ফিরে দেখাঃ খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকান্ড

ফেইসবুক ডেস্ক
সত্যবাণী

লন্ডন: বৃটিশের চালু করা কারা-শাস্তির চর্চ্চা তখনও প্রবলভাবে বিরাজমান কারাগারগুলোতে। খাবার কম দেয়া, তামাক নিষিদ্ধ করা, অমানুষিক শারিরিক শ্রম আদায় করে নেয়া এসব ছিল কারাগারের নিয়মিত চিত্র।
তার মধ্যে অন্যতম ছিল, তেলের ঘানিকলে পশুর পরিবর্তে কয়েদিদের ব্যবহার। এই ঘানি কলে তখন প্রায় দেড় মন ওজনের দীর্ঘ একটি লোহার দণ্ড ব্যবহার করা হত। এটির ভারে প্রায় নুয়ে পড়তো বন্দীরা। তবু ঘানি ঘুরিয়ে যেতে হতো। কেননা থামলেই প্রহরির চাবুক পিঠে।

অত্যাচার ও জুলুমের বিরুদ্ধে জেলের মধ্যেই আন্দোলন শুরু করেন কমিউনিস্ট বন্দীরা। জেল থেকেই সরকারের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ আনেন তাঁরা। কারা আইনের আমূল সংস্কার করে নতুন করে কারা আইন প্রবর্তন এবং বিচারা ধীন মামলা সমূহের অতি দ্রুত নিষ্পত্তির দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন ।

জেলের অভ্যন্তরে এসব দাবি উত্থাপন ও আন্দোলন গড়ে তুললে, উত্তেজিত ও বেসামাল হয়ে সরকার কমিউনিস্ট বন্দীদের ওপর দমন-পীড়নের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।মুসলিম লীগ সরকার রাজবন্দীদের ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ বলে বিবেচনা করে।

খুলনা জেলে পিটিয়ে হত্যা করা হয় কমিউনিস্ট কর্মী কমরেড বিষ্ণু বৈরাগীকে। কমিউনিস্ট কর্মী কমরেড নাদেরা বেগমের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদে ঢাকা জেলে অনশন শুরু হয়। এই খবর পেয়ে রাজশাহী জেলেও কমিউনিস্ট বন্দীরা অনশন শুরু করেন।

লড়াইয়ের অন্যতম পন্থা হিসেবে রাজবন্দীরা বেছে নেন অনশনকে। ১৯৪৯ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত, ঢাকা ও রাজশাহী জেলের কমিউনিস্ট বন্দীরা ৪ দফায় মোট ১৫০ দিন অনশন করেন।কমিউনিস্ট বন্দীরা চেষ্টা করেন সব জেলে একযোগে আন্দোলন গড়ে তুলতে। বদলীকৃত বন্দীদের দ্বারা তখন খবর আদান-প্রদান করা হতো। ঢাকা জেলে জোর করে অনশনকারীদের ফিডিং করাতে গেলে, ৮ ডিসেম্বর কমরেড শিবেন রায়ের মৃত্যু হয়।

রাজবন্দীদের মর্যাদার দাবিতে ব্রিটিশ আমলে ৬৩ দিন অনশন করে জীবন দিয়েছিলেন কমিউনিস্ট কর্মী কমরেড যতীন দাশ। ১৯৪১ সালে হিজলী বন্দী নিবাসে গুলি করে কমিউনিস্ট কর্মী কমরেড সন্তোষ মিত্র ও কমরেড তারকেশ্বর সেনকে হত্যা করা হয়। এসব আত্মদান আন্দোলনকারী বন্দীদের প্রেরণা জোগাতো।

রাজশাহী জেলে ১৯৫০ সালের এপ্রিল মাসে সাধারণ কয়েদীরা অনশন শুরু করলে, কমিউনিস্ট বন্দীরাও যোগ দেন। ঘানি টানানো হবে না, ভালো খাবার দেওয়া হবে- এই আশ্বাসের ভিত্তিতে ১৪ এপ্রিল অনশন প্রত্যাহার করা হয়। কয়েদীদের দাবি দাওয়া নিয়ে রাজশাহী কারাগারে কমিউনিস্ট নেতারা কারা কর্তৃপক্ষের সাথে বসতে চাইলে প্রথমত: তারা আলোচনায় বসতেই রাজি হননি। এক পর্যায়ে রাজবন্দীদের দাবির মুখে তৎকালিন আই জি প্রিজন তাৎক্ষণিক মিটিং শুরু করলেও এক উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে সে আলোচনার সমাপ্তি ঘটে।

আই জি প্রিজন সেদিন জেল থেকে বের হয়ে যাওয়ার আগমূহুর্তে জেল সুপার মি: বিলকে একটি সাংঘাতিক নির্দেশ দিয়ে যান। সে নির্দেশটি হলো, কমিউনিস্টদের মধ্যে যারা নেতা গোছের তাঁদের বিছিন্ন করে ১৪ নম্বার সেলে নিয়ে যেতে হবে।

রাজশাহী জেলের এই ১৪ নম্বার সেলটি ছিল কনডেম সেল। এই সেলের বিশেষ পরিচিতি ছিল কুষ্ঠ ও যক্ষা রোগীদের এবং ফাঁসির আসামিদের রাখার জায়গা হিসাবে। তাছাড়া জেলে কোন বন্দী মারা গেলে সেই লাশের পোস্টমর্টেম করা হতো এই ১৪ নম্বার সেলে।

যথারীতি মি: বিল খাপড়া ওয়ার্ডে এই ফরমান জারি করেন এবং একদিনের মধ্যে বেশ কয়েকজনকে ১৪ নাম্বার সেলে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন।

২৩ এপ্রিল সারা রাত আলোচনা করার পর, ২৪ এপ্রিল সকালে কমরেড কম্পরাম সিং তেজদীপ্তভাবেই বলেন, ‘শাস্তি আমরা মানবো না- সেলে আমরা যাবো না, নিতে এলে বাধা দেবো।’
২৪ এপ্রিল সোমবার আনুমানিক সকাল ৯টা ১৫ মিনিটে, সাম্প্রদায়িক মুসলিম লীগ সরকারের বিশ্বস্ত তাবেদার রাজশাহী জেল সুপারিন্টেনডেন্ট এডওয়ার্ড বিল দলবল নিয়ে হঠাৎ করেই খাপড়া ওয়ার্ডে ঢুকে পড়েন এবং কমরেড আব্দুল হকের সঙ্গে কথা বলতে থাকেন। বিল সাহেব যে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়েই ওয়ার্ডে ঢুকেছেন, সেটা কারো বুঝতে অসুবিধা হয় না।

এক পর্যায়ে ‘কমিউনিস্টরা ক্রিমিনাল’ বলে গালি দিতে দিতে বিল ওয়ার্ড থেকে বের হয়েই দরজা বন্ধ করার নির্দেশ দেন। বিল বাঁশি বাজানোর সঙ্গে সঙ্গেই পাগলা ঘণ্টা বাজতে শুরু করে।
মশারি টাঙানো মোটা তার দিয়ে দরজা আটকিয়ে জানালা ভেতর থেকে বন্ধ করা হয়। বিল গুলি চালাতে নির্দেশ দেন। বাঁশ দিয়ে জানালার কাঁচ ভেঙে, জানালার ফাঁকের মধ্যে বন্দুকের নল ঢুকিয়ে গুলি করতে থাকে সিপাহীরা। রক্তে ভেসে যায় খাপড়া ওয়ার্ড।

রাজবন্দীরা চিৎকার করে দরজা খুলে দিতে বলেন। দরজা খুলতেই সিপাহী ও কয়েদী পাহারা মেটরা, আহত-নিহত নির্বিশেষে সবাইকে পেটাতে শুরু করে। বিল নিজ হাতে পেটাতে থাকেন কমরেড আব্দুল হককে। বেলুচ আরআই বিলকে বের করে নিয়ে যান।

রক্তস্নাত খাপড়া ওয়ার্ডে ঘটনাস্থলেই ৫ জন কমরেড শহীদ হন। রাতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন কমরেড কম্পরাম সিং আর কমরেড বিজন সেন। তাঁদেরকে হয়তো বাঁচানো যেত। কিন্তু আহতদের কোন চিকিৎসাই হয়নি।

নিরস্ত্র ৩৬ জন (সংখ্যা নিয়ে মতভেদ আছে) বন্দীর ওপর ১৮০ রাউন্ড গুলিবর্ষণ করা হয়েছিল সেদিন। হানাদারদের ৩ দফা লাঠিচার্জ থেকে অর্ধমৃত ও নিহতরাও বাদ যান নি। রেহাই পাননি রাজশাহী জেলের অন্যান্য ওয়ার্ড ও সেলের রাজবন্দীরাও।

খাপড়া ওয়ার্ডের জীবিত প্রত্যেক বন্দীই গুলি ও লাঠিচার্জে গুরুতরভাবে আহত হয়ে ছিলেন। গুরুতর আহত কমরেড নুরুন্নবী চৌধুরীর পা কেটে ফেলতে হয়েছিল। পঙ্গু হয়ে যান কমরেড অনন্ত দেব। খাপড়া ওয়ার্ডের স্মৃতি হিসেবে সেদিনের আহত অনেকেই শরীরের ভেতরে গুলি পুষে রেখেছিলেন। মাঝে মাঝে প্রচ- যন্ত্রণা হলেও, খাপড়া ওয়ার্ডের গুলি অপারেশন করে শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করেননি। মনসুর হাবিব, আব্দুল হক, আশু ভরদ্বাজ, প্রসাদ রায়, আমিনুল ইসলাম বাদশা, আব্দুস শহীদসহ খাপড়া ওয়ার্ডের আহত প্রায় সকল কমরেডই একে একে বিদায় নিয়েছেন।

নিহত যাদের পরিচয় পরবর্তীতে নিশ্চিত হওয়া গেছে তাদের মধ্যে আছেন –

♦ কমরেড বিজন সেন (রাজশাহী)
♦ কম্পরাম সিং (দিনাজপুর)
♦ আনোয়ার হোসেন (খুলনা)
♦সুধীন ধর (রংপুর)
♦হানিফ শেখ (কুষ্টিয়া)
♦ সুখেন ভট্টাচার্য (ময়মনসিংহ)
♦ দেলোয়ার হোসেন (কুষ্টিয়া)।

খাপড়া ওয়ার্ডের শহীদরা, আন্দোলনকারীরা ছিলেন অকুতোভয় । শ্রমিক নেতা কমরেড সুধীন ধর দেশের ডাকে মাত্র ১৩ বছর বয়সে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন। ১৯৩৭ সালের আন্দামান অনশনের নেতা কমরেড বিজন সেন যুক্ত ছিলেন কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে। শ্রমিক পরিবারের সন্তান কমরেড হানিফ শেখ যুক্ত ছিলেন শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে। অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনের মাধ্যমে রাজনীতিতে হাতে খড়ি হয় কমরেড কম্পরাম সিংয়ের।দরিদ্র কৃষক পরিবারের মেধাবী সন্তান কমরেড আনোয়ার হোসেন ছিলেন ছাত্র নেতা ও সাংস্কৃতিক কর্মী। পারিবারিক-রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠা কমরেড সুখেন্দু ভট্টাচার্য ছিলেন তৎকালীন ছাত্র ফেডারেশনের প্রথম সারির নেতা। কৃষক পরিবারের সন্তান কমরেড দেলোয়ার হোসেনকে অল্প বয়সে কর্মজীবন শুরু করতে হয় এবং মাত্র ২০ বছর বয়সে তিনি দায়িত্বশীল সংগঠক হন।

তোমাদের মতো মানুষের আবার বড়ো প্রয়োজন আজ এই মাটির –

Courtesy : সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী বাংলাদেশ

(উৎপল কান্তি ধরের টাইম লাইন থেকে নেয়া)

You might also like