প্রতিদিন পাচার হয়ে আসছে শত শত গরু-মহিষ আর মাদক চোরাচালান চক্রের পোয়াবারো

চঞ্চল মাহমুদ ফুলর
সত্যবাণী

সিলেট থেকেঃ সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার ৪টি ইউনিয়নের সাথে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। বিশাল এলাকার এই সীমান্ত এলাকার বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে অহরহ চলছে চোরাচালান। সিলেট অঞ্চলে চোরাচালানের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে দোয়ারাবাজার সীমান্ত।আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে সীমান্ত পার হয়ে রাতের আঁধারে ভারত থেকে গরু-মহিষ, মাদকদ্রব্য, কসমেটিক্সসহ অবৈধ বিভিন্ন মালামাল পাচার হয়ে আসছে দেশে। ফলে দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতির পাশাপাশি সীমান্ত হত্যা, চোরাচালানচক্রের মধ্যে খুনোখুনিসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ড ঘটছে প্রতিনিয়ত। সর্বশেষ গত সোমবার ঝুমগাঁও-মোকামছড়া সীমান্তে দিয়ে অবৈধভাবে গরু আনতে গিয়ে খাসিয়াদের গুলিতে গুরুতর আহত হয়েছেন ৩ জন।আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও সীমান্ত এলাকার বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, দোয়ারাবাজার উপজেলার বাংলাবাজার ইউনিয়নের সীমান্ত পিলার ১২৩৬-এর কলাউড়া, পেঁকপাড়া, ঝুমগাঁও ও মোকামছড়া, ভোগলা ইউনিয়নের বাগানবাড়ি ও গাছগড়া, লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের ভাঙ্গাপাড়া ও মাঠগাঁও চোরাচালানের নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে দুর্গম ও অরক্ষিত এসব সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন একরকম প্রকাশ্যে গরু ও মহিষ আনা হচ্ছে।

স্থানীয় প্রশাসন জানায়, চোরাচালান নিয়ন্ত্রণে সীমান্ত এলাকায় একটি শক্তিশালী চক্র গড়ে উঠেছে। ভারত থেকে গরু-মহিষ পাচার করে দেশের সীমান্তে আনার পরই তাদের হাতে দেশীয় বিক্রির ইজারা রশিদ তুলে দেয়া হয়। এসব রশিদ সাথে নিয়ে চোরাকারবারীরা বুক ফুলিয়ে গরু-মহিষ বিভিন্ন বাজারে তুলে এবং অন্য স্থানে পাঠিয়ে দেয়।স্থানীয়রা জানান, ভারত থেকে পাচার হয়ে আসা গরু-মহিষ, মাদকদ্রব্যসহ অবৈধ মালামাল দোয়ারার বাংলাবাজার, ছাতকের নোয়ারাই সড়ক হয়ে ছাতক সুরমা ব্রিজ পার হয়ে নৌকা ও সড়কপথে দেশের বিভিন্ন স্থানে চলে যায়। আর এ চোরাচালানী মালামাল পাচারের জন্য সীমান্ত এলাকায় গড়ে উঠেছে সংঘবদ্ধ পাচারচক্র। প্রায়ই পাচারকারীরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর হাতে আটক হলেও অধিকাংশ সময় তারা থাকে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। আবার ধরা পড়লেও আইনের ফাঁক-ফোকড় দিয়ে বেরিয়ে ফের লিপ্ত হয় একই অপরাধে।

চোরাচালানের জন্য প্রাণহানি, এলাকায় মাদকের সয়লাব ও চোরাচালান চক্রের মধ্যে প্রায়ই আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সংঘর্ষ হচ্ছে। বিষয়টি স্বীকার করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ২৮ সুনামগঞ্জ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফট্যানেন্ট কর্নেল মাহবুবুর রহমান বলেন, সীমান্তে চোরাচালান করতে গিয়ে অনেকে হত্যার শিকার হচ্ছে। এজন্য স্থানীয় মানুষদের সচেতনতার উপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।বিজিবি ২৮ ব্যাটালিয়ন দোয়ারাবাজার বাঁশতলা ক্যাম্প সূত্র ও স্থানীয় এলাকাবাসী জানান, গত ৩০ মে সোমবার সন্ধ্যায় দোয়ারা সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় খাসিয়াদের গুলিতে তিন যুবক আহত হয়েছেন। তারা হলেন, বাংলাবাজার ইউনিয়নের পেকপাড়া গ্রামের ওয়াজিদ মিয়ার ছেলে মাসুক মিয়া, আজিজের ছেলে সুমন মিয়া ও আজাদ মিয়ার ছেলে নয়ন মিয়া। ঝুমগাঁও-মোকামছড়া সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে গরু আনতে গিয়ে খাসিয়াদের গুলিতে আহত হন তারা। এর মধ্যে দু’জনকে গুরুতর আহত অবস্থায় সিলেট ওসমানী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

সম্প্রতি দোয়ারা সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে পাচার করে আনার পথে ১৯টি মহিষ আটক করে দোয়ারাবাজার থানা পুলিশ। এসব মহিষ এক সপ্তাহ থানা হেফাজতে রাখা হয়। পরে আদালতের মাধ্যমে নিলামে বিক্রি করা হয়।গত ১৭ এপ্রিল রাতে অভিযান চালিয়ে ৪৭ বোতল ভারতীয় মদ উদ্ধার করে বিজিবি। বাঁশতলা বিওপি’র টহলদল সীমান্ত পিলার ১২৩১/৭-এস হতে ১শ’ গজ বাংলাদেশ অভ্যন্তরে বাঁশতলা-হকনগর শহীদ স্মৃতিসৌধের পাশ থেকে ৪৭ বোতল ভারতীয় মদ উদ্ধার করে। এর বাজারমূল্য ৭০ হাজার ৫শ’ টাকা।
গত ২৮ জানুয়ারি সন্ধ্যায় উপজেলার বাংলাবাজার ইউনিয়নের ঝুমগাঁও সীমান্ত এলাকায় চোরাই গরু আটক অভিযানে চোরাকারবারীদের হামলায় বিজিবি টহল কমান্ডার নায়েক সুবেদার ইলিয়াস হোসেন আহত হন। তাকে আহত করে ৩০-৩৫টি ভারতীয় গরু নিয়ে যায় চোরাকারবারীরা। পরে অভিযান চালিয়ে চারটি গরু উদ্ধারসহ দুই আসামিকে আটক করা হয়।সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে গরু-মহিষ আনা নিয়ে গত ২৬মে উপজেলার বাংলাবাজার ইউনিয়নের ব্রিটিশ পয়েন্টে দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে গুরুতর আহত সুলতান মিয়া (৩৫) ও আরজ আলী (৪২) কে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ ঘটনায় ২৭মে দোয়ারাবাজার থানা পুলিশ ছনুগাঁও গ্রামের মৃত হোসেন আলীর ছেলে আকিক মিয়াকে (৩৫) আটক করে।
স্থানীয়রা জানান, চোরাকারবারীরা পশু নিয়ে যাওয়ার পথে দোয়ারা ও ছাতকের কয়েকটি স্থানে প্রভাবশালীরা তাদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করে। ২৬ মে রাতে চোরাইপথে ভারতীয় মহিষ নিয়ে যাওয়ার পথে চাঁদা নিয়ে উপজেলার কুশিউড়া গ্রামের সুলতান মিয়া ও ছনুগাঁও গ্রামের আকিক মিয়া পক্ষদ্বয়ের মধ্যে সংঘর্ষ হয় ।৩১ মার্চ সীমান্তে বিজিবিকে মদ বিক্রির গোপন তথ্য প্রদানের জেরে উপজেলার বাংলাবাজার ইউনিয়নের মৌলারপাড় গ্রামে দু-পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে। সংঘর্ষে ১৫ জন আহত হন। গুরুতর আহত তিনজনকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

স্থানীয় ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, মৌলারপাড় গ্রামের রফিকুল ইসলামের ছেলে দিলোয়ার হোসেন ও পার্শ্ববর্তী চৌধুরীপাড়ার প্রবাসী তাজুল ইসলামের ছেলে রায়হান-এ দু’পক্ষের মধ্যে মাদকদ্রব্য বেচাকেনাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিরোধ ছিল দীর্ঘদিনের। ওইদিন সন্ধ্যার পর রায়হান স্থানীয় বাংলাবাজার থেকে বাড়ি ফিরছিল। পথিমধ্যে ওঁৎ পেতে থাকা রফিকুল ইসলামের লোকজন রায়হানকে বেধড়ক পিটিয়ে গুরুতর আহত করে। খবর পেয়ে তাৎক্ষণিক দেশীয় অস্ত্রসহ দু’পক্ষ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।দোয়ারাবাজার উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ ইদ্রিস আলী বীরপ্রতীক বলেন, উপজেলার সীমান্ত এলাকায় চোরাচালানের জন্য সামাজিক অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা দিন দিন বাড়ছে। যুবসমাজও বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে। এসব অপরাধের সাথে যেসব চক্র জড়িত তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা প্রশাসনের দায়িত্ব।ছাতক উপজেলা চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান বলেন, প্রতিদিন মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত পালে পালে গরু-মহিষ দোয়ারা থেকে ছাতক দিয়ে আসতে দেখা যায়। অবৈধ এসব পশুর জন্য স্থানীয় খামারিদের লোকসানে পড়তে হচ্ছে। অনেকে খামার করতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে।বিজিবি ২৮ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফট্যানেন্ট কর্নেল মাহবুবুর রহমান বলেন, দোয়ারা বর্ডার বেল্ট একটি বৃহৎ এলাকা এবং অনেকটাই অরক্ষিত। সেখানকার লোকজনের বিশাল একটা অংশ চোরাচালানের সাথে জড়িত। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা প্রায়ই চোরাচালানের জন্য সীমান্তের ওপারে যায়। বিজিবি নিয়মিত অভিযান এবং টহলের পাশাপাশি স্থানীয় বাসিন্দাদের সচেতন করতে বিভিন্ন সভা করছে। চোরাচালান বন্ধে স্থানীয় মানুষদের সচেতন হতে হবে।দোয়ারাবাজার থানার ওসি দেবদুলাল ধর বলেন, চোরাচালানের গরু-মহিষ, মাদকসহ অবৈধ মালামালের বিষয়ে আমাদের অবস্থান কঠোর। কিন্তু গরু-মহিষ আটকের পর অনেক সময় বিক্রির রশিদ দেখিয়ে চোরাকারবারীরা চ্যালেঞ্জ করে বসে। এই কাজে তাদেরকে স্থানীয় একটি চক্র সহযোগিতা করে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

You might also like