বাংলা সাহিত্যের যে রহস্য ঘুমিয়ে আছে বিলেতের ম্যানচেস্টারে
সাঈম চৌধুরী
বিলেতের ম্যানচেস্টার। এই শহরে কোথাও ঘুমিয়ে আছেন এক দীর্ঘশ্বাস, বাংলা সাহিত্যের জগতে সবচেয়ে বেশি চর্চিত জমাট রহস্য। তাকে নিয়ে কতশত রচনা, কত শত গবেষণা। এসবে কেবল পুরুষই নায়ক হয়ে ওঠেন, কেননা যে পুরুষ এখানে নায়ক তিনি তো বাংলা সাহিত্যের মুকুটহীন সম্রাট। ইতিহাস তো বিজয়ীর গুণগানে ব্যতিব্যস্ত। তার বিপরীতে এই শহরে ম্যানচেস্টারে ঘুমিয়ে থাকা নারীটি কেবল পার্শ্ব নায়িকা হয়ে অযাচিত অপবাদের রসদ যোগান। তিনি নার্গিস। কবি নজরুলের নার্গিস। নজরুল তাকে লেখা চিঠিতে কি সহজ স্বীকারোক্তি করেন। বলেন, অন্তর্যামী জানেন , তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কি গভীর ক্ষত, কি অসীম বেদনা, কিন্তু সে বেদনার আগুনে আমিই পুড়েছি । তা দিয়ে তোমায় কোনদিন দগ্ধ করতে চাইনি। তুমি এই আগুনের পরশ মানিক না দিলে আমি অগ্নিবীণা বাজাতে পারতাম না । ধূমকেতুর বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না।
নার্গিসে নজরুল পেয়েছেন অগ্নিবীনা, তাতে সুর তুলছেন, নার্গিসে নজরুল পেয়েছেন ধূমকেতু, মহাজাগতিক বস্তুর সন্ধান। বিনিময়ে নার্গিস তবে কি পেলেন? কেবলই দীর্ঘশ্বাস, অন্তহীন অপেক্ষার তীব্র কঠিন যন্ত্রণা।
এমনকি যে নার্গিস নামে তাকে আমরা চিনি, সেটিও তার নাম নয়। আসল নাম সৈয়দা বানু।আদুরে নাম দুবরাজ। ঘনিষ্ঠ স্বজনরা সেটিকে যুবরাজ করে নিয়েছিলেন। পরে সেটি আরও সংক্ষিপ্ত করে জুবি হয়েছে। নজরুল তার নাম দিয়েছেন নার্গিস।
নজরুলের সঙ্গে যখন নার্গিসের দেখা হয় তখন তিনি ষোড়শী। দুই বেণি চুল। তাকে দেখে অভিভূত নজরুল।
পথের মাঝে চমকে কে গো
থমকে যায় ঐ শরম লতা।
নজরুলের সঙ্গে নার্গিসের প্রথম দেখা হয়েছিলো এক বিয়ের আসরে। তাতে গানও গেয়েছিলেন নার্গিস। কিশোরীর গানে, কিশোরীর খলখল হাসিতে মুগ্ধ নজরুল।
তখন ১৯২০ সাল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে কলকাতায় ফিরেন নজরুল । থাকতেন বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির একটা ঘরে। পাশের ঘরের প্রতিবেশী আলী আকবর খান। একজন পুস্তক ব্যবসায়ী। নজরুলের সঙ্গে আলী আকবর খানের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হতে খুব বেশি সময় যায় না। এতই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, কলকাতা থেকে কুমিল্লার দৌলতপুরে নিজ বাড়িতে যাবার সময় কবি নজরুলকে সঙ্গে নিয়ে যান আলী আকবর খান।
দৌলতপুরের ঐ বাড়িটি নার্গিসের মামাবাড়ি। বাবা মারা যাবার পর মামারাই নার্গিসের অভিভাবক।
১৯২১ সালের এপ্রিল মাসে দৌলতপুর গিয়েছিলেন কবি। তখন তার বয়স সবে ২২ বছর। আর নার্গিস ষোড়শী।
দুজনের দেখা হয় বিয়ের অনুষ্ঠানে। সে বছরের মে মাসে নার্গিসের ভাইয়ের বিয়ে। সেদিন গান গেয়েছিলেন নার্গিস। সেদিন নজরুলকে জয় করে ছিলেন নার্গিস। আর নজরুল? তাকে ভালো না বেসে উপায় আছে কারো?
অতিথি হয়ে গিয়েও ঘরের মানুষ হতে তার সময় লাগে না। ঝাঁকড়া চুলের সুদর্শন তরুণ, বাউন্ডুলে চলা, গলা খুলে গান, মাঝে মাঝে বাঁশিতে সুর। ষোড়শী নার্গিসের হৃদয়কে উথাল পাতাল করতে আর কী চাই?
প্রেম তাই সঘন হয়ে উঠে সহজে। মাত্র অল্প দিনের সে প্রেম।
মে মাসে প্রথম দেখা। জুন মাসেই বাজে বিয়ের বাদ্য। দিন ধার্য হয় ১৭ জুন। বাংলা মাসটা জেনে রাখুন। তিসরা আষাঢ়। আষাঢ় মানেই তো, এত জল ও কাজল চোখে। একটু পরেই আসছি জলের গল্পে।
কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিয়ে বলে কথা। মহা ধুমধাম। টানা সাতদিন চলে গান বাজনা, হৈহোল্লর। সে বিয়েতে বাঁশি বাজাবেন বলে এলেন ওস্তাদ আলাউদ্দীন খানের ভাই প্রখ্যাত বংশীবাদক আফতাবউদ্দীন খান। বুঝুন তবে ব্যাপার!
বিয়ের দেনমোহরও চমকে দেবার মতো। আজ থেকে কাটায় কাটায় একশ দুই বছর আগে সে বিয়ের মোহর ২৫ হাজার টাকা! রীতিমতো অবিশ্বাস্য।
বিয়ে হলো রাতে। ক্ষণিকের বাসর। ফুলশয্যায় ফুল ছিলো না। ছিলো তীব্র কাঁটার দহন। আষাঢ় মাসের আকাশ কালো। তার চেয়ে অধিক কালো ছিলো সে রাত। কী কথা হয়েছিলো দুজনের? কেনো নজরুল এতো বিদ্রোহী? সবার অনুরোধ, অনুনয় পায়ে ঠেলে ভোরের আলো ফোটার আগেই নজরুল ত্যাগ করেন দৌলতপুর। যেনো দৌলতপুরের সব দৌলত মাটিতে লুটোয়।
নজরুল এই ক্ষত চিরকাল বহন করেছেন। নার্গিস ফুলের তীব্র সুবাস তাকে যন্ত্রণা দিয়েছে আমৃত্যু। তবু নজরুল তো পুরুষ। একশ বছর আগের পুরুষ। পুরুষ তখন অসীম ক্ষমতার অধিকারী। আর নারী? নারী সে যতই গান করুক, তবু তো একশ বছর আগের। যখন জনসাধারণে এই ধারণা মজবুত, পতি পরম ধন।
বিয়ের রাতেই পতির সঙ্গে বিচ্ছেদ সেই সময়ে নারীর জন্য সবচেয়ে বড় অভিশাপ। নার্গিস সেই অভিশাপে অভিশপ্ত। নার্গিস চোখে অন্ধকার দেখেন। নার্গিসের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে।
লোকমুখে শুনতে পান, নজরুল নাকি বলেছেন, আসছে শ্রাবণে আসবেন। বউ তুলে নিয়ে যাবেন। নার্গিস পথ চেয়ে থাকেন। পথ চাওয়া ছাড়া আর যে তার কোনো পথ ছিলো না।
শ্রাবণ আসে। নজরুল আসেন না। ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক যায়, নজরুলের ছায়াও দেখা যায় না।
কাজী নজরুল কতটা বেদনাহত ছিলেন প্রশ্ন করার অধিকার এখানে তৈরি হতেই পারে। বেদনাকে জয় করতে পেরেছিলেন বলেই বুঝি, আবার তিনি প্রেমে পড়েছিলেন?
সেই কুমিল্লা। নার্গিসের কুমিল্লা। প্রমিলার কুমিল্লা। ১৯২৪ সালে কুমিল্লাতেই প্রমিলার সাথে বিয়ে হয় কবি কাজীর।
অথচ নার্গিস তখনও পথ চেয়ে আছেন। তখনও তালাকনামায় স্বাক্ষর করেন নি নজরুল। নার্গিস চাইলে এই সময়ে ২৫ হাজার টাকা দেনমোহরের দাবি নিয়ে দাঁড়াতে পারতেন, ভরণপোষণের দাবি নিয়ে দাঁড়াতে পারতেন, নার্গিস তার কিছুই করেন না। সবচেয়ে বড় সম্পদ হারিয়েছেন তিনি, সম্পত্তিতে কি তার ক্ষতিপূরণ হয়?
নিজেকে ব্যস্ত রাখতে মামা আকবর আলি খানের সাথে ঢাকায় চলে আসেন তিনি। প্রাইভেটে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেন। ইডেন গার্লস কলেজ থেকে আইএ পাশ করেন। লেখালেখিতে ব্যস্ত হোন। সোহরাব রুস্তমের উপগাথা অবলম্বনে তাহমিনা নামের উপন্যাস লিখেন। তাতে স্বামী পরিত্যক্তা তাহমিনার ক্ষোভ দুঃখ কষ্ট যেনো অলক্ষ্যে নার্গিসের কথা বলে যায়। নজরুল ছেড়ে দেবার পাত্র নন। তাহমিনার জবাব দিলেন হিংসাতুর কবিতায়। বলেন,
হায়, তুমি বুঝিবে না,
হাসির ফুর্তি উড়ায় যে – তার অশ্রুর কত দেনা !
নজরুলের অশ্রুর কতটা দেনা ছিলো তার অনেক হিসাব হয়েছে, নার্গিসের হিসাব কখনো মিলে নি। নিজেকে ব্যস্ত রাখতে নার্গিস পড়ালেখা করেন, লেখালেখি করেন আর নজরুলকে অব্যাহতভাবে চিঠি লিখেন। অভিমানী কবি সেইসব চিঠি জবাবহীন রেখে দেন। মাত্র একটির উত্তর লিখেন। যেটি বাঙালির প্রেমের চিঠির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অমূল্য সম্পদ।
অথচ প্রেমাতুর নার্গিস নজরুলের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরও লিখেন প্রমীলাকে বিয়ে ক’রেছেন তাতে কিছু আসে যায় না, একবারটি যেন দেখা করেন।
আহা কী আকুতি। ১৯২১ থেকে ১৯৩৭। ১৬ বছর নার্গিস নজরুলের জন্য এমন আকুতি নিয়ে অপেক্ষা করেছেন।
১৬ বছরের বালিকা প্রেমে পড়েছিলো বাউন্ডুলে কবির। আরও ষোলো বছর কেবল তার সেই প্রেমের প্রায়শ্চিত।
১৯৩৭ সালের নভেম্বর মাসে কলকাতার শিয়ালদহ হোটেলে নজরুলের সাথে দেখা করেন নার্গিস। স্বামীর কাছে থাকার আকুতি জানান। প্রমিলা কিছুতেই মেনে নেবেন না এই দোহাইয়ে তাকে নিবৃত করেন কবি।
পরের বছর এপ্রিল মাসে তালাক হয়। দেনমোহর, ভরণপোষণ, ক্ষতিপূরণ কিছুই দাবি করেন না নার্গিস। এই বিয়েতে দীর্ঘশ্বাস ছাড়া তার আর কোনো সম্বল প্রয়োজন ছিলো না।
সে বছরের ডিসেম্বরে কাজী নজরুলের প্রিয়ভাজন কবি আজিজুল হাকীমের সাথে বিয়ে হয় নার্গিস অথবা সৈয়দা বানুর।
বিয়ের দিন সকালে শুভেচ্ছা জানিয়ে বার্তা পাঠান আমাদের বিদ্রোহী কবি নজরুল। বার্তাটি আজ বিখ্যাত গান হয়ে আমাদের হৃদয়ে দোলা দেয়।
‘পথ চলিতে যদি চকিতে
কভু দেখা হয় পরানপ্রিয়’
চাহিতে যেমন আগের দিনে
তেমনই মদির-চোখে চাহিয়ো॥
শ্রুত আছে ১৯৪০ সালে নজরুলের সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিলো নার্গিসের। ঐ সময়ে নজরুল ঢাকায় এলে কবিভক্ত স্বামী আজিজুল হাকীম তাকে নিজের বাসায় নিয়ে এসেছিলেন। এক মাসের প্রেম, এক রাতের সংসার, ১৬ বছরের পথ চেয়ে থাকা তারপর বিচ্ছেদ। তারপর আবার দেখা। প্রেম কত বিচিত্রময়।
স্বামীর মৃত্যুর পর ১৯৭১ সালের শুরুর দিকে যুক্তরাজ্যে বসবাসরত ছেলের কাছে চলে আসেন নার্গিস।
জীবনের শেষ ১৪ বছর এই ম্যানচেস্টারে কাটিয়েছেন তিনি। এখানের তীব্র শীতের উতাল বাতাস ধারণ করেছে নার্গিসের বহু দীর্ঘশ্বাস। তারপর ১৯৮৫ সালে জীবনাবসান। দৌলতপুরের মেয়ে ঘুমিয়ে আছেন ম্যানচেস্টারে।
নজরুল নার্গিসকে না পেয়ে পেয়েছেন অগ্নিবীনা, পেয়েছেন ধূমকেতু।
আর নার্গিস পেয়েছেন কেবল একটি অনুরোধ
পথ চলিতে যদি চকিতে
কভু দেখা হয় পরানপ্রিয়’
চাহিতে যেমন আগের দিনে
তেমনই মদির-চোখে চাহিয়ো…।
সাঈম চৌধুরী: অতিথি লেখক, সত্যবাণী