বহুমুখী আতঙ্ক প্রশাসনে

নিউজ ডেস্ক
সত্যবাণী

ঢাকাঃ বাংলাদেশের প্রশাসনিক অঙ্গনে এখন ঘূর্ণিঝড়-পূর্ব নিস্তব্ধতার মতো পরিবেশ। কে আগামী দিনে ক্ষমতার আসনে বসবে, আর কে পড়ে যাবে অপসারণের তালিকায়। এই অনিশ্চয়তা ও গুঞ্জনেই কেটে যাচ্ছে রাজধানীর সচিবালয় থেকে পুলিশ হেডকোয়ার্টার পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দফতরগুলো। প্রশাসনের ভিতর থেকে উঠে আসছে আতঙ্ক, নীরবতা আর হিসাব-নিকাশের কাহিনী।

রাজনৈতিক বাস্তবতা বদলের আভাস

সরকারি মহলে আলোচনা, আন্তর্জাতিক মহলের চাপ, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও ক্রমবর্ধমান জনঅসন্তোষের ফলে আসন্ন মাসগুলোতে বড় ধরনের রাজনৈতিক রদবদল ঘটতে পারে। কেউ বলছেন, একটি জাতীয় ঐকমত্যের সরকার বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। আবার কেউ মনে করছেন, বর্তমান সরকারই আরও কৌশলী হয়ে টিকে থাকতে চাইবে। এই দুই সম্ভাবনার মাঝখানে প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে চলছে ‘ওয়েট অ্যান্ড সি’ (অপেক্ষা করো আর দেখো) নীতি।বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. দিলীপ বড়ুয়া সম্প্রতি একটি টকশোতে বলেন, “বর্তমান সংকট সামাল দিতে সরকার নতুন জোট, এমনকি সাময়িক জাতীয় সরকার গঠনের দিকেও যেতে পারে।” (সূত্র: আরটিভি, ৯ এপ্রিল)

সচিবালয়ে চাপা উত্তেজনা

সচিবালয়ের একাধিক দপ্তরে দেখা গেছে, গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের ফাইল ঝুলে আছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে কর্মকর্তারা নিচু গলায় বলছেন, “নতুন বছরে পুরনো পরিস্থিতি ফিরবে কি না, নিশ্চিত না। তাই কেউ সাহস করে ঝুঁকি নিতে চাচ্ছে না।” কেউ কেউ আবার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও পরবর্তী প্রজন্মের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে দেশের বাইরে যাওয়ার পথ খুঁজছেন।একজন যুগ্ম সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আমরা জানি না আগামী সপ্তাহে কোন পদক্ষেপ আসবে। এমনকি আমাদের বদলি হতে পারে হঠাৎ করেই।” (সূত্র: প্রথম আলো, ১০ এপ্রিল)

আমলাদের দ্বিধা ও দুশ্চিন্তা

বিশেষ করে যারা অতীতে দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে পদোন্নতি পেয়েছেন বা রাজনৈতিক সুবিধাবাদীদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাদের মধ্যে এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতা দেখা যাচ্ছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তনে তারা হয়তো অপসারণ, বদলি বা আইনি জটিলতায় পড়তে পারেন।এই আশঙ্কায় তাদের মধ্যে দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়ে গেছে।অন্যদিকে নিরপেক্ষ এবং দক্ষ কর্মকর্তারা মনে করছেন, এই অস্থিরতা হয়তো প্রশাসনকে ‘ক্লিন আপ’ করার একটি সুযোগ এনে দেবে। এক সিনিয়র আমলা মন্তব্য করেন, “আমরা তো সব সময় পলিসি মেইকিংয়ের বাইরে থেকে কাজ করেছি। যদি স্বচ্ছতা ফিরে আসে, আমাদের জন্য ভালোই হবে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মনোভাব

র‌্যাব, পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগেও চলছে আত্মপক্ষ সমর্থনের প্রস্তুতি। বিশেষ করে যেসব সদস্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে আন্তর্জাতিক নজরদারিতে রয়েছেন, তাদের মধ্যে উৎকণ্ঠা বেশি। সম্প্রতি দেখা গেছে, কিছু সদস্য ব্যক্তিগতভাবে মিডিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করে ‘নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার’ করার চেষ্টা করছেন।ডিবি’র এক সিনিয়র কর্মকর্তা জানিয়েছেন, “আমরা এখন কোনো ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ নিচ্ছি না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে অভিযানও সীমিত থাকবে।” (সূত্র: যমুনা টিভি, ১০ এপ্রিল)

বিদেশে অর্থপাচার ও বিদেশ ভ্রমণ

গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, গত ছয় মাসে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের ভিসা ও বিদেশ ভ্রমণের হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। কেউ কেউ বিদেশে সম্পদ স্থানান্তরের চেষ্টাও করছেন বলে গুঞ্জন রয়েছে। প্রবাসে অবস্থানরত পরিবার সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগও বেড়েছে।বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি সূত্র জানিয়েছে, মার্চ মাসে প্রায় ৩৫টি সন্দেহজনক রেমিটেন্স লেনদেন তদন্তাধীন রয়েছে। (সূত্র: বিডিনিউজ২৪, ৮ এপ্রিল)

ব্যবসায়ী ও দালাল চক্রের অস্থিরতা

রাজনৈতিক ছায়াতলে গড়ে ওঠা নানা ধরনের সিন্ডিকেট,দালাল, ঠিকাদার, কমিশনভিত্তিক ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর মধ্যেও ব্যাপক অস্থিরতা বিরাজ করছে। অনেকেই এখন ‘পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতা কেন্দ্রে ঢোকার’ চেষ্টা করছেন আবার কেউ কেউ একাধিক রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছেন, যাতে পরিস্থিতি যেদিকে গড়াক তারা টিকে থাকতে পারেন।ফেডারেশন অফ বাংলাদেশ চেম্বারস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (FBCCI) এক বিবৃতিতে বলেছে, “রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া বাণিজ্যিক বিনিয়োগ ঝুঁকির মুখে পড়বে।” (FBCCI প্রেস রিলিজ, ৯ এপ্রিল)বাংলাদেশের প্রশাসনে এখন এক অস্বাভাবিক চাপা পরিবেশ। সবাই শ্বাস আটকে অপেক্ষা করছে রাজনীতি কী মোড় নেয়, তার ওপর নির্ভর করে কে থাকবে নিরাপদ, কে পড়বে সংকটে। প্রশাসনের এই নিঃশব্দ দোলাচল, দেশের আগামী দিনের রাজনৈতিক ভূ-চিত্রে বড় ধরনের ইঙ্গিত বহন করছে।

You might also like