বুলবুল হত্যার নেপথ্যে ‘ছিনতাই’জড়িত তিনজনের মধ্যে আবুলের স্বীকারোক্তি
চঞ্চল মাহমুদ ফুলর
সত্যবাণী
সিলেট থেকেঃ শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) লোকপ্রশাসন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের মেধাবী শিক্ষার্থী বুলবুল আহমেদকে ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয়েছে। পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের টিলাগাঁও এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৫ জনকে আটক এবং বুলবুল হত্যায় ব্যবহৃত ছুরি এবং তার মোবাইল ফোন উদ্ধার করেছে। বুধবার দুপুর ২টায় জালালাবাদ থানায় সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান সিলেট মহানগর পুলিশের (এসএমপি) উপ-কমিশনার (উত্তর) আজবাহার আলী শেখ। এ ঘটনায় ৫ জনকে আটক করা হলেও হত্যাকান্ডে সরাসরি ৩ জনের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলেও জানান তিনি। এরমধ্যে আবুল হোসেন নামের এক ছিনতাইকারী আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। বুলবুল হত্যার ঘটনায় বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসন বাদী হয়ে ওইদিনই একটি হত্যা মামলা দায়ের করে জালালাবাদ থানায়।
আদালতে আসামী আবুলের স্বীকারোক্তি
বুলবুল হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছে গ্রেফতার আবুল হোসেন। আবুল মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সুমন ভুইয়ার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। এরআগে গতকাল তাকে কড়া পুলিশ প্রহরায় আদালতে আনা হয়। স্বীকারোক্তি গ্রহণের পর আদালত তাকে জেলহাজতে প্রেরণের নির্দেশ দেন বলে জানান মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এস আই দেবাশীষ দেব।
পুলিশের সংবাদ সম্মেলন
উপ-পুলিশ কমিশনার আজবাহার আলী শেখ জানান, ‘বিশ^বিদ্যালয়ের দায়েরকৃত মামলার ভিত্তিতে এসএমপি তাৎক্ষণিক ঘটনার বিষয়ে প্রকাশ্য-গোপনে তদন্ত ও আসামী গ্রেফতার অভিযান শুরু এবং ঘটনাস্থলের আশপাশ এলাকা থেকে ঘটনায় জড়িত সন্দেহভাজন ৩ ব্যক্তিকে আটক করে। আটককৃত ৩ ব্যক্তিকে আলাদা আলাদাভাবে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পুলিশী জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে আটককৃত ব্যক্তি টিলারগাঁওয়ের মো. আনিছ আলীর ছেলে মো. আবুল হোসেন (১৯) ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে। আবুল হোসেনের জবানবন্দীর ভিত্তিতে ঘটনায় জড়িত আরও ২ জন আসামী একই এলাকার গোলাব আহমদের ছেলে কামরুল আহমদ (২৯) এবং মৃত তছির আলীর ছেলে মো. হাসান (১৯) কে আটক করা হয়। আসামীদের আটক করার পর ঘটনার বিষয়ে তাদের ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তারা উভয়ে প্রাথমিকভাবে ঘটনার সাথে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে। আটককৃত আসামী কামরুলকে আরো ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদে সে ঘটনায় ব্যবহৃত ছুরি ও ভিকটিম বুলবুল আহমদের নিকট থেকে ছিনতাইকৃত মোবাইল ফোন তার হেফাজতে অর্থাৎ তার বাসায় আছে বলে জানায়। উপ-পুলিশ কমিশনার বলেন, তাৎক্ষণিক আমরা উক্ত আসামী কামরুলসহ তার বসতবাড়িতে যাই এবং আসামী উপস্থিত সাক্ষী এবং গণমাধ্যম কর্মীদের সামনে তার নিজ হাতে বসত ঘরের সিলিং-এর পশ্চিম দিক হতে ভিকটিম বুলবুলের কাছ থেকে ছিনতাইকৃত মোবাইল ফোন এবং ঘরের দক্ষিণ দিকের সানসেডের পূর্ব কোণের উপর থেকে ঘটনায় ব্যবহৃত ছুরি নিজ হাতে বের করে দেয়। তাৎক্ষণিক আলামতগুলো সাক্ষীদের উপস্থিতিতে জব্দ করা হয়েছে বলেও জানান।’
উপ-পুলিশ কমিশনার বলেন, প্রাথমিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, আসামিরা বুলবুলের কাছে মোবাইল ও মানিব্যাগ দাবি করে। বুলবুল এগুলো দিতে অস্বীকৃতি জানালে তাদের মধ্যে ধস্তাধস্তি হয়। একপর্যায়ে তাকে ছুরিকাঘাত করা হয়। এতে বুলবুল মাটিতে পড়ে গেলে রক্ত দেখে তারা মোবাইল নিয়ে দ্রুত পালিয়ে যায়। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, এটা ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে হতে পারে।আজবাহার আলী শেখ বলেন, ‘বুলবুলকে ছুরিকাঘাত করে কামরুল ইসলাম। এ সময় তার সঙ্গে আবুল হোসেন ও মো. হাসান ছিলেন। তাদের সবার বাড়ি বিশ^বিদ্যালয়ের পাশর্^বর্তী টিলাগাঁও এলাকায়। এদিকে হত্যার ঘটনায় বুলবুলের কথিত প্রেমিকার সম্পৃক্ততা এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তবে বিষয়টি তদন্তাধীন।ঘটনায় অন্যকেউ জড়িত আছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে আজবাহার আলী বলেন, আটককৃতদের ফোন কল চেক করে এবং প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে অন্য কারো সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। ঘটনাটি বিস্তর জানতে তদন্ত চলছে।
ঘটনার পর বুলবুলের বান্ধবীকে জিজ্ঞাসাবাদের পরিপ্রেক্ষিতে তার কোন সম্পৃক্ততা আছে কি না জানতে চাইলে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, বুলবুলের বান্ধবীকে আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পেরেছি তার সাথে বুলবুলের সম্পর্ক ছিল, তারা সেখানে ঘুরতে যায়। এতে তাদের একা পেয়ে বুলবুলকে ছুরিকাঘাত করে ছিনতাইকারীরা। পরে শুধু তার মোবাইল নিয়ে যায়, তবে তার বান্ধবী হত্যাকা-ে জড়িত আছে এমন কোন আলামত জিজ্ঞাসাবাদ ও মোবাইল চেক করে পাওয়া যায়নি বলে উল্লেখ করেন তিনি।
শাবি উপাচার্যের সংবাদ সম্মেলন
এদিকে বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে শাবি উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, বুলবুলের পরিবারকে প্রাথমিকভাবে ৫লাখ টাকা আর্থিক সহযোগিতা দেয়া হবে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তার পরিবারের সাথে সবসময় থাকবে। তিনি আরো বলেন, আমরা বুলবুলের হত্যাকা-ে যারা জড়িত, তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করবো।অন্যদিকে বুলবুলের পরিবারকে প্রাথমিকভাবে ৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে এমন বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় বিক্ষোভ মিছিল করেছে লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থীরা।লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী আশরাফুল আলম আকাশ বলেন, বুলবুলের পরিবারকে এককালীন ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ এবং প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকা করে দিতে হবে তার পরিবারকে। এছাড়া এদিন সকালে বুলবুলের হত্যাকা-ের প্রতিবাদ ও জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে শোক র্যালি ও কালোব্যাজ ধারণ করে শাবি ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
নিরাপত্তায় কাজে আসছে না সীমানা প্রাচীর
বিশ^বিদ্যালয়ের ছয় কিলোমিটার এলাকায় সীমানাপ্রাচীর দেয়া হলেও বিশ^বিদ্যালয়ে নিরাপত্তায় প্রাচীর তেমন কাজে আসছে না বলে অভিযোগ করেন শিক্ষার্থীরা। বিশ^বিদ্যালয় সীমানাপ্রাচীরের যথেষ্ট উচ্চতা না থাকায়, তারকাটা বেড়া কম দেওয়ায় এবং প্রাচীরের নিচে ফাঁকা জায়গা থাকায় বহিরাগতরা অবাধে বিশ^বিদ্যালয়ে প্রবেশ করতে পারে বলে অভিযোগ করেন শিক্ষার্থীরা। এদিকে সীমানাপ্রাচীর নির্মাণে অনিয়ম নিয়ে এরআগে একাধিক গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হলেও বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেয়নি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শিক্ষার্থী বলেন, সীমানাপ্রাচীর নির্মাণে অনিয়ম না হলে বহিরাগতরা প্রাচীরের নিরাপত্তাভেদ করে প্রবেশ করতে পারতো না। ত্রুটিপূর্ণ এবং দুর্বল অবকাঠামোর কারণেই ছিনতাইকারীরা শিক্ষার্থীদের ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যেতে পারছে। সীমানাপ্রাচীর সংস্কারের পাশাপাশি নিরাপত্তা ব্যবস্থা বাড়ানোর দাবি শিক্ষার্থীদের। এদিকে মঙ্গলবার ও বুধবার মানববন্ধন, বিক্ষোভ করে জড়িতদের শাস্তির পাশাপাশি ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা ব্যবস্থা বাড়ানোর দাবি জানিয়ে আসছেন শিক্ষার্থীরা।প্রসঙ্গত, বুলবুল আহমেদ শাবি’র লোকপ্রশাসন বিভাগের তৃতীয় (২০১৮-১৯ সেশন) বর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহপরাণ হলে ২২৮ নম্বর রুমে থাকতেন এবং ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি নরসিংদী সদরের চিনিশপুর থানার নন্দিপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মো. ওহাব মিয়ার ছেলে। গত সোমবার সন্ধ্যায় এক বান্ধবীর সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে অবস্থিত গাজী-কালু টিলায় ঘুরতে যায় বুলবুল। পরে সেখানে অবস্থানকালীন সময়ে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আহত হন তিনি। এতে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে বুলবুল মাটিতে লুটে পড়েন। পরে শিক্ষার্থীরা জানতে পেরে তাকে উদ্ধার করে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে দায়িত্বরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।