বই আলোচনা: ‘পৌষ মাস আর সর্বনাশের গল্প’ পাঠের পর
হামিদ মোহাম্মদ
‘পৌষ মাস আর সর্বনাশের গল্প’ বইটি পড়ে শেষ করলাম। গল্পগুলো লিখেছেন চৌধুরী শামসুদ্দীন। লেখক হিসাবে নবীন এই স্বীকারোক্তি বইয়ের লেখকের পরিচয় পর্বে রয়েছে। করোনাকালিন অখণ্ড সময়কে কাজে লাগাতে গিয়ে এই সৃজনশীল প্রচেষ্টা। তাই, আমার আগ্রহ বেড়ে গেল করোনাকালিন এক অবর্ণনীয় সময় পার করার অনুভুতি কার কি রকম ছিল, পেয়ে বসে সেটাকে আবিষ্কার করা চাঞ্চল্যও।
গত সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি বইটি হাতে পাই। দেখা ও সখ্যতা লেখকের সাথে লন্ডনে আয়োজিত বাংলাদেশ বইমেলায়। কয়েকটি বই হাতে নিয়ে এলেন তিনি বইমেলায়। পাঠকের হাতে পৌঁছে দেয়ার উদগ্র আকাঙ্ক্ষা তার চোখেমুখে। বইমেলায় আমার কবিকণ্ঠের একটি স্টল ছিল। সেখানেই বইগুলো রাখলাম। এধরণের বইমেলায় বইবিক্রি মানে, পুসিং সেল। বেশ কয়েকটি বই পরিচিতজনদের গছিয়েও দিলাম দুইদিনের মেলায়। পাশে বসে লেখক চৌধুরী শামসুদ্দীন বইগুলো পড়ার অনুরোধ করলেন,যারা নিলেন, তাদের।
কৌতুহল নিয়ে বই দুটির মধ্যে ‘পৌষ মাস আর সর্বনাশের গল্প’ বইটি প্রথমে পড়তে বসেই ভালো লাগলো। বিরতি দিয়ে কয়েক দিনে শেষ করলাম। গল্পগুলোর নাম পড়তে টান বোধ করা পাঠক হিসাবে মন্দ লাগেনি। এ বইয়ে গল্প ‘সকরুণ বেনু’ ‘পৌষ মাস আর সর্বনাশের গল্প’ ‘আখলুছ মিয়ার শেষ দিন’ ‘চিতল মাছ’ ‘লাবিবের বিয়ের দিন’ ‘কাঁথা’ ‘সানু নিরুদ্দেশ’ ‘এবং যেহেতু মা, মা-ই’ ‘দিবানিদ্রায় দু:স্বপ্ন’ ‘জন টেরির ভূত দর্শন’ ‘গুলতি’ও ‘নবাবজাদা’। পাঠক হিসাবে যে আগ্রহ ছিল, সে আগ্রহ আমাকে আশাহত করেনি।
আমরা জানি, একজন নবীন লেখক কী করে গল্প জুড়তে হয় সেই কলাকৌশল না-জানারই কথা। শিল্পবোধ তো পরের কথা। ভাষা নির্মাণ বা ভাষাশৈলী রপ্ত করতে হলে অবশ্য সাহিত্যের পাঠক হওয়াও প্রয়োজন। যত পাঠ করবেন, তত লেখালেখির মান বাড়ে।
কিন্তু আমি বিস্মিত হলাম, চৌধুরী শামসুদ্দীন প্রথম দফায় কেমন জানি পরিমিতিবোধ নিয়ে লিখেছেন গল্পগুলো। তার প্রথম গল্প ‘সকরুণ বেনু’ একটি উপন্যাসের আবহ বিস্তারি গল্প। তিনি হয়তো উপন্যাসই লিখতে বসেছিলেন। কিন্তু উপন্যাস না-লিখে বড় গল্পের আদল দিয়ে পাঠককে প্রশান্তি দিয়েছেন। এটা তার কৃতিত্ব।
গল্পগুলোর পটভুমি মূলত প্রবাস জীবন। কিন্তু বিস্তৃত হয়েছে বাংলাদেশ তথা মাতৃভূমি পর্যন্ত। সেই শৈশব, বাংলার প্রকৃতি, নদী, হাওর, মাছ ধরা, আনন্দবেদনা আর বিদেশবিভূইয়ের অসহায় জীবন, নিজেকে টেনে তোলার, বাঁচার যুদ্ধ। শেষ গল্পটি ‘নবাবজাদা’ খুবই চমতকার। করোনাকালে কোয়ারেনটাইনে থাকা ও এর বিষাদপূর্ণ জীবন এবং একে নিয়ে প্রবাসীদের প্রতি কর্তৃপক্ষীয় তুচ্ছতাচ্ছিল্য যে কী পরিমাণ বেদনাবহ ছিল তা এ গল্পে চিত্রময় হয়ে একটি সত্য ঘটনাকে গল্পের মর্যাদা দিয়েছে। আলোড়ন সৃষ্টিকারি এ ঘটনা ঘটেছিল ঢাকা বিমানবন্দরে নামা ও কোয়ারেনটাইনে যাওয়া প্রবাসীদের নিয়ে। ব্যাঙ্গাত্মক এ গল্প আমাদের সমাজের চিত্র।
প্রবাস জীবনের নানা ঘটনা হলো গল্পগুলোর প্রতিপাদ্য। গল্পগুলো পড়তে গিয়ে চোখে পড়েছে ভাষা ব্যবহার। ন্যারেটিভ বা বর্ণনা প্রমিত বাংলা তেমন আড়ষ্টবোধ হয়নি। ভালো লেগেছে ডায়লগ। কথোপকথন বা ডায়লগ আঞ্চলিক ভাষা ও উচ্চারণ কৌতুলোদ্দীপক। সিলেটের সুনামগঞ্জের ভাটি অঞ্চলে লেখকের নিবাস। তিনি তারই যাপিত জীবন থেকে সে অঞ্চলের ভাষাশৈলী সেজাসাপটা কথোপাকথনে প্রয়োগ করেছেন। তবে প্রমিত বাংলায় কিছু শব্দ ভুল বানানÑদৃষ্টিতে পড়েছে। ১৩ পৃষ্ঠায় ৩ নং লাইনে ‘পরি’ হবে পড়ি। ৮ নং লাইনে ‘ব্যবস্থার’ নয়, হবে ‘ব্যস্ততার’একই পৃষ্ঠায় বা পুরো গল্পে বার বার ব্যবহার হয়েছে ‘শাশুর’ বা শাশুরী। হবে শাশুড়’ বা শাশুড়ি’। ১৫ নং পৃষ্ঠায় ২০ নং লাইনে ‘পরবর্তীকালে’ শব্দটি কী তা বুঝা মুষ্কিল। ২১ নং লাইনে ‘কোনায়’হবে কোণায়। ‘ভাবের’ হবে ভারে। ৫৯ পৃষ্ঠায় এলোপাতারি’। হবে ‘এলোপাতাড়ি’। ৬৫পৃষ্ঠার ১১ লাইনে ‘ধোয়ায়’ ‘আধার ১৩ নং লাইনে ‘দায়ীত্ব’ ভুল বানান। এরপর কাথা গল্পটি নাম বানান ভুল। ভেতরেও ভুল। বানান হবে ‘কাঁথা’। ৮৯ পৃষ্ঠার ৭ নং লাইনে ‘পরেছে’হবে পড়েছে। এরকম অনেক ভুল বানান প্রতিটি লেখায় আছে।
বানান ভুল লেখকের হতে পারে, এটা লেখকের দোষ নয়। শুদ্ধ করার দায়িত্ব প্রকাশকের সম্পাদনা বিভাগের। এখানে প্রকাশকের যত্ন নেয়ার মধ্যে ঘাটতি লক্ষ্য করার মতো।
এসব ঘাটতি বাদ দিলে ভালোলাগার মতো অসংখ্য লাইন রয়েছে। যেমন ‘সকরুল বেনু’ গল্পে শুরুটা এমন—‘রেস্টুরেন্টে এসে পৌঁছার সাথে সাথে তাহেরার ফোন, ঘরে আইতায় ফারবায়নি, তাড়াতাড়ি. . .। আজ শনিবার,উইকএন্ড। এদেশে আসার প্রথম দিকে, প্রায় পঁচিশ বছর আগে আমার শশুর, তখনও যদিও তিনি আমার শশুর হননি এক শনিবারে কাজে দেরিতে আসায় বলেছিলেন, শনিবারে আজরাঈলও যেন ডাকতে না-আসে।’
এই দুটো লাইনে বিলাতে রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী ও কর্মীদের জীবন সম্পর্কে একটি প্রচ্ছন্ন চিত্র ফুটে ওঠেছে। অল্প কটি কথা বুঝিয়ে দেয় কত কঠিন জীবনযাপন এখানে। গল্পের এরকম শুরুটা একটানা গল্পের শেষ প্রান্তে টেনে নেয় পাঠককে। শেষ স্তবকে এসে পাঠক বুঝতে পারেন গল্পটার ভেতরের কাঁন্না কী মমস্পর্শী।
‘পৌষ মাস আর সর্বনাশের গল্প’র ৪৩ পৃষ্ঠায় বর্ণনা এমন—‘গেদি, এক গেলাস পানি খাওয়াও তো বইন, বড় তিয়াস লাগছে।
পানিতেই থাকো, তাও পিয়াস লাগে?
লাগে লাগে,হাসতে হাসতে বলে হাসেম, পানিতেই পানির পিয়াস, বেশি লাগে, হেই গানটা হন নাই ‘ফকির লালন মরে জল পিপাসায় থাকতে কাছে নমী মেঘনা’।
অইছে অইছে, আর গান হুনান লাগত না, তোমার যা এক কান ফাটা বাঁশের লাকান গলা, পারি খাইয়া, পান লইয়া ভাগো, আমার কাম আছে’।
‘কলসির ঠাণ্ডা পানিতে তৃষ্ণা মিটিয়ে, গেদির সাথে আরো একটু গাল-গল্প করার তৃষ্ণা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে হাসেম। মদনালীকে পানটা দিয়ে সে তার মুখের পান চিবায়। গেদি তাকেও একটু পান দিয়েছে। নিজের অজান্তেই লুঙ্গির গিটে গুঁজে রাখা বিড়ির প্যাকেটটায় হাত চলে যায় তার। গেদির কাছে কিছুক্ষণ থাকার, কিছু কথা বলার বাসনার মত সে বিড়ি খাওয়ার ইচ্ছাটাও দমন করে। মদন চাচার সামনে সে বিড়ি ধরায় না, মদন চাচা মুরব্বি মানুষ।’
এই গল্পের এ কটি লাইনে কথোপকথন ও বর্ণনায় যে চিত্রময়তা রয়েছে, তা অপূর্ব। প্রতিটি গল্পে একটি কাহিনি আছে, যে কাহিনি একটি বার্তা বহন করে। প্রেম আর জীবন জিজ্ঞাসার সূত্র, প্রবাস জীবনের কাতর ধ্বনি প্রতিটি গল্পের ভেতর যেন হামাগুড়ি দিচ্ছে। গল্পগুলো পড়ে পাঠকরাও খুঁজতে থাকবেন নিজ নিজ জীবনের ভেতর জীবনকেই এবং সমাজের দীর্ঘশ্বাসকে, নতুন দৃষ্টিভঙ্গিকে।
আমার বিশ্বাস, গল্পকার চৌধুরী শামসুদ্দীন গল্পলেখায় যদি বিরতি না-টানেন, তবে আমরা পাঠকরাও আরো উপকৃত হবো। তার প্রথম লেখা গল্পগুলোর বই মুদ্রকের অভিজ্ঞতাহীনতার কারণে মুদ্রণে যে সমস্ত ভুল বা ত্রুটিরয়েছে, তা পাঠকরা ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। চোখ ধাঁধিয়ে দেয়া সুন্দর প্রচ্ছদ এঁকেছেন নির্ঝর নৈশব্দ। পৃষ্ঠা ৯৬। প্রকাশ করেছেন ‘সূচীপত্র’। প্রকাশকাল—ফেব্রুয়ারি ২০২৪।
হামিদ মোহাম্মদ: কবি ও সাংবাদিক