসইসি পাঁচ সদস্যের একটি বিশেষ অনুসন্ধান ও তদন্ত কমিটি গঠন করে। সেই কমিটিকে প্রথম ধাপে ৬০ দিনের সময় বেঁধে দেওয়া হলেও তদন্ত প্রতিবেদনের কোনো অগ্রগতি হয়নি। এ নিয়ে বাজার সংশ্লিষ্টদের মধ্যেও বিরাজ করছে ক্ষোভ।
যুক্তরাষ্ট্রের টেরা রিসোর্সেস ইন্টারন্যাশনালের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এবং কনসালট্যান্ট জিয়া উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের কমিটিতে রয়েছেন ফিন্যান্সিয়াল সেক্টর স্পেশালিস্ট ইয়াওয়ার সাইদ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক সদস্য মো. শফিকুর রহমান, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার মো. জিশান হায়দার ও বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক মো. আনোয়ারুল ইসলাম।
শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ বেক্সিমকো গ্রিন-সুকুক আল ইসতিসনা, আইএফআইসি গ্রানটিড শেরপুর টাউনশিপ গ্রিন জিরো কুপন বন্ড, বেস্ট হোল্ডিংস লিমিটেড, আল-আমিন কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ, সোনালী পেপার অ্যান্ড বোর্ড মিলস লিমিটেড, ফরচুন সুজ লিমিটেড, রিং শাইন টেক্সটাইল লিমিটেড, একমি পেস্টিসাইডস লিমিটেড, ন্যাশনাল ফাইন্যান্স, কোয়েস্ট বিডিসি লিমিটেড (পূর্বে পদ্মা প্রিন্টার্স অ্যান্ড কালারস লিমিটেড), কপারটেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, এমারেল্ড ওয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড শেয়ার অধিগ্রহণ/হস্তান্তর, মূল্য সংবেদনশীল তথ্য সরবরাহ, সেকেন্ডারি মার্কেটে অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি এবং এ-সংক্রান্ত পুঁজিবাজারের যাবতীয় অনিয়ম ও কারসাজির বিষয়ে অনুসন্ধান ও তদন্ত করতে বলা হয়।
গত বছরের সেপ্টেম্বর প্রথম দিন বিএসইসি চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কমিশন সভায় এই তদন্ত কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতা, বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সুরক্ষা ও পুঁজিবাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে বিগত সময়ের অনিয়ম, কারসাজি ও দুর্নীতির বিষয়ে এ-সংক্রান্ত আইন ও বিধিবিধানের আলোকে অনুসন্ধান ও তদন্ত করার জন্য সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিন্যান্স, ১৯৬৯-এর সেকশন ২১ এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন আইন, ১৯৯৩-এর ধারা ১৭ক-এর প্রদত্ত ক্ষমতাবলে এই ‘অনুসন্ধান ও তদন্ত কমিটি’ গঠিত হয়।
অনুসন্ধান ও তদন্ত কমিটির প্রধান জিয়া উদ্দিন আহমেদ ও অন্য সদস্য ইয়াওয়ার সাইদ, মো. শফিকুর রহমান, মো. জিশান হায়দার তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তারা কেউই তাতে সাড়া দেননি। পরে তাদের প্রত্যেককে হোয়াটসঅ্যাপে খুদে বার্তা পাঠালেও এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তারা কেউই তার কোনো উত্তর দেননি।তদন্তে অগ্রগতি না থাকায় আগের মতোই প্রতিবেদন জমা ও প্রকাশে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ২০১০ সালে পুঁজিবাজারের ধসের পেছনে দায়ীদের বের করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ইব্রাহিম খালেদকে প্রধান করে যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল তা প্রকাশ করা হয়নি, সুপারিশও কার্যকর করা হয়নি। এবারের অনুসন্ধান কমিটির প্রতিবেদন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হবে কি না—এমন শঙ্কা রয়েছে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টদের মধ্যে। এ বিষয়ে কমিটি গঠনের পরদিন অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে বিএসইসি চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ বলেছিলেন, চূড়ান্ত রিপোর্ট পাওয়ার পর কমিশন তা প্রকাশ করবে। সাংবাদিকসহ সবার জন্য সে তথ্য উন্মুক্ত থাকবে।
তদন্ত কমিটির প্রধান জিয়া উদ্দিন আহমেদ পুঁজিবাজারের সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানি ভিআইপিবির চেয়ারম্যান ও পরিচালক। এ কোম্পানির বিভিন্ন বিষয়ে অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। তিনি তদন্ত কমিটিতে থাকায় তদন্ত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ হবে কি না—তা নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। এ প্রসঙ্গে জিয়া উদ্দিন বলেছিলেন, মালিকানার দিক দিয়ে আমরা প্রতিষ্ঠান থেকে মুনাফা নিই, এটাই আমাদের চাওয়া। অনিয়ম হয় ব্যবস্থাপনাগত দিক দিয়ে। আমরা সততা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করব। আমাদের ওপর আস্থা রাখতে পারেন, প্রতিবেদন পক্ষপাতদুষ্ট হবে না।১৯৯৬ ও ২০১০ সালের পুঁজিবাজার ধসের পর গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্য ছিলেন ইয়াওয়ার সাইদ। সেই কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি। তিনি এবারের অনুসন্ধান ও তদন্ত কমিটিতেও রয়েছেন। দেশের প্রথম বেসরকারি সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানি এইমস বাংলাদেশের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক তিনি। পুঁজিবাজারের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করার কথা তুলে ধরে ইয়াওয়ার সাইদ বলেছিলেন, পুঁজিবাজারে মিউচুয়াল ফান্ড চালু হওয়ার পর ২৫ বছরে ২৫ কদমও এগোয়নি। কেন এটি হলো, আমরা তাও বের করব।তদন্ত কমিটির অগ্রগতি প্রসঙ্গে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, এই তদন্ত চলমান আছে। তদন্ত কমিটি সময় পার করেছে। প্রথমে ৬০ দিন সময় ছিল, এরপর এক মাস করে চার দফায় সময় বাড়ানো হয়েছে। সবশেষ আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে।
ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সময় অনেক আশা নিয়ে বিনিয়োগকারী ও বাজার মধ্যস্থতাকারীরা ভেবেছিলেন নতুন কিছু হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত যেহেতু দৃশ্যমান কিছু দেখা যায়নি, তাই সবাই নিরাশ। যে কোনো অনুসন্ধানে সময় লাগতে পারে। যেটা এক মাসে হওয়ার, সেটা সে মাসে না হলে দুই মাসে হবে। কিন্তু এগুলোর সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা থাকা দরকার। কেন সময় বাড়ানো হচ্ছে, তার ন্যূনতম একটা প্রগ্রেস থাকা দরকার। এখানে কী হচ্ছে, তা সংবাদকর্মীরা যেমন জানে না, সাধারণ বিনিয়োগকারীরাও কিছু জানে না আর বাজার মধ্যস্থতাকারীরাও কিছু জানে না। এখানে উন্মুক্ত তথ্য আদান প্রদান না হলে সেখানে সন্দেহ তৈরি হবে। মানুষ মনে করবে গত ১৫ বছরের মতোই আর ভালো কিছু হবে না।ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, এখান থেকে অর্থ পাচার হয়ে গেছে আরও দুই তিন বছর আগেই। এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে তদন্ত করে তা প্রকাশ করলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে একটা আস্থা ফেরানোর সুযোগ রয়েছে। আবার তাড়াহুড়া করতে গিয়ে কোনো অনুসন্ধান করা বাদও রাখা যাবে না। তবে এসব তদন্ত বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যেই হওয়া উচিত। এ বিষয়ে বিএসইসি দেখতে পারে।এ বিষয়ে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, এরকম কমিটি করার চাইতে না করাই ভালো। পাঁচ মাসের মধ্যেও যদি রিপোর্ট দিতে না পারে, তাহলে এমন কমিটির প্রয়োজনীয়তা দেখছি না।