বাবা শেখ মুজিবের শৈশবের গল্প শোনালেন শেখ রেহানা
নিউজ ডেস্ক
সত্যবাণী
ঢাকা: জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে শিশুদের সামনে বাবার শৈশবের গল্প শোনালেন তার ছোট মেয়ে শেখ রেহানা।
বুধবার ঢাকার স্কলাস্টিকা স্কুলের এক অনুষ্ঠানে ‘আমার বাবার ছেলেবেলা’ শিরোনামে এক বক্তৃতায় তিনি বঙ্গবন্ধুর শৈশবের নানা ঘটনা ও বাবার রাজতৈনিক জীবনের নানা বাঁকের কথা তুলে আনেন।
শেখ রেহানা বলেন, ‘আমার দাদা-দাদি, ফুফু, মায়ের মুখে শোনা এবং আব্বার নিজের লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে জানতে পারি এসব গল্প। এই শিশুর আগমনে আজানের ধ্বনি, মধুমতি নদীর ঢেউ, পাখিদের কলতানে পুরো গ্রাম যেন আনন্দে মেতে উঠে। সারা গ্রামে মিষ্টি ও খোরমা বিলানো, গরিব-দুঃখীদের মাঝে কাপড় বিলানো, মিলাদ পড়ানো নানা আয়োজনে উৎসবে পরিণত হলো গ্রামটি।’
তিনি আরও বলেন, ‘একান্নবর্তী পরিবারের শিশুটি সবার আদরে একোল থেকে ওকোলে চড়ে আনন্দেই শিশুকাল পার করছিল। সবার চোখের মনি, বড় দুই বোন তো কোল থেকে নামাতেই চাইতেন না। আরও একটু বড় হওয়ার পর আস্তে আস্তে আরবি, বাংলা, ইংরেজি, ফারসি, অংকসহ লেখাপড়াটা শুরু করে দিলেন। আব্বার লেখাপড়ার হাতেখড়ি দাদার কাছে।’
শেখ রেহানা বলেন, ‘সব শিশুদের চেয়ে বাবা (শেখ মুজিব) ছিলেন একটু অন্যরকম। বাড়ির মুরুব্বি, শিক্ষক, কৃষক, মাঝিভাই সকলেই এক বাক্যে স্বীকার করতেন- এই বাচ্চাটা অন্যসব বাচ্চা থেকে একটু অন্যরকম। এই বাচ্চার মনটা অনেক বড়, অনেক পরোপকারী। কারও দুঃখ-কষ্ট দেখলে এগিয়ে যাওয়া, নিজের জামা খুলে অন্যের গায়ে তুলে দেওয়া, খাবার ভাগাভাগি করে খাওয়া দেখে মুগ্ধ নয়নে সবাই তাকাতো, আর দোয়া করত।’
তিনি বলতে থাকেন, ‘ছোট্ট মুজিব সবকিছু জানতে চাইতেন। বাবাকে প্রশ্নের ওপর প্রশ্ন করতেন, বাবাও ছেলের সব প্রশ্নের উত্তর দিতেন। তিনি বই পড়ে শোনাতেন বড় বড় মানুষের কথা, ধর্মের কথা, বিজ্ঞানের কথা। আবার দাদা আর আমার আব্বা মুজিব ছিলেন ঠিক বন্ধুর মতন। দাদা যেমন শ্রদ্ধা আর সমীহ করে চলতেন, তেমনি সবকিছু তার সাথেই নিঃসংকোচে আলোচনা করতেন। কোনো দিনও তার খোকাকে কোনো কাজে বাধা দিতেন না।’
একটা ঘটনার উল্লেখ করে রেহানা বলেন, ‘একবার এলাকায় খুব প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলো, ফসলের অনেক ক্ষতি হলো। ঘরে ঘরে খাবারের জন্য হাহাকার। ছোট মুজিবের মনে মানুষের জন্য অনেক কষ্ট। দাদা দাদিকে বলে আমাদের গোলা ঘর থেকে ধান চাল বিলানো শুরু করলেন। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাল সংগ্রহ করে যাদের নেই তাদের কাছে পৌঁছে দিতেন। একবার আমার দাদা কলকাতা থেকে সুন্দর একটা আলোয়ান (চাদর) কিনে আনলেন মুজিবের জন্য। মুজিব সেটা পরে বাইরে বের হলেন ঘুরতে। ফেরার পথে দেখেন জীর্ণশীর্ণ বয়স্ক মানুষ গাছের নিচে বসে প্রচণ্ড শীতে কাঁপছে। আব্বা সেটা দেখে নিজের চাদরটা তার গায়ে পরিয়ে দিয়ে বাড়ি চলে আসলেন শীতে কাঁপতে কাঁপতে।’
চোখে সমস্যা দেখা দেওয়ায় শৈশবে চোখে অপারেশন করার পর চশমা পরা নিয়ে শেখ মুজিব কতটা বিড়ম্বনায় পড়েছিলেন সে গল্পের উল্লেখ করে তার ছোট মেয়ে বলেন, ‘দাদা প্রচুর বই কিনে আনতেন। ইতিহাস, ভুগোল, ইংরেজি, বাংলা, ধর্ম, বিজ্ঞান, সাহিত্য, বড় বড় মনীষীদের জীবনী, ব্রিটিশদের অত্যাচারের কথা। তিনি নিজেই ছেলেকে পড়ে শোনাতেন। এরপর টুঙ্গিপাড়া থেকে গোপালগঞ্জে এনে মিশনারী স্কুলে ভর্তি করা হলো মুজিবকে। বাবার সঙ্গে গোপালগঞ্জ শহরেই থাকতেন। সুদর্শন বালক, চোখে চশমা- ক্লাসের সবার সঙ্গে খুব ভাব হয়ে গেল। বয়সে বড় দেখে ক্লাসে সবাই মিয়াভাই ও ভাইজান বলে ডাকে। এই কিশোর বালকের মধ্যে একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল। সর্বস্তরের মানুষের সাথে মিশে যেতে পারত। একবার কেউ উনার সান্নিধ্যে এলে সে ভক্ত হয়ে যেত। ঠিক চুম্বকের মতন আকর্ষণ করত।’
একবার খাদ্যাভাব দেখা দিলে কিশোর মুজিব স্কুলের ছাত্র-শিক্ষক সবাইকে নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাল সংগ্রহ করে অনাহারীদের মধ্যে যে বিলিয়ে দিয়েছিলেন- সেই গল্প করে শেখ রেহানা বলেন, ‘কিশোর মুজিবের নাম তখন গোপালগঞ্জে অনেক জনপ্রিয়। যত সুনাম হতে লাগল, ততই কিছু ছাত্র-মানুষের হিংসার পাত্র হয়ে উঠতে লাগল সে। আজেবাজে নালিশ করে দাদার কান ভারী করার চেষ্টা করতে লাগল। শেখ লুৎফর রহমান সাহেবের সন্তানের ওপর অগাধ বিশ্বাস। খোকা কোনো অন্যায় কাজ করতে পারে না। দু-একটা দুষ্টুমিতো জানতোই। বাবা জানতে চাইলে উনি মাথা নিচু করে দোষ স্বীকার করতেন।’