বিমানবন্দরের আদলে নির্মিত হচ্ছে সিলেট কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল
চঞ্চল মাহমুদ ফুলর
সত্যবাণী
ব্যুরো প্রধান,সিলেট অফিসঃ বিমানবন্দরের আদলে নির্মিত হচ্ছে সিলেট কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল। নবনির্মিত এ টার্মিনাল সিলেটের আধুনিক স্থাপত্যশৈলীতে যোগ করেছে নতুন মাত্রা। আগামী জুন মাসে প্রকল্পের কাজ শেষ হতে পারে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন সিলেট সিটি কর্পোরেশনের (সিসিক) ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান।
সরেজমিনে ঘুরে ও সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সিলেট নগরির দক্ষিণ সুরমার কদমতলী কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালের অনেকাংশ একটা সময় ছিল ফাঁকা এবং ময়লা আবর্জনার ভাগাড়। এ স্থানেই নির্মিত হয়েছে দৃষ্টিনন্দন বাস টার্মিনাল। উপরে ইট রং এর স্টিলের টিনের ছাদ, কারুকার্যময় লাল ইটের দেয়াল, গাছপালা আবৃত গ্রিনজোন, বিমানবন্দরের আদলে আলাদা বাস ডিপারচার ও অ্যারাইভাল এবং যাত্রীদের জন্য প্রায় ১৫শ’ সিটের বিশাল ওয়েটিং লাউঞ্জের সুবিধা রয়েছে এ টার্মিনালে।নির্মাণকাজের সাথে সংশ্লিষ্টরা জানান, পুরো টার্মিনালের নির্মাণকাজ তিনটি অংশে ভাগ করা হয়েছে। এরমধ্যে পার্ট-১-এ অবস্থিত ডিপারচার বিল্ডিংয়ের দৈর্ঘ্য সাড়ে ৩শ’ ফুট। এই পার্টে ৪৮টি ‘বাস বে’র সাথে রয়েছে ৯৭০ সিটের যাত্রী বসার সুবিধা সম্পন্ন বিশাল হল। রয়েছে ৩০ সিটের ভিআইপি কক্ষ, ৩০টি টিকেট কাউন্টার ও ৫০ জন মুসল্লি ধারণ ক্ষমতার নামাজ কক্ষ। পুরুষ-মহিলাদের পৃথকসহ প্রতিবন্ধীদের ব্যবহার উপযোগী ৬টি টয়লেট জোন। হুইল চেয়ার নিয়েও যে কেউ টয়লেট ব্যবহার করতে পারবেন। উপরে উঠার জন্য রয়েছে লিফ্ট এবং খাবারের জন্য রেস্টুরেন্ট ও ফুড কোর্ট। থাকবে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে যাওয়া যাত্রীর জন্য সিক বেড, দুগ্ধপোষ্য শিশুদের জন্য ব্রেস্ট ফিডিং জোন।
পার্ট-২-এ এরাইভাল বিল্ডিং-এ একইভাবে প্রায় ৩শ ফুট দৈর্ঘ্যরে। ডিপারচার বিল্ডিং-এর মতো এখানে রয়েছে বাস বে, যাত্রীর বসার জন্য ৫১০ সিটের ওয়েটিং স্পেস ও ৩০ সিটের ভিআইপি কক্ষ, আধুনিক টয়লেট সুবিধা, সিক বেড, ব্রেস্ট ফিডিং জোন, লিফ্ট,রেস্টুরেন্টসহ যাত্রীদের সকল সুযোগ সুবিধা। পার্ট-১ ও পার্ট-২ এর মাধ্যমে ডিপারচার ও এরাইভাল আলাদা করা হলেও করিডোরের মাধ্যমে পুরো স্ট্রাকচার একটি সার্কুলার বিল্ডিং-এ পরিণত হয়েছে। এই বিল্ডিং এর পশ্চিম-দক্ষিণ কর্নারে সড়কের সাথে গোলাকার ৫তলা টাওয়ার বিল্ডিং-এ রয়েছে টার্মিনাল পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা অফিস। যেখানে থাকবে পুরো টার্মিনালের সিকিউরিটি কন্ট্রোল ও সিসিটিভি মনিটরিং কক্ষ, পুলিশ কক্ষ এবং পর্যটন অফিস।টার্মিনালের পিছনের দিকে পার্ট-৩-এ নির্মিত হয়েছে একটি মাল্টিপারপাস ওয়েলফেয়ার সেন্টার। যেখানে মালিক ও চালক সমিতির জন্য থাকবে ২৪ বেডের বিশ্রাম কক্ষ, গোসলের ব্যবস্থা, অফিস, লকার ব্যবস্থা, ক্যান্টিন এবং মিটিং ও অনুষ্ঠানের জন্য বিশাল মাল্টিপারপাস মিলনায়তন।সংশ্লিষ্টরা জানান, বিশ^ব্যাংকের অর্থায়নে মিউনিসিপ্যাল গভর্নমেন্ট সার্ভিস প্রজেক্ট (এমজিএসপি) প্রকল্পের আওতায় সিলেট সিটি কর্পোরেশন ৬৩ কোটি টাকা ব্যয়ে সাড়ে ৮একর জায়গা জুড়ে নির্মাণ করছে নতুন বাস টানির্মাল কমপ্লেক্স। ৬ তলা ভিত্তির ৩য় তলা কমপ্লেক্স প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে ডালি কনস্ট্রাকশন। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের এর সিনিয়র প্রকৌশলী হেলাল উদ্দিন জানান, প্রকল্পের প্রতিটি কাজ অত্যন্ত যতœ সহকারে করা হচ্ছে। উপরের স্টিলের টিন আনা হয়েছে তাইওয়ান থেকে। স্ট্রিল স্ট্রাকচারের জন্য লোহার বার আনা হয়েছে চায়না থেকে এবং প্রতিটি জিনিস বুয়েটে টেস্ট করা হয়েছে। বিমানবন্দরের আদলে বিশাল ওয়েটিং স্পেস রাখা হয়েছে। আছে পার্কিং জোন, পরিবেশের কথা বিবেচনা করে ভবনের পিছনের দিকে থাকবে গাছপালা আচ্ছাদিত গ্রিনজোন। পরিবহন শ্রমিকদের জন্য মাল্টিপারপাস বিল্ডিং এ থাকবে বিশাল হলরুম, অফিস, ওয়াশরুম, রেস্ট রুমসহ বিভিন্ন সুবিধা। প্রকল্পটি ২০১৮ সালের হলেও করোনার কারণে দীর্ঘদিন কাজ বন্ধ ছিল বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, সিলেট টার্মিনাল এখন দেশের অন্যতম সুন্দর একটি স্থাপনা। চট্টগ্রাম বাস টার্মিনাল নির্মাণের জন্য তাদের বিশেষজ্ঞরা নবনির্মিত সিলেট টার্মিনাল দেখে এর প্রশংসা করেছেন। এলজিইডির উর্ধ্বতন প্রকৌশলীরা এসেও অভিভূত হয়েছেন। সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জাকির হোসেন এসেও টার্মিনালের প্রশংসা করে গেছেন। টার্মিনাল এলাকায় সিসিকের সাইট অফিস থেকেও একই কথা জানানো হয়।
নতুন এই টার্মিনালের নকশা করেছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) আর্কিটেকচার বিভাগের ৩ সহকারী অধ্যাপক যথাক্রমে সুব্রত দাশ, রবিন দে এবং মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন। এ প্রসঙ্গে সুব্রত দাশ বলেন, সিলেটের ঐতিহ্য আসাম টাইপ বাড়ি, চাঁদনীঘাটের ঘড়ি বিবেচনা করে এবং একই সাথে আধুনিক স্থাপত্যশৈলীর সমন্বয় ঘটানো হয়েছে নকশায়। এক সময় উপরের লাল শিট পাওয়া যাচ্ছিলো না। কিন্তু সবুজ শিট পর্যাপ্ত ছিল। এরপরও অনেক দিন অপেক্ষা করে লাল শিট এনে লাগানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।তিনি বলেন, টার্মিনালের ডিজাইন করার পূর্বে দেশের বিভিন্ন বাস টার্মিনাল ঘুরে তারা সার্ভে করেন। চালক, যাত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলেছেন। প্রায় সবগুলো টার্মিনালে গাড়িতে যাত্রী উঠেন রাস্তায় এবং মূল বিল্ডিং থাকে টার্মিনালের একেবারে ভিতরে। তাই যাত্রীরা মনে করেন এই বিল্ডিং তাদের জন্য নয়। ফলে তারা রাস্তায় থেকে গাড়িতে উঠে যান। এতে টার্মিনাল অব্যবহৃত থাকে এবং রাস্তায় যানজট হয়। নকশায় টার্মিনালকে যাত্রীদের কাছাকাছি ও তাদের জন্য স্বস্তিদায়ক করার চেষ্টা করা হয়েছে। টার্মিনালে বাতাস চলাচলের জন্য তারের জালি ও লুভ ব্যবহার করা হয়েছে এবং রাখা হয়েছে গ্রিনজোন।সিসিকের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান জানান, সিলেট কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল হবে দেশের অন্যতম দৃষ্টিনন্দন বাস টার্মিনাল। প্রায় ৬৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ টার্মিনালের নির্মাণ কাজ আগামী জুনের মধ্যে শেষ হবে। স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোহাম্মদ শামছুল ইসলামসহ মন্ত্রণালয়ের একাধিক টিম প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেছেন বলে জানান তিনি।বাস টার্মিনালের পরিচালনায় সার্বিক সহযোগিতা আছে এবং থাকবে উল্লেখ করে সিলেট জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি ময়নুল ইসলাম বলেন, যাত্রীদের নিরাপত্তা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার বিষয়য়ে তদারকি থাকতে হবে। সিটি কর্পোরেশন তাদের লোক দিলে ভালো। পরিবহন মালিক-শ্রমিক সমিতির পক্ষ থেকেও বিষয়টি তদারকি করা হবে। টার্মিনাল চালুর পূর্বে সিটি কর্পোরেশন মালিক-শ্রমিক ইউনিয়নের সাথে বসে এ ব্যাপারে পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সিলেট সিটি কর্পোরেশনের ২৬নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র তৌফিক বক্স লিপন বলেন, ‘টার্মিনালে এক সাথে কাজ শুরু করা ছিলো বড় বাঁধা। প্রথমে শ্রমিকরা টার্মিনাল খালি করতে চাননি, তাদের বুঝিয়ে রাজি করা হয়। পরে গাড়ি যখন বের করা হয়, তখনও ধারণা ছিল না টার্মিনালে এতো গাড়ি থাকে। বিপুল সংখ্যক গাড়ি রাখার মতো কোন খালি জায়গা না থাকায় এসব গাড়ি বিভিন্ন রাস্তার পাশে রাখতে হতো। এতে পথচারী ও ব্যবসায়ীরা ভোগান্তির শিকার হয়েছেন। টার্মিনাল চালু হলে এই ভোগান্তির অবসান হবে এবং এর সুবিধা সিলেটসহ দেশের মানুষ ভোগ করবেন বলে জানান তিনি। তিনি জানান, কাজটি নির্দিষ্ট সময়ে শেষ করতে সিসিক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী সার্বক্ষণিক তদারকি করছেন। নির্বাহী প্রকৌশলী আলী আকবর অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন। দক্ষিণ সুরমায় এমন একটি স্থাপনা নির্মাণকাজ সুন্দরভাবে সম্পন্ন হওয়ায় তিনি সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। দৃষ্টিনন্দন আধুনিক বাস টার্মিনাল পরিচালনার জন্য নীতিমালা তৈরি করার কাজ চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, পার্কিং এলাকা ছাড়া গাড়ি দাঁড় করানো যাবে না, ইচ্ছেমতো কাউন্টার বসানো যাবে না ইত্যাদি বিষয়ে নীতিমালা তৈরির কাজ চলছে। চালক-শ্রমিকদের সাথে কথা বলার বিষয়ে বলেন, অবশ্যই তাদের সাথে বসেই নীতিমালা চূড়ান্ত করা হবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন, মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, প্রকৌশলী, পরিবহন ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীসহ সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই বিশাল কাজটি সম্পন্ন হচ্ছে বলে জানান এ কাউন্সিলর।
নতুন টার্মিনাল সরকারের দৃশ্যমান অগ্রগতির একটি নিদর্শন উল্লেখ করে সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জাকির হোসেন বলেন, শুধু বাংলাদেশই নয়, বিশে^র উন্নত দেশের টার্মিনালের সকল সুযোগ সুবিধা সম্পন্ন একটি বাস টার্মিনাল হচ্ছে সিলেটে। দৃষ্টিনন্দন ডিজাইন, বিমানবন্দরের আদলে এরাইভাল ও ডিপারচার ব্যবস্থা, মা ও শিশু, রোগী ও প্রতিবন্ধীদের বিষয় বিবেচনায় নিয়ে তাদের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা রাখা হয়েছে। সিলেটে এমন একটি স্থাপনা নির্মিত হওয়ায় তিনি প্রধানমন্ত্রী, সাবেক অর্থমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান সিলেট সিটি কর্পোরেশনসহ সকলের প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন তিনি।
দক্ষিণ সুরমা কনজুমার এসোসিয়েশনের আহবায়ক ও কদমতলী এলাকার ব্যবসায়ী মকসুদ আহমদ বলেন, ময়লা-আবর্জনা, দুর্গন্ধসহ নানা অস্বাস্থ্যকর অবস্থা থেকে সিলেট বাস টার্মিনালের এক আমূল পরিবর্তন হয়েছে। এখন দেশের সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন-আধুনিক টার্মিনাল থেকে মানুষ যেন ভালো সার্ভিস পায়-সেটাই তার প্রত্যাশা।