ব্রিটিশ মিডিয়ায় ২০২০ সালের শীর্ষ তরুণ ব্যবসায়ী তালিকায় বাংলাদেশী হারুন
হারুন দানিছ একজন তরুণ বাংলাদেশী উদ্যেক্তা। জন্ম লন্ডনে কিন্তু বেড়ে ওঠা ও স্কুল, কলেজ শেষ করেছেন ওয়েলসে এবং বর্তমানে বাস করছেন ম্যানচেস্টারে। চারটি দেশের সমন্বয়ে গঠিত যুক্তরাজ্যের একটি হল ওয়েলস যার রাজধানী কার্ডিফ। কার্ডিফ নাম শুনলে হয়তবা আপনি ২০০৫ সালের অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অবিস্মরণীয় বিজয়ের ইতিহাস মনে করবেন আর সেনানায়ক ছিলেন তখনকার তরুণ মোহাম্মদ আশরাফুল যার অনবদ্য ইনিংস আমাদের কাংখিত বিজয় ছিনিয়ে আনে। বিজয়ের এই মাসে প্রতিটি আনন্দ যেন মাত্রাকে ভিন্নভাবে উপলব্দি করায়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ ৩.১৫ মিলিয়ন জনসংখ্যার এই দেশটিতে বাংলাদেশী মাত্র হাজার দশেক। ক্ষুদ্র কমিউনিটির মধ্যে বৃহৎ সাফল্য পেয়েছেন অনেকেই, হারুন তাদের মধ্যে অন্যতম। যিনি অর্থনৈতিক মন্দাবস্থায় প্রসার ঘটিয়েছেন তার ব্যবসার পেয়েছেন সাফল্য। তাইতো ২০২০ সালের ওয়েলসের তরুণ উদ্যোক্তা হিসেবে স্থান করে নিয়েছেন জাতীয় গণমাধ্যমে। সম্প্রতি জাতীয় পত্রিকা ওয়েলস অনলাইনে ৩৫ জন সফল তরুণ উদ্যোক্তার একটি তালিকা প্রকাশ করে তাদের মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশী হিসেবে ৭ম স্থানে রয়েছে হারুনের নাম। তারই সফতার ইতিহাস তুলে ধরব পাঠকদের।
পঞ্চাশ কিংবা ষাটের দশকে বাংলাদেশীদের আগমণ ঘটে বৃটেনে তখন বেশির ভাগ মানুষই কর্মরত ছিল পোষাক শিল্পে। পরবর্তীতে কারি শিল্প স্বদেশীদের অনুপ্রাণিত করে সেই পথে ধাবিত করে। পাঁচ লক্ষাধিক বাংলাদেশী জনগোষ্ঠীর বৃহৎ অংশ রন্ধন বা কারি ইন্ড্রাস্ট্রিতে কর্মরত এবং বৃটিশ অর্থনীতিতে যার অবদান পাঁচ বিলিয়ন পাউন্ড। যদিও নতুন প্রজন্ম ভিন্ন ভিন্ন পেশায় নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করছেন তবে তার পরিসংখ্যান কিন্তু ছোট। সেক্ষেত্রে নতুন প্রজন্মের উদ্যোক্তা হিসেবে বেশ সফল হয়েছেন ৩৪ বছর বয়সী হারুন দানিছ। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির ১ বছর অতিক্রম করার পর গ্যাপ ইয়ার নিয়ে আর ফেরা হয়নি কোর্স সমাপনীতে।
ঠিক দশ বছর আগে ম্যানচেস্টারে শুরু করেন নন সার্জিক্যাল ত্বক ক্লিনিক “স্কিন হেইচ কিউ।” প্রথমে ছোট পরিসরে ছোট শুরু করলেও বর্তমানে ইউকেতে শাখা রয়েছে বেশ কটি। শুধু দেশেই নয় প্রশাখা বিস্তার করতে চান ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, এশিয়া সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। ফ্রাঞ্চাইজের মাধ্যমে সেই লক্ষ্যে কাজ করছেন নিরলসভাবে। ব্যতিক্রম ধর্মী এই শিল্পে তার আগ্রহের কথা জানতে চাইলে তিনি প্রতিউত্তরে বলেন আমার পারিবার ব্যবসায়িক পরিবার। পঞ্চাশের দশকে আমার দাদা যখন সিলেটের জগন্নাথপুর থেকে বৃটেনে পাড়ি জমান তার আর্থিক অবস্থার পরিবর্তনের জন্য। যদিও তার আসার উপায়টা ছিল বেশ কষ্টসাধ্য প্রথমে সৌদিতে হজ্জ্ব ট্রিপ পরবর্তীতে সিরিয়া ও বাগদাদে অবস্থান ও কাজ করা এবং পরিশেষে বৃটেনে আগমণ। প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি (দাদা) টেক্সটাইলে কাজ করে পরবর্তীতে নিজেই কাপড়ের ফ্যাক্টরি চালু করেন। এখনকার ইস্ট লন্ডনে গেলে হয়তবা মনে হবে ছোট্ট একটা বাংলাদেশ কিন্তু তৎকালীন সময়ে পুরো এলাকা ছিল ইহুদি অধ্যুষিত। দাদার ব্যবসায়ী চিন্তা ধারায় বাবা সেই পথে কিন্তু ইন্ড্রাস্ট্রিটা ভিন্ন, পোষাকের নয় খাবারের মানে রেস্টুরেন্ট। সেখানে আমিও তার সাথে অল্প বয়সে জড়িত থেকে চেইন অফ রেস্টুরেন্ট করলেও পরবর্তীতে তা থেকে বেরিয়ে নতুন কিছু উদ্ভাবনের চিন্তায় ঘুরপাক খাই। তখনই স্কিন কেয়ার ইন্ড্রাস্ট্রির দিকে ধাবিত হই।
২০০৭/০৮ সালে আর্থিক মন্দাবস্থায় ও এই শিল্পের বিশ্বব্যাপী বিকাশ ঘটে এবং আমাকে আরো বেশি আত্নবিশ্বাসী করে তুলে। শুরুতে হারুনের ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে নিজের ত্বকের ব্যাপারে আনন্দিত করা। এই ধারণাই পরবর্তীতে তাকে অপারেশন বিহীন স্কিন কেয়ার মার্কেটে প্রবেশ করায় এবং সাশ্রয়ী মূল্যে ত্বকের চিকিৎসা মানুষের দোর গোড়ায় পৌঁছে দেবার প্রেরনা যোগায়। যার জন্য তিনি পুরো ভিন্ন আঙ্গিকে এই স্কিন কেয়ার ক্লিনিকের শাখা ছড়িয়েছেন যেখানে জিম ষ্টাইল মেম্বারশীপের আদলে ভিন্ন বয়সী সাধারণ মানুষ স্কিনের যত্নে অত্যন্ত ভাল মানের সেবা পেতে পারেন আর তার মাধ্যমেই স্কিন হেইচ কিউ প্রসাধনী শিল্পে ভিন্ন মাত্রা যোগ করে।
ইউকে স্কেল আপ ইন্সটিটিউটের তথ্য মতে মাত্র তিন বছরে হারুন তার প্রতিষ্ঠান স্কিন হেইচ কিউকে বৃটেনের টপ ১℅ ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধি অর্জনের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন। আন্তর্জাতিক ভোক্তা রিভিউ সংস্থা ট্রাস্ট পাইলট রেটিং (৪.৫ স্টার) সমৃদ্ব গুণগত মান ও লোকমূখে প্রচারিত সুনাম স্কিন হেইচ কিউ ক্লিনিক গুলোর সাফল্যে পরিপূর্ণতা এনে দিয়েছে। হারুন তার এ ব্রান্ডের সফলতায় উচ্চাসিত। নতুন নতুন সেবা গ্রহীতারাও তাদের শহরে ক্লিনিকের শাখা বৃদ্ধির আহবান জানাচ্ছে সেই সাথে নতুন উদ্যোক্তারা কিভাবে এই ব্রান্ডের সাথে সমৃক্ত হয়ে সফলতার পথ অনুকরণ করবে সেই প্রশ্নই করছে।
বিশ্বে বর্তমানে বিউটি ইন্ড্রাস্ট্রি খাতে আয় ৫৩২ বিলিয়ন ডলার আর নিরীক্ষণ করে পরিসংখ্যান ঘাটলে শুধুমাত্র স্কিন কেয়ার খাতে বিশ্ব বাজার ১৪৫ বিলিয়ন ডলারের। হারুন দানিছ মনে করেন বর্তমান এই মহামারিতে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা কিন্তু তার এই ব্যবসায়ীক ব্রান্ডটি নিয়মিত দ্রুত আগাচ্ছে। ফ্রাঞ্চাইজের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ ইতিমধ্যেই শুরু করেছেন এবং প্রতিনিয়ত আগ্রহীদের যোগাযোগ পাচ্ছেন। তারই অভিজ্ঞতার আলোকে সম্প্রতি সহ লেখক হিসেবে “ফ্রাঞ্চাইজিং ফ্রীডম” নামে একটি বই ও লেখেন যা আমাজনে প্রকাশিত হবার একদিনের মাথায় ইউকে, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ায় বিক্রির ক্ষেত্রে শীর্ষ স্থান দখল করে নেয়।
ব্যবসায়ীক সফলতার স্বীকৃতি স্বরুপ গ্রেট ব্রিটিশ ওন্ট্রপ্রনার এওয়ার্ড এবং আমেরিকা ভিত্তিক আন্তর্জাতিক বিজনেস এওয়ার্ডে (স্টিভি) ওন্ট্রপ্রনার অফ দ্যা ইয়ার এবং তার প্রতিষ্ঠিত ব্রান্ড স্কিন হেইচ কিউ কোম্পানি অফ দ্যা ইয়ার ক্যাটাগরিতে স্বর্ণ পদক জয়ী হয়। ২০২০ সালের স্টিভির ১৭ তম এই আসরে বিশ্বের ৬৩টি দেশ থেকে প্রায় 3800 নমিনেশনের মধ্যে থেকে ২টি ক্যাটাগরিতে চূড়ান্ত পদক জিতে নেন। যা বাংলাদেশী ব্যবসায়ী হিসেবে বিরাট অর্জন। তিনি বিশ্বাস করেন এই প্রাপ্তি তাকে সামনে এগিয়ে যেতে শুধু প্রেরণাই যোগায়নি বরং নতুন উদ্যোক্তাদেরকে ও অনুপ্রানিত করবে।
ব্যবসায়ীক সফলতার পাশাপাশি হারুন উদারতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। গোটা দেশ যখন কভিডের প্রকোপে বিপর্যস্ত আর মহামারিতে নিজের জীবন বাজি রেখে কাজ করেছেন আমাদের ফ্রন্টলাইন কর্মীজীবিরা। এই তালিকায় ডাক্তার, নার্স ও ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের কর্মীরা ছাড়াও রয়েছেন লরি ড্রাইবার, সুপার মার্কেটের কর্মজীবিরা সেই সব বীরদের জন্য স্কিন এইচ কিউ এর মাধ্যমে ১.৫ মিলিয়ন পাউন্ডের সমমান অর্থের ফ্রী সেবা প্রদান করে ভূয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছেন। তার সাফল্য ও উদার মনোভাবের সমাজহিতৈসী কর্মের কথা বিবিসি সহ ইউকের মূল ধারার জাতীয় গণমাধ্যমে ঠাঁই করে নিয়েছে।
ফ্রাঞ্চাইজের শাখা বিস্তারের পাশাপাশি প্রজন্মকে প্রশিক্ষিত করে তুলা ও নতুন কর্মসংস্থান বৃদ্ধির লক্ষে যৌথ ভাবে বর্তমানে কাজ করছেন নর্দান আয়ারল্যান্ডের সরকারের সাথে এবং কন্সেপ্টটি বাংলাদেশে ও বাস্তবায়ন তার লক্ষ্য। তিনি বলেন বাংলাদেশের সাথে আমার নাড়ীর সম্পর্ক যা আমার পূর্বপুরুষের আদিনিবাস, শুধু তাই নয় বিশ্বের দ্রুত বর্ধমান অর্থনীতির এই বাংলাদেশে ব্যবসায়ীক প্রসার ঘটিয়ে জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে সম্পৃক্ত হলে নিজেকে গর্বিত বলে মনে করবেন। সেইসাথে বাংলাদেশীদের বর্তমান বিশ্বে উদ্ভাবনী শিল্পে সম্পৃক্ত হওয়ার আহবান জানান।