ভাষা আন্দোলন ও জননেতা পীর হবিবুর রহমান

 রুহুল কুদ্দুস বাবুল

১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারী নবগঠিত পাকিস্তানের গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন বসে করাচীতে। উর্দু ও ইংরেজীকে গণপরিষদের সরকারি ভাষা বলে ঘোষনা করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত একটি মুলতবি প্রস্তাব উত্থাপন করে উর্দু ও ইলরেজীর সাথে বাংলাকেও যুক্ত করার দাবি জানান। পূর্ব বাংলার সকল সদস্যসহ পশ্চিম পাকিস্তানের সব সদস্য একজোট হয়ে তাঁর প্রস্তাব নাকচ করে দেয়। প্রতিবাদে ঢাকায় ছাত্র জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। পূর্ব পাকিস্তানের মূখ্যমন্ত্রি খাজা নাজিম উদ্দিন ছাত্রদের সাথে আপোষ করেন কিন্তু পাকিস্তানের আসল শাসকরা তা মেনে নেয়নি। নির্মম দমন পীড়ন শুরু করে। ছাত্র আন্দোলন অনেকটা স্তিমিত হয়ে আসে। কিন্তু ‘তমদ্দুন মজলিশ’ থেমে থাকেনি।
তমদ্দুন মজলিশ ৪৮ সালের ৮ মার্চ প্রদেশব্যাপী ‘বাংলা রাস্ট্রভাষা দিবশ’ পালনের আহ্বান জানায়। তমদ্দুন মজলিশ ঘোষিত কর্মসুচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কথা সাহিত্যিক শাহেদ আলি ঢাকা থেকে এসে জোবেদা খাতুন চৌধুরির সাথে দেখা করেন। জোবেদা খাতুন তাঁর পুত্র মোয়াজ্জেম আহমেদ চৌধুরির মাধ্যমে তৎকালিন ছাত্রনেতা হবিবুর রহমানকে (পীর হবিবুর রহমান) তাঁর বাসায় ডেকে পাঠান। জোবেদা খাতুন চৌধুরী ও শাহেদ আলি সিলেটে তমদ্দুন মকলিশের কর্মসুচি বাস্তবায়ন করার তাঁকে দায়িত্ব দেন। দায়িত্ব নিয়ে পীর হবিবুর রহমান তাঁর বন্ধু মকসুদ আহমদকে সাথে নিয়ে সভার আয়োজনে নেমে পড়েন।
আসাম প্রদেশে মুসলিম মহিলাদের মধ্যে স্বদেশী আন্দোলনের অগ্রপথিক সিলেটে মহিলা মুসলিম লীগের সভানেত্রী বেগম জোবেদা খাতুন চৌধুরীর উদ্যোগে এবং বাংলাভাষার পক্ষের মুসলিমলীগ নেতা ও মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের একাংশের সহযোগিতায় তৎকালিন ছাত্রনেতা পীর হবিবুর রহমান ও মকসুদ আহমদ ৮ মার্চ তমুদ্দুন মজলিশের কর্মসুচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গোবিন্দ চরণ পার্কে (বর্তমান হাসান মার্কেট) সভার আয়োজন করেন। দুজনে মিলে সভার জন্য একটা ইশতেহারও লিখেন। যথাসময়ে সভায় উপস্থিত হন – মাহমুদ আলী (সাবেক আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সেক্রেটারি), দেওয়ান মুহাম্মদ আজরফ (অধ্যক্ষ), এ.জেড.আব্দুল্লাহ (মুতাওয়াল্লি, দরগাহে শাহজালাল), নুরুল হক দশঘরি (সম্পাদক, কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ) দেওয়ান ওহিদুর রাজা চৌধুরি, ছাত্রনেতা আব্দুস সামাদ (সামাদ আজাদ), শাহ এ এস এম কিবরিয়া (সাবেক অর্থমন্ত্রি), আফসার উদ্দিন (অধ্যাপক)। সভার নির্ধারিত সভাপতি জোবেদা খাতুন চৌধুরি উপস্থিত হতে বিলম্ব হওয়ায়, এই ফাঁকে মুসলিম লীগের বাংলাভাষা বিরুধি অংশ সভার নিয়ন্ত্রণ নিতে চেষ্টা চালায়। তড়িঘড়ি করে পীর হবিবুর রহমান সভার সভাপতি হিসাবে মাহমুদ আলীর নাম প্রস্তাব করলে অপর অংশের বাহাউদ্দিন এম এ বারীর (ধলা বারী) নাম প্রস্তাব করে সভাপতির আসন আসন দখলে নেয়ার চেষ্টা চালান। পীর হবিবুর রহমান বুঝতে পারলেন অপর অংশে প্রস্তুতি শক্তিশালি, তিনিও শক্তি সঞ্চয় করতে সিলেট জেলা মুসলিম লীগের সাধারন সম্পাদক মনিরউদ্দীন সাহেবের সাহায্য নিতে সুরমার দক্ষিণ পাড়ে কাছে গেলেন। মনিরউদ্দীন সাহেব বিলম্ব না করে জনৈক ময়না মিয়াকে লোকজন নিয়ে পীর হবিবুর রহমানকে সহযোগিতার নির্দেশ দিলেন। ময়না মিয়ার প্রচুর লাঠিয়াল ও কিছু সাধারণ জনতা নিয়ে পীর হবিবুর রহমান সভাস্থলে পৌছার আগেই কীনব্রীজ পাড় হয়েই শোণলেন তাঁদের সভা পণ্ড হয়ে গেছে এবং তাঁর বন্ধু মকসুদ আহমদকে মুসলিম লীগ নেতা আজমল আলি চৌধুরীর (সাবেক মন্ত্রি, মুক্তিযুদ্ধে সময় পাকিস্তানি বাহিনির সহযোগি,বিজয়ের মুহুর্তে বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত) উস্কানিতে গুণ্ডারা প্রচণ্ড মেরেছে। এ খবর শুনে তিনি তাঁর বন্ধুকে উদ্ধার করার জন্য দিকবিদিক ছুটাছুটি করছেন তখন তাঁর কানে এলো লেংড়া মৌলবি (কুখ্যাত রাজাকার কালা মৌলভী) হুঙ্কার দিচ্ছে “একটাকে খতম করেছি, আরেকটা বাকি রয়েছে খতম করার”। লোকজন পীর হবিবুরকে সতর্ক করছেন “আপনাকে মেরে ফেলবে” তিনি ভয় পাবার পাত্র নন। আজমল আলী বাংলাভাষার বিরুদ্ধে বক্তৃতা করছে পুলিশি প্রহরায়। পীর হবিবুর রহমান তাঁর আহত বন্ধুকে খুঁজে বের করে তাঁকে নিয়ে গেলেন মুসলিম লীগ অফিসে, ওখানে মুসলীম লীগ জেলা সম্পাদক জনাব মনিরউদ্দীন ডাক্তার ডেকে তাঁর চিকিৎসা করালেন।
ঐ জনসভা পণ্ড করা ও মকসুদ আহমদের উপর হামলার প্রতিবাদে তমদ্দুন মজলিশের সম্পাদক দেওয়ান ওহিদুর রাজা এবং মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি আব্দুস সামাদের (সামাদ আজাদ) যুক্ত স্বাক্ষরে পত্রিকায় বিবৃতি পাঠানো হয়। নওবেলাল পত্রিকায় বিবৃতিটি ছাপা হয়।
উল্লেখ্য জোবেদা খাতুন চৌধুরী তাঁর স্বামী দেওয়ান আব্দুর রহিম চৌধুরির বাঁধার কারণে সভায় আসতে ব্যর্থ হন। তাঁর স্বামী বন্দুক হাতে দরজার সামনে পথ আগলে বসে বলেন ” তুমি আজ সভায় যেতে পারবে না, যদি যাও তবে আমি বন্দুক চালিয়ে নিজে আত্মহত্যা করবো”।
পরের দিনই জোবেদা খাতুন চৌধুরী মকসুদ আহমদের উপর হামলার প্রতিবাদে ১০ মার্চ গোবিন্দ পার্কেই সভা আহ্বান করেন। সিদ্ধান্ত হয় জোবেদা খাতুন ২/৩ শত মহিলা সংগঠিত করে সভায় যাবেন। পীর হবিবুর রহমান ও মকসুদ আহমদ সভার প্রচারণা চালান। নির্দিষ্ট সময় সভাস্থলে গিয়ে দেখেন পার্কের গেইটে ১৪৪ ধারা জারির নোটিশ টাঙানো। পুলিশ পার্কে ঢুকতে তাঁদের বাঁধা দিচ্ছে এমন সময় একদল লোক ওখানে কাঁধে লাঠি নিয়ে মিছিল সহকারে আসতে দেখে পীর হবিবুর রহমান এগিয়ে গেলেন। মিছিলের নেতৃত্বে ছিলেন দক্ষিন সুরমার ধরাধরপুর গ্রামের দূর্দণ্ড পতাপশালি আখতার হোসেন। তিনি পীর হবিবুর রহমানকে বললেন ” হবিব মিয়া, আজ আমরা আপনার সভা রক্ষার কসম খেয়ে এসেছি। দেখি কোন বান্দীর বাচ্চা বাংলা ভাষার দাবির সভা ভাংতে আসে”। এ বিষয়ে পীর হবিবুর রহমানের মন্তব্য-“দক্ষিণ সুরমার এমন লোকদের ভয়ে শুধু পাবলিক নয়, প্রশাসনও কাঁপে। আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। এই ব্যাক্তিবর্গ বাংলা ভাষার জন্য জান কুরবান করতে আসবে, যা আমার স্বপ্নেরও অতীত ছিল”।
আন্দোলনের চুড়ান্ত পর্য্যায়ে-২৭ জানুয়ারী ১৯৫২ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রি পল্টন ময়দানের জনসভায় উর্দুই পাকিস্তানের রাস্ট্রভাষা করার ঘোষনা দেন। এর প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ৩০ জানুয়ারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ধর্মঘট আহ্বান করে। ৩১ জানুয়ারী বার লাইব্রেরী হলে গঠিত হয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি। ৪ ফেব্রয়ারী ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। প্রতিবাদ মিছিল চলতে থাকে। ২০ ফেব্রুয়ারী থেকে প্রাদেশিক পরিষদের বাজেট অধিবেশন শুরু হলে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। মিছিল থামেনি। ২১ ফেব্রয়ারী ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল হয়। মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে শহীদ হন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার।
এ শোকবহ খবর দ্রুত সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। সমস্ত বাঙালি জাতি জেগে উঠে। প্রতিবাদ বিক্ষোভ শুরু হয়। সিলেট যেহেতু ভাষা আন্দোলনের আঁতুড় ঘর, এখানে ভাষা আন্দোলনের শিখা জ্বলন্তই ছিল। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটিও ছিলো। সে কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন পীর হবিবুর রহমান। সদস্যদের মধ্যে ছিলেন মাহমুদ আলী, আব্দুর রহিম (লাল বারী), নুরুর রহমান চৌধুরী, এ এইচ সাদত খাঁন, মতসির আলী (কালা মিয়া), এডভোকেট মনির উদ্দিন আহমদ, মৌলানা সখওয়াতুল আম্বিয়া, সৈয়দ মতাহির আলী।
এ কমিটি পরের দিন ২২ ফেব্রুয়ারী সিলেটে হরতালের ডাক দেয়। সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। মুসলিম লীগ থেকে বেশ কয়েকজন জননন্দিত নেতা পদত্যাগ করেন। তাঁরা হলেন মাহমুদ আলী, সরেকওম এ জেড আব্দুল্লাহ, আব্দুর রহিম (লাল বারী), মতসির আলী(কালা মিয়া)। ঐ দিন বিকাল ৩ টায় সংগ্রাম কমিটির উদ্যোগে জেলা বারের সভাপতি মোহাম্মদ আব্দুল্লাহর সভাপতিত্বে গোবিন্দ চরণ পার্কে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। পরের দিন ২৩ ফেব্রুয়ারীও হরতাল আহ্বান করা হয়। হযরত শাহজালালের মাজার চত্বরে গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। রাত ৮ টা পর্যন্ত মিছিল চলতে থাকে। গায়েবানা জানাজার পর গণমিছিল অনুষ্ঠিত হয়, সেই মিছিল ছিল তৎকালিন সময়ের বৃহৎ গণমিছিল।
ছাত্ররাও সে সংগ্রামে সর্বাত্মক অংশগ্রহণ করেন। তখনকার ছাত্রনেতারা ছিলেন খন্দকার রুহুল কুদ্দুস, আবুল মাল আব্দুল মুহিত, এ এস এম কিবরিয়া, নুরুল ইসলাম, মো. আব্দুল আজিজ (অধ্যাপক), সদরউদ্দিন চৌধুরি (শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ব বিদ্যালয়ের প্রথম ভিসি)।
রাজনৈতিক যুবনেতাদের মধ্যে দেওয়ান ফরিদ গাজী, কমরেড আসদ্দর আলি, তারা মিয়া, আব্দুল হামিদ অগ্রণী ভুমিকা পালন করেন।
সিলেটের নারী সমাজ প্রথিতযশা নেত্রী জোবেদা খাতুন চৌধুরির নেতৃত্বে আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহন করেন। অন্যান্যদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন হাজেরা মাহমুদ, সৈয়দা শাহেরাবানু (সাবেক অর্থমন্ত্রি আবুল মাল আব্দুল মুহিতে মা) , সৈয়দা লুৎফুন্নেসা খাতুন, সৈয়দা নজিবুন্নেসা খাতুন, রাবেয়া আলী ( সৈয়দ মুজতবা আলীর সহধর্মিনি)। ২৩ ফেব্রুয়ারী মহিলাদের বিশাল প্রতিবাদ মিছিল হয়। মিছিল শেষে তদানিন্তন জিন্নাহ হলে(শহীদ সোলেমান হল) মহিলা সমাবেশ ও বিকালে গোবিন্দ চরণ পার্কে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সেই সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন মহিলা কলেজের অধ্যাপক আব্দুল মালেক।
(তথ্যসুত্রঃ ‘যে পথ বেয়ে ভাষা আন্দোলন’ শীর্ষক প্রবন্ধ’/পীর হবিবুর রহমান ও বৃহত্তর সিলেটের ইতিহাস, ২য় খণ্ড)

রুহুল কুদ্দুস বাবুল: রাজনীতিক ও লেখক 

You might also like