বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র তৈরী করে দেওয়াই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় অর্জন
নিউজ ডেস্ক
সত্যবাণী
লন্ডন: লন্ডনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ্যালামনাইদের নিয়ে গঠিত সংগঠন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবের উদ্যোগে আয়োজিত ‘শতবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্জন ও সংকট’ শীর্ষক ওয়েবনারে অংশ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) প্রফেসর ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেছেন, বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র সৃষ্টি করে দিতে পারাই হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষের সবচেয়ে বড় অর্জন। মায়ের ভাষায় কথা বলার সুযোগ করে দেওয়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান। বুদ্ধিভিত্তিক উপাদানের যোগান দিয়ে একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনে যে ভূমিকা রেখেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, তার নেতৃত্বে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই অর্থে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জাতির জনক তৈরীতে ভূমিকা রেখেছে। পৃথিবীর দ্বিতীয় কোন বিশ্ববিদ্যালয় পাওয়া যাবে না যে বিশ্ববিদ্যালয় একটি রাষ্ট্র গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, আর সেই রাষ্ট্রটি আবার অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র।
শনিবার লন্ডন থেকে সম্প্রচারিত ওয়েবনারে প্রফেসর মাকসুদ কামাল বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জাতির পিতা হয়ে উঠার পেছনে অন্যন্য ভূমিকা রেখেছিলেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। একটি জাতির মুক্তি সংগ্রামের মুল লক্ষ্যে পৌঁছিয়ে দেওয়ার পেছনে এই মহিয়সী নারীর ভূমিকা ছিলো অপরিসীম। ১৯৬৯ এ গণঅভ্যূত্থানকালে আইয়ুব খান বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে তাঁর সাথে আলোচনায় বসার জন্য প্রস্তাব দিয়েছিলো। সেই সময়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অনেক নেতা বঙ্গবন্ধুকে আলোচনায় অংশ নেওয়ার কথা বলেছিলেন, কিন্তু বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেসা মুজিব বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি না নিয়ে জেল খানায় থাকার পরামর্শ দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে সম্পূর্ণরূপে নির্দোষ ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে কারাগারে থাকার জন্য বলেছিলেন বঙ্গমাতা। মানুষের জন্য, দেশের মুক্তি সংগ্রামের জন্য কোন স্ত্রী তাঁর স্বামীকে কারাগারে থাকতে বলেন এমন নারীর সংখ্যা খুবই বিরল। বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব ছিলেন তেমনই একজন মহিয়সী নারী। যাঁর বুদ্ধি, সাহস ও সকল ধরণের সহযোগিতার কারণে বঙ্গবন্ধু আমাদের একটি স্বাধীন রাস্ট্রের নাগরিক হওয়ার সুযোগ করে দিতে পেরেছেন। ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডে জাতির জনকের সাথে তাঁর পরিবারের যে সকল সদস্য নিহত হয়েছিলেন তাঁদের রুহের মাগফেরাত কামনা করেন।
শতবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্জন ও সংকট নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন, প্রফেসর ড. সাদেকা হালিম ও সাবেক ইনফরমেশন কমিশনার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবের আয়োজকদের এ ধরণের একটি সমসাময়িক ওয়েবনার আয়োজনের জন্য ধন্যবাদ জানান।তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অনেকেই পাশ্চাত্যের অক্সফোর্ডের সাথে তুলনা করেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ২৬ শতাংশ রিসার্চ গ্রান্ড পেয়ে থাকে। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়িত্বশাসিত হলেও বাজেটে গবেষণার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তেমন বরাদ্ধ নেই।
প্রফেসর সাদেক সাদেকা হালিম জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৩৫ হাজার, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ৭ টি কলেজ রয়েছে সেই সাথে সান্ধ্যকালীন কোর্স পরিচালনা করার কারণেও বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিধি অনেক বড় হয়েছে। সামাজ বিজ্ঞান অনুষদে ৩০০ শিক্ষকের বিপরীতে ৬ হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে যা রীতিমতো একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট শিক্ষার্থীর সমান। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের যেখানে ১১ জন শিক্ষার্থীর জন্য ১ জন শিক্ষক রয়েছে সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি ২০ জনের জন্য রয়েছে ১ জন শিক্ষক। এতো কম সংখ্যক শিক্ষক ও শিক্ষা সরঞ্জামাদি দিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে মান বজায় রাখা দূরহ। তবে ইতিবাচক দিক হলো এই শিক্ষার্থীদের ৩০ শতাংশের উপরেই নারী। এটি বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নারীর ক্ষমতায়নের একটি সুফল বলেই মনে করেন তিনি। তবে সংকটের জায়গাটা হলো শিক্ষার্থীদের প্রায় সকলেই মাস্টার্স ডিগ্রীও নিচ্ছেন যা সচরাচর উন্নত বিশ্বে দেখা যায় না। সবার মাস্টার্স ডিগ্রী নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে কিনা সেটি ভাবনার সময় এসেছে বলেও মনে করেন প্রফেসর সাদেকা হালিম।
যুক্তরাজ্যের লিংকন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র লেকচারার ও কমনওয়েলথ এ্যাডভাইজার কমিশনের পরামর্শক ডক্টর মাহফুজুর রহমান বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্জনগুলো ঠিক মতো উপস্থাপন করতে না পারার অভাব রয়েছে। বিশ্ববিদ্যারয়ের অনেক অর্জন রয়েছে, শিক্ষকদের যোগ্যতা রয়েছে কিন্তু পাবলিক রিলেশন টিম খুবই দূর্বল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদানগুলো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরার পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে মত দেন তিনি।
ডকুমেন্টেশনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পিছিয়ে গেছে বিষয়টিকে স্বীকার করে শতবর্ষকে সামনে রেখে নানা পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানান প্রফেসর মাকসুদ কামাল। কভিড নাইনটিনের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে আগামী বছর লন্ডনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ উদযাপনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অঙ্গণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্জন তুলে ধরা হবে। লন্ডনের এ্যালামনাইদের সাথে নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ উদযাপনে একসাথে কাজ করবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আলোচনাকালে টাইমস হায়ার এডুকেশন কর্তৃক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক র্যাংকিং প্রাপ্তিতে যুক্তরাজ্যের এ্যালামনাইদের সহযোগিতার কথা কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করে প্রফেসর মাকসুদ কামাল সামনের দিনগুলোতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবের সদস্যদের সাথে নিয়ে বিদেশে অবস্থানরত এ্যালামনাইদের অভিজ্ঞতা ও পরামর্শকে কাজে লাগিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে তাঁদেরকে যুক্ত করার আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
উপ-উপাচার্য বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টার্মিনাল ডিগ্রী দেওয়ার ক্ষেত্রে বেশী মনোযোগী। গ্রাজুয়েশন ডিগ্রী দেওয়া ও শিক্ষার্থীদের চাকরি জীবনে প্রবেশ করানোতে বেশী মনযোগ দেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। গবেষণা নির্ভর শিক্ষা না হওয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের প্রধান অন্তরায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গবন্ধুর মতো জাতির পিতা তৈরী করলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নোবেল লরিয়েট তৈরী করতে পারছে না। আধুনিক যন্ত্রপাতির স্বল্পতা রয়েছে, গবেষণায় পর্যাপ্ত বরাদ্ধ নেই। পিএইচডির শিক্ষার্থী খুব কম, আন্ডার গ্রাজুয়েট লেভেলের শিক্ষার্থী বেশী। বিদেশী শিক্ষার্থী ও শিক্ষক নেই। গবেষণা মনস্ক অবস্থা সৃষ্টি করার জন্য উৎসাহ নেই। সামনের দিন গুলোতে ব্রিটিশ বাংলাদেশীদের মধ্য থেকে ভিজিটিং প্রফেসর হিসাবে নিয়োগ দেওয়ার প্রস্তাবনাও বিবেচনায় রয়েছে বলে জানান প্রফেসর মাকসুদ কামাল।
ফেইসবুক ও ইউটিউবে সরাসরি সম্প্রচারিত এক ঘন্টার ওই আলোচনাটির সঞ্চালনা করেন একাত্তর টেলিভিশনের সাংবাদিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব ইউকের ম্যানেজমেন্টের সদস্য তানভীর আহমেদ। আলোচনার প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশ নিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব ইউকের ম্যানেজমেন্টের সদস্য থার্ড সেক্টর কনসালটেন্ট বিধান গোস্বামী, শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন সোনালী ব্যাংক ইউকের সাবেক ডেপুটি চিফ এক্সিকিউটিভ আমীরুল ইসলাম চৌধুরী, ব্যারিস্টার অজয় রায় রতন, ব্যারিস্টার চৌধুরী হাফিজুর রহমান, ব্যারিস্টার কাজী আশিকুর রহমান, আইনজীবী মুজাহিদুল ইসলাম, আইনজীবী ইউসূফ ইকবাল, আইনজীবী ঝুমুর দত্ত, রওশন আরা জাহান পলি, সংবাদ পাঠিকা হিমিকা আযাদ, রেহানা ফেরদৌস মনি ও সঙ্গীত শিল্পী শুভ্রা মুস্তাফা ।
এর আগে জুম এ্যাপের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ্যালামনাই এসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠার স্মৃতিচারণ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ্যালামনাই এসোসিয়েশন বাংলাদেশের সাবেক সভাপতি রকিব উদ্দীন আহমেদ। ঢাকা থেকে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছেন ঢাকা ইউনিভার্সিটি এ্যালামনাই এসোসিয়েশন বাংলাদেশের সিনিয়র সহ সভাপতি মোল্লা আবু কাওসার, বাংলাদেশ এনার্জি কমিশনের সদস্য ড. সেলিম মাহমুদ, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট বার এসোসিয়েশনের সাবেক সাধারন সম্পাদক এ্যাডভোকেট মমতাজ উদ্দীন আহমেদ।
এছাড়াও করোনা কালীন সময়ে যুক্তরাজ্যে এ্যালামনাইদের কার্যক্রম ও ক্লাবের ভবিষ্যত কর্ম পরিধী নিয়ে আলোচনায় যুক্ত ছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব ম্যানেজমেন্টের অন্যতম সদস্য বাংলাদেশ ল অ্যাসোসিয়েশন ইউকের সাবেক সভাপতি এ্যাডভোকেট শাহ আলম সরকার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও যুক্তরাজ্যের লিংকন্স ইউনিভার্সিটির রিসার্চ স্কলার শাহ রিদওয়ান চৌধুরী, এডুকেশন কনসালট্যান্ট গোলাম মর্তুজা, সৈয়দা নাসরিন ভূঁইয়া, সুপ্রতীম দেব, আইনজীবী মামুন আল ফিরোজী, রথীন্দ্র গোস্বামী, শায়লা শিমলা, মনির সারোয়ার, এ্যাডভোকেট কাওসার আলম হীরা, সোহেল আহমেদ, আসাদ কিবরিয়া তানিন ও মনির সরকার সহ যুক্তরাজ্যে বসবাসরত প্রায় অর্ধ শতাধিক এ্যালামনাই। অনুষ্ঠানে শিল্পী সারোয়ার-ই আলমের আধুনিক গানের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের পরিসমাপ্তি হয়। মনোজ্ঞ সঙ্গীতানুষ্ঠান পরিচালনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে ইউকের সদস্য সংবাদ উপস্থাপক কিশোয়ার মুনিয়া।