বরণ্যে রাজনীতিক পঙ্কজ ভট্টাচার্য আর নেই
ঢাকা করেসপন্ডেন্ট
সত্যবাণী
ঢাকা থেকে: বাংলাদেশের বরেণ্য রাজনীতিবিদ, ষাটের দশকের ছাত্র আন্দোলনের কিংবদন্তী নেতা, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ন্যাপ-কমিউনিষ্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা বাহিনী সংগঠক, ঐক্য ন্যাপ সভাপতি প্রবীন জননেতা পঙ্কজ ভট্টাচার্য আর নেই। স্থানীয় সময় সোমবার প্রথম প্রহরে ( রবিবার দিবাগত রাত ১২.২৮ মিনিট) ঢাকা হেলথ এন্ড হোপ হাসপাতালের ডাক্তাররা তাঁর মৃত্যুর খবর ঘোষণা করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিলো ৮৩ বছর। পঙ্কজ ভট্টাচার্যের মৃত্যুর খবরটি সত্যবাণীকে নিশ্চিত করেন তাঁর শ্যালিকা বহ্নি শিখা দাস ও সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সালেহ আহমেদ।
পঙ্কজ ভট্টাচার্যের শ্বাসকষ্টের সমস্যা ছিলো। তিনি করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। এরপর তিনি কয়েকবার নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন। নতুন করে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার পর গত সোমবার তাঁকে রাজধানীর হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর আরও অসুস্থ হয়ে পড়ায় গতকাল শনিবার সকালে তাঁকে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়। সেখানে তাঁকে প্রথমে আইসিইউতে রাখা হয়। গতকাল শনিবার সকালে নিয়ে আসা হয় ভেন্টিলেশনে।
১৯৩৯ সালের ৬ আগস্ট চট্টগ্রামের রাউজান থানার নোয়াপাড়া গ্রামে পঙ্কজ ভট্টাচার্য জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন সুশিক্ষিত, প্রগতিশীল বর্ণাঢ্য পরিবারের সন্তান। তাঁর পিতা প্রফুল্ল কুমার ভট্টাচার্য ছিলেন উচ্চশিক্ষিত সংস্কারমনা স্কুলশিক্ষক, আর মা মনিকুন্তলা দেবী ছিলেন তৎকালীন সামাজিক অচলায়তন ভাঙা মহীয়ষী নারী। তাঁরা ছিলেন স্বদেশী আন্দোলনের প্রতি ভীষণভাবে অনুরক্ত এবং বিপ্লবীদের নিরাপদ আশ্রয়। পিতামহ রমেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য ছিলেন চট্টগ্রামের একজন প্রসিদ্ধ আইনজীবী ও সমাজ সংস্কারক। সুতরাং পারিবারিক পরিমণ্ডলেই পঙ্কজ ভট্টাচার্য প্রগতিশীলতার শপথ নিয়েছেন।
পঙ্কজ ভট্টাচার্যের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবনের শুরু চট্টগ্রামের কলিজিয়েট স্কুলে। এরপর পড়েছেন মিউনিসিপ্যাল হাইস্কুল এবং চট্টগ্রাম কলেজে। জাতীয়তাবাদী বিপ্লবীদের ভাবশিষ্য পঙ্কজ ভট্টাচার্য পাকিস্তানী শাসকদের অন্যায্য কার্যক্রমের প্রতিবাদ করতে ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন স্কুলজীবনেই। ১৯৬০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তখন আইয়ূব খানের সামরিক শাসন এবং বৈরী-বৈষম্যমূলক আচরণের প্রতিবাদে বিস্ফোরন্মুখ। প্রতিদিন ঝাঁঝাঁলো মিছিলে উত্তপ্ত বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। সেই উত্তাপে পঙ্কজ ভট্টাচার্য জড়িয়ে পড়েন কেন্দ্রীয় ছাত্র রাজনীতির সাথে। ১৯৬২ সালে শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন তিনি। নেতৃত্বের গুণে তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন এবং ১৯৬৩-৬৪ সালে ছাত্র ইউনিয়নের কার্যকরী সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। পঙ্কজ ভট্টাচার্য সামরিক শাসনবিরোধী সংগঠনগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠনে বিচক্ষণ নেতৃত্বের পরিচয় দিয়েছেন। ১৯৬৭ সালে স্বৈরশাসক আইয়ূব খান তাঁর বিরুদ্ধে ‘স্বাধীন বাংলা ষড়যন্ত্র মামলা’ দিয়ে তাঁকে কারারুদ্ধ করে। তিনি ১৯৬৭ সালে অন্যান্ন ছাত্র নেতাদের সাথে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে যোগ দেন এবং ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় অনিবার্য মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তিনি সংগঠক হিসেবে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের সমন্বয়ে বিশেষ গেরিলা বাহিনী গঠন করে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। বাংলার স্বাধীনতার স্বর্ণদ্বীপে বিজয়ের পতাকা উত্তোলনে পঙ্কজ ভট্টাচার্যের অবদান অসাধারণ। ১৯৭২ সালে মাত্র ৩৩ বছর বয়সে তিনি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ এর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৭ থেকে ’৯০ সাল পর্যন্ত তিনি সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। ১৯৯০ সালে তিন জোটের রূপরেখা তৈরিতে তিনি মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। স্বৈরাশাসক এরশাদের পতনের প্রাক্কালে ১৯৯০ সালের শেষ প্রান্তে এসে তাকে আবারো কারারুদ্ধ করা হয়। এরপর ১৯৯৩ সালে দেশের রাজনীতি এবং শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় গুণগত পরিবর্তন ঘটিয়ে সত্যিকার অর্থে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গণফোরাম গড়ে তুলতে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। ২০১০ সালে গণঐক্য গঠন করেন। অতপর গণঐক্য বিলুপ্ত করে ২০১৩ সালে ঐক্য ন্যাপ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বর্তমানে ঐক্য ন্যাপের সভাপতি।
পঙ্কজ ভট্টাচার্য মনে-প্রাণে বিশুদ্ধ রাজনীতিক।তাঁর রাজনীতি-অসাম্প্রদায়িকতার, মানবতার এবং সমাজ বদলের। তিনি বিশ্বাস করেন সমাজ বিপ্লবের মধ্য দিয়েই রাষ্ট্রের চরিত্রে গুণগত পরিবর্তন সম্ভব। সেই সম্ভাবনার স্বপ্নেই রাজনীতি ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে শুদ্ধ করার প্রয়াসে তিনি ১৯৯৮ সালে ‘সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন’ নামক সংগঠন প্রতিষ্ঠায় নিয়ামক ভূমিকা পালন করেন। বতর্মানে তিনি সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের অন্যতম প্রেসিডিয়াম সদস্য।
পঙ্কজ ভট্টাচার্য ক্রীড়ামোদি মানুষ। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবে তাঁর সুখ্যাতি ছিল। রাজনৈতিক সহকর্মীদের প্রতি তাঁর সংবেদনশীল দায়িত্ববোধ তাঁকে অন্যমাত্রা দিয়েছে। ইতিহাসের বহু বাঁকবদলের কারিগর, ধীমান কর্মচঞ্চল পুরুষ পঙ্কজ ভট্টাচার্য্। দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সংখ্যালঘু, আদিবাসী, নারী-শিশু নিপীড়নের বিরুদ্ধে তিনির্ সবর্দা সোচ্চা প্রতিবাদ গড়ে তুলতে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। অসাম্প্রদায়িক, সমতাভিত্তিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নদ্রষ্টা পঙ্কজ ভট্টাচার্য নিজ বিশ্বাস ও আস্থায় অবিচল থেকে সারাদেশের মানুষকে সংগঠিক করার কাজে আজীবন নিবেদিত রয়েছেন। সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন বলিষ্ট কণ্ঠস্বর ও সংগঠক।